চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিদ্যানিকেতনের দুর্নীতি তদন্ত ও জড়িতদের বিচার দাবি
নগরের মনছুরাবাদে অবস্থিত গণপূর্ত বিদ্যানিকেতন। এর আশেপাশেই গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোয়ার্টার। তাদের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার সুবিধার্থে বিদ্যানিকেতনটি স্থাপন করে গণপূর্ত বিভাগ। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শ্রম ও আর্থিক সহযোগিতায় স্কুলটি সুন্দরভাবেই যাত্রা শুরু করে।
মনোরম পরিবেশে গণপূর্ত বিদ্যানিকেতন স্থাপিত হয় ১৯৯১ সালে। তবে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে প্রচুর ছাত্রছাত্রী নিয়ে সুন্দর পরিবেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে স্থানীয়দের অভিযোগ, কয়েক বছর ধরে স্কুলে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন সেখানকার গুটিকয়েক শিক্ষক। উঠেছে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ।
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা জানান, স্কুলের নানা অনিয়ম ও দুনীর্তির বিষয়ে যৌক্তিক সংস্কার ও বিদ্যালয়ের প্রশাসনসহ নানা জটিলতা নিরসনের চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হন। এ ব্যাপারে তিনি স্কুল পরিচালনা পরিষদের সভাপতির সুদৃষ্টি কামনা করেন। জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্কুল সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতরা বিগত সরকারের আমলে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে পার পেয়ে গেছে। তারা এখনো বিভিন্ন ছলচাতুরিতে লিপ্ত। যারা স্কুলের অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তারাই আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হুমকি দিয়ে স্বপদে বহাল থাকার চেষ্টায় লিপ্ত। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সহকারী শিক্ষক এ কে এম মাঈন উদ্দিন ও নুর মোহাম্মদসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে স্কুলের পরিবেশ নষ্ট ও অর্থ আত্নসাতের অভিযোগ রয়েছে। গত ১৮ মার্চ স্কুলের পরিচালনা কমিটির কার্য বিবরণী সভায় কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত-৪ এ উল্লেখ করা হয়, দুজন এমপিও শিক্ষক ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি তহবিল থেকে বেতনসহ ভাতা প্রাপ্ত হওয়ায় ওই সময়কালীন বিদ্যালয় থেকে পরিশোধিত বেতনভাতাদি মানি রশিদের মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক এ কে এম মাঈন উদ্দীনকে মোট ৪ লাখ ৪২ হাজার৯৮৬ টাকা এবং নুর মোহাম্মদকে মোট ৩ লাখ ৮ হাজার ২০৭ টাকা সর্বমোট ৭ লাখ ৫১ হাজার ১৯৩ টাকা তিন দিনের মধ্যে বিদ্যালয় তহবিলে ফেরত দান এবং এমপিওভুক্তির বকেয়া প্রাপ্তির তারিখ থেকে তাদেরকে পূর্বের নিয়মে বিদ্যালয় থেকে সম্মানী প্রদানের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়।
অভিযোগ, অর্থ আত্নসাতের ঘটনাকে ভিন্নখাতে নেওয়ার জন্য অভিযুক্ত শিক্ষকরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম দিয়ে কিছু বহিরাগত ছেলে নিয়ে এসে প্রধান শিক্ষিকাকে হুমকি দিতে থাকেন।
এ ব্যাপারে প্রধান শিক্ষিকা অভিযোগ করেন, ‘তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে স্কুলে পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী এখান থেকে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।’ তার দাবি, ‘আমরা স্কুলে শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ চাই।’ অন্যদিকে স্থানীয়দের দাবি, জেলা প্রশাসকসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন।
এ ব্যাপারে জেলা শিক্ষা অফিসার উত্তম খীসার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘স্কুলটির একটি অভিযোগের ব্যাপারে শুনেছি। তবে আমি সময় স্বল্পতার কারণে এখনো তদন্তে যেতে পারিনি। এখন চন্দনাইশে আছি। এ ব্যাপারে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
স্থানীয়রা জানান, বিভিন্ন অনিয়মের মধ্যে প্রায় ১৪ জন ছাত্রছাত্রীকে ইচ্ছাকৃত নম্বর কম দিয়ে অকৃতর্কায দেখান শিক্ষকরা, যা পুননিরীক্ষণে প্রমাণিত। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্কুলটির অভিযুক্ত শিক্ষকরা।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত শিক্ষক এ কে এম মাঈন উদ্দিন মোবাইলে ফোনে জানান, ‘ঘটনা ঠিক নয়। আপনি নিউজ করবেন না। আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবো। আমি ক্লাশে আছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সানজিদা আফরিন বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘আমি ঘটনা জানি।’ তার প্রশ্ন, ‘তাহলে কেন এতদিন স্কুলের টাকা জমা দেননি অভিযুক্ত দুই শিক্ষক? কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?’ এরপর ‘মিটিংয়ে আছি, পরে কথা হবে’ বলে তিনি ফোন কেটে দেন।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের উপ-বিদ্যালয় পরিদর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘আসলে এসব অনিয়মের ব্যাপারে স্কুল পরিচালনা পরিষদের সভাপতি চাইলে যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পারেন। যদি কেউ অভিযোগ করে আমরা অভিযোগের ভিত্তিতে অডিট করতে পারি। তবে সভাপতির এখতিয়ার আছে যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার।। তারপরও আমি এ ব্যাপারে বিদ্যালয় পরিদর্শকের সঙ্গে আলাপ করে কী করা যায় দেখব।’
সরেজমিনে কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ‘আমাদের প্রথম ভাললাগা শুরু হয় বিদ্যালয় থেকে। পরিবারের বাহিরে আমরা শিখবো স্কুলের পরিবেশ থেকে, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের থেকে, সহপাঠীদের থেকে। বিদ্যালয় স্বপ্ন তৈরির স্থান, যা স্বপ্ন দেখতে শেখায় শিক্ষার্থীদের। কীভাবে তারা জাতীয় জীবনে অবদান রাখবে, কীভাবে মানবতার সেবা করবে।’
তারা বলেন, বিদ্যালয়টির পরিবেশ হতে হবে স্থায়ীভাবে পরিপাটি। পরিচালন হবে সুশৃঙ্খল, হতে হবে ছাত্রছাত্রীদের জন্য আকর্ষণীয় শিক্ষণ পদ্ধতি ও শিক্ষা উপকরণের সমাবেশ। শিক্ষার মান হতে হবে পরিপূর্ণ, পাঠক্রমের অতিরিক্ত প্রতিভা বিকাশের অনুকূল সাংস্কৃতিক-সামাজিক কার্যক্রম থাকতে হবে। তাহলেই হতে পারে এটি একটি আদর্শ বিদ্যালয়।’
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, ‘যেখান থেকে আমাদের নীতি-নৈতিকতা শেখার কথা, সেখানেই শিক্ষকদের অনিয়ম আর দুনীর্তির চিত্র। আমরা স্কুলের অতীতের সুনাম, খ্যাতি অক্ষুণ্ন রাখতে চাই। এ ব্যাপারে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করি। যাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি হয়।’
(ঢাকাটাইমস/২৯সেপ্টেম্বর/এজে)