হলি আর্টিজানে হামলার আট বছর, সেদিন যা ঘটেছিল

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ০১ জুলাই ২০২৪, ০৭:৩০| আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৪, ১২:৩৯
অ- অ+

রাজধানীর গুলশানের অভিজাত হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার আট বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতের ওই হামলা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা বলে বিবেচনা করা হয়। নব্য জেএমবির পাঁচ জঙ্গি বেকারিতে ঢুকে প্রথমে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৮ জন বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

তাদের মধ্যে নয়জন ইতালির, সাতজন জাপানের, একজন ভারতীয় এবং তিনজন বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন। তিনজন বাংলাদেশির মধ্যে একজনের দ্বৈত নাগরিকত্ব ছিলো। নারকীয় ওই হামলা প্রতিরোধ করতে গিয়ে প্রাণ হারান দুই পুলিশ কর্মকর্তা।

বিপথগামী কয়েকজন তরুণের আত্মঘাতী এই হামলা অনেকটাই বদলে দেয় বাংলাদেশকে। সারাবিশ্বে সাড়া ফেলে দেয়া ওই ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না বাংলাদেশ। হলি আর্টিজান হামলার ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের ফলে দেশে জঙ্গি তৎপরতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে মনে করে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে জঙ্গিরা এখন হামলা না চালালেও তারা অন্য রূপে তৎপর বলে তথ্য উঠে এসেছে নানাজনের বক্তব্যে।

এদিকে ২০১৯ সালের ২৭শে নভেম্বর ঢাকার একটি আদালত সাত জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে খালাস দেন। পরে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা। গতবছরের মে মাসে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শুরু হয় হাইকোর্ট বেঞ্চে। পরে ৩০ অক্টোবর আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাত জঙ্গির সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সবাই এখন কারাগারে রয়েছেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘নতুন রায়ে 'আমুত্যু কারাদণ্ড' বলতে বোঝানো হয়েছে, আসামিরা যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন তারা কারাভোগ করবে।’

আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া ব্যক্তিরা হচ্ছেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজিব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে রাশ, সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, মামুনুর রশিদ রিপন এবং শরিফুল ইসলাম খালিদ।

ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলছেন, ২০২১ সালের পরে দেশে কোনো জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেনি। যা আন্তর্জাতিক ভাবেও স্বীকৃত। তিনি মনে করেন, ‘জঙ্গিদের নতুন করে হামলা বা সংগঠিত হবার সক্ষমতা এখন নেই। তবে তাদের বেশ সক্রিয়তা আছে ‘সাইবার স্পেসে’। সেখানে তাদের রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং সবই অনলাইনে হচ্ছে। এটাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হচ্ছে।’

এদিকে প্রতিবছর হালি আর্টিজান হামলায় নিহতদের স্মরণে র‌্যাব-পুলিশ ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা ও নিহতদের পরিবারের সদস্যরা ‘দীপ্ত শপথ ভাস্কর্যে’ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

সেদিন যা ঘটেছিল: ২০১৬ সালের ১লা জুলাই দিনটি ছিল শুক্রবার। সন্ধ্যারাতে হঠাৎ করে খবর আসে গুলশানে 'সন্ত্রাসীদের সঙ্গে' পুলিশের গোলাগুলি হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেল এক রেস্টুরেন্টে সশস্ত্র হামলাকারী ঢুকে বেশ ক'জনকে জিম্মিও করেছে।

কিন্তু ঘটনাটা আসলে কী? গুজব নাকি সত্য- সেটি নিশ্চিত হতেও ঘণ্টাখানেক সময় চলে গেল। পরে জানা গেল হামলাকারীরা ওই রেস্টুরেন্টে থাকা বিদেশি নাগরিকসহ বেশ কয়েকজনকে জিম্মি করেছে। একপর্যায়ে জানা যায় গুলশান ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে।

জিম্মি সংকটের ঘটনায় ১লা জুলাই সন্ধ্যারাত থেকে দিবাগত সারারাত অর্থাৎ ২ জুলাই সারা বিশ্বের গণমাধ্যমের নজর ছিল ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকায় অবস্থিত হলি আর্টিজান বেকারির দিকে।

রাত ৮টা ৪২ মিনিটের দিকে হলি আর্টিজানের মূল ফটকে যান জঙ্গি নিবরাস ইসলাম ও মীর সামেহ মোবাশ্বের। একটু পর রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম বাঁধন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হাজির হন।

ফটকের নিরাপত্তাকর্মী নূর ইসলাম তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে নিবরাস তার ডান চোখের নিচে ঘুষি মারেন। এরপরই পাঁচ জঙ্গি হলি আর্টিজানের ভেতর ঢুকে যান। ঢুকেই গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ভেতরে থাকা সবাইকে জিম্মি করেন।

রাত ৯টার পরেই গুলশান ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের হামলার খবর পায় পুলিশ। গুলশানের তৎকালীন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আশরাফুল করিম জানান, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুলশান থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। জঙ্গিদের প্রতিরোধে সেখানে এগিয়ে গিয়েছিলেন গুলশানের এসি রবিউল ও ওসি সালাউদ্দিন। হলি আর্টিজানের আঙিনায় ঢুকতেই জঙ্গিদের গুলিতে প্রাণ হারান তারা।

রাত ১০টার দিকে পুলিশ, র‍্যাব এবং আধা সামরিক বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের কয়েকশো সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে অবস্থান নেয়। গণমাধ্যম কর্মীরাও ৭৯ নং রোডের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান নেন। রাত সোয়া ১১টার দিকে হাসপাতালে মারা যান বনানী থানার ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দীন।

রাত ৪টা পর্যন্ত অস্ত্রধারীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

আইএসের দায় স্বীকার: রাতেই ইসলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের বার্তা সংস্থা বলে পরিচিত 'আমাক' এ গুলশান হামলার দায় স্বীকার করে ২০ জন নিহত হওয়ার কথা জানায়। আইএস এর পক্ষ থেকে হামলাকারীদের মধ্যে পাঁচজনকে তাদের 'সৈনিক' বলে দাবি করে, হামলার দায় নেয় তারা।

২ জুলাই অভিযানের ঘটনাক্রম: সকাল ৭টা ৩০ মিনিট: রাতভর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন এলাকা ঘিরে রাখার পর যৌথ সেনা, নৌ, পুলিশ, র‌্যাব এবং বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ কমান্ডো দল গুলশানে অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়।

৭টা ৪৫ মিনিট: কমান্ডো বাহিনী অভিযান শুরু করে। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দলের সদস্যরা রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে। এসময় গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়।

সকাল সোয়া ৮টায় রেস্টুরেন্ট থেকে প্রথম দফায় নারী ও শিশুসহ ৬ জনকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। পাশের একটি ভবন থেকে একজন বিদেশি নাগরিক তার মোবাইল ফোনে সেটি ধারণ করেন।

৮টা ৫৫ মিনিটে ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় অভিযানকারীরা। গোয়েন্দা দল ভবনের ভেতর বিস্ফোরকের জন্য তল্লাশি শুরু করে। কিছুক্ষণ পরই আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু করে গোয়েন্দারা।

৯টা ১৫ মিনিটে অভিযান শেষ হয়। কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে প্রায় ১২ ঘণ্টার রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের অবসান হয়।

‘থান্ডারবোল্ট’ নামে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা যে অভিযান চালায় সেখানে জঙ্গি হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচ তরুণের সবাই মারা পড়েন। তারা হলেন- মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ওরফে মামুন, নিবরাজ ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল।

সকাল ১০টায় ৪ জন বিদেশিসহ ১৩ জন জীবিত উদ্ধারের খবর জানানো হয়। রেস্টুরেন্টের ভেতরে অজ্ঞাত পাঁচজনের মৃতদেহ পাওয়ার কথা পুলিশ জানায়।

১১টা ৫০ মিনিট: অভিযানে জঙ্গিদের ছয়জন নিহত এবং একজন ধরা পড়েছে বলে নিশ্চিত করা হয়।

এখনও আহাদ-জাহাঙ্গীরসহ অনেকের শরীরে স্প্লিন্টার: হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গি হামলা প্রতিরোধ করতে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মো. আ. আহাদ বোমা বিস্ফোরণে গুরুত্বর আহত হন। বর্তমানে তিনি ডিএমপির উপ-কমিশনার (পাবনার পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়ন)। পুলিশের এই কর্মকর্তার শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার রয়েছে। ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অভিযানে আমাদের দুইজন কর্মকর্তা (বনানীর ওসি সালাউদ্দিন ও ডিবির এসি রবিউল) শাহাদতবরণ করেন। আমরা ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ আহত হয়েছিলাম। আমার শরীরে এখনো অসংখ্য স্প্লিন্টার রয়েছে। দেশে-বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছি তবে পুরিপূর্ণ সুস্থ হতে পারিনি। শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি। স্প্লিন্টার থাকলে কী যে কষ্ট, তা প্রতিনিয়ত অনুভব করছি।’

বর্তমানে গুলশানের এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশের তরুণ কর্মকর্তা এস এম জাহাঙ্গীর হাসান। হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার দিন তিনি সোয়েত এসি ছিলেন। খবর পেয়ে তার নেতৃত্বে একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। পরে একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণে জাহাঙ্গীরসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এখনো শরীরে স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।

(ঢাকাটাইমস/০১জুলাই/এসএস/ইএস/কেএম)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
যুবদলের মালয়েশিয়ার জহুরবারু শাখার পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশ
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আজ রুদ্ধদ্বার আলোচনা
শান্ত আছে, মিরাজ নেই: যা বললেন লিপু
আওয়ামী লীগের প্রতি সরকারের সহমর্মিতা বাড়ছে
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা