নয়া বিশ্ব ও নাগরিক জাতীয়তাবাদ

বাংলাদেশে গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। যদিও বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধীদলগুলো দীর্ঘ ১৭ বছর যাবৎ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছিল। কিন্তু মোক্ষম সময়টি কাজে লাগায় ছাত্র সমন্বয়করা। তাদের দাবির কারণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন। এই সরকার রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন দিতে আগ্রহী। প্রধান দল বিএনপি প্রথম দিকে এই সরকারকে সময় দিতে আগ্রহী হলেও পরবর্তীতে তাদের বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে সে বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তাদের বক্তব্য হলো- অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে একটি রোডম্যাপ ঠিক করে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
অন্যদিকে, জুলাই বিপ্লবের সমন্বয়কদের অন্যতম নেতা মাহফুজ আলম প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর পদে নিযুক্ত হয়েছেন। তাঁর একাধিক বক্তৃতায় জানা গেছে- তিনি দীর্ঘদিন ধরে পাঠচক্রের মাধ্যমে সমন্বয়কদের সংগঠিত করেছেন এবং আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিয়ে আসছেন। গত ৭ই সেপ্টেম্বর জনাব আলম তাঁর ফেসবুকের এক স্ট্যাটাসে মাজার শরীফ ও ভিন্ন মতাবলম্বিদের উপসনালয় ভাঙচুর বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন (স্ট্যাটাসটি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে)। তিনি বলেছেন, ‘জঙ্গীপনার কারণে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ১৭ বছর ক্ষমতায় থাকার যুক্তি খুঁজে পায়। বর্তমান সরকারকেও তারা প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। এদেশ বাঙালি মুসলমান প্রধান দেশ। এদেশে বিভিন্ন মতাবলম্বি ও বিভিন্ন ধর্মের মানুষ সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবে।’ মাহফুজ আরও বলছেন, সমাজে ফ্যাসিজম থাকলে রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদী হতে বাধ্য। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, এমনকি কোনো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেও ফ্যাসিবাদের জন্ম হতে পারে। এই সমন্বয়কের দাবি যৌক্তিক।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব ফ্যাসিবাদের পক্ষের একটি মাইন্ডসেট ভেঙে ফেলেছেন। তবে দুঃখের বিষয়, প্রচলিত বুদ্ধিজীবীরা জুলাই ছাত্র-নাগরিকদের বিশাল আন্দোলন ও আপামর জনগোষ্ঠীর ত্যাগের বিনিময়ে যে পরিবর্তন সংঘটিত হলো, সেটির স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছেন না। কিন্তু তারা ভেবে দেখেন না, ২০১৮ সাল থেকে জেনারেশন-জি’রা তাদের মনের কথাগুলো ২০২৪-এর জুলাই মাস জুড়ে সারা দেশের দেওয়ালে গ্রাফিতির মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। এখন প্রয়োজন তাদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন প্রদান করা।
এই সমন্বয়কেরা বিভিন্ন বক্তৃতায় বলেছেন, তারা সময়ের সন্তান। যদি তাদের আন্দোলন ব্যর্থ হয়, তাহলে জাতি আবারও ৫০ বছর পিছিয়ে যাবে। প্রয়োজনীয় শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন দেওয়া ঠিক হবে না। সেজন্য এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা দরকার, যেখানে নাগরিক হিসেবে সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে। ধর্মীয়, জাতিগোষ্ঠীগত, দলীয় ইত্যাদি পরিচয়ে বিভাজন থাকবে না। চমৎকার পরিকল্পনা।
আমরা জানি, কামারের কাজ কামারকেই করতে হয়। এদেশের নির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে আন্তরিকতার পরিচয় দিবে, তাতে বহু সন্দেহ রয়েছে। যুবকদের এই উন্মাদনার পিছনে রয়েছে সততা আর নিখাদ দেশপ্রেম। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে এর চেয়েও বেশি মাত্রায় উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল। তখন জনগণ চাঁদা তুলে বাঁশের সাঁকো, রাস্তা, স্কুল-ক্লাব ইত্যাদি নির্মাণ শুরু করেছিল। কিন্তু সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে তৎকালীন সরকার সেই উন্মাদনাকে কাজে লাগিয়ে জাতি গঠনে এবং জনগণের সকল অংশকে অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রিপাবলিকে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের ঢেউ চলছে। সে কারণে সংস্কৃতিরও পরিবর্তন ঘটেছে। নতুন প্রজন্ম বিশ্বনাগরিক হতে চায়। অর্থাৎ তারা নাগরিক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। নাগরিক জাতীয়তাবাদের ধারণা দেওয়ার আগে জাতি, জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্রের জন্ম নিয়ে কয়েকটি কথা বলা যেতে পারে।সাধারণত, আত্মপরিচয়ের ঠিকানা খুঁজতে কোনো জনগোষ্টীর মনে জাতীয়তাবোধের উদ্ভব হয়। জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ জনগোষ্ঠী যখন অন্যের অধীনতামুক্ত হয়ে নিজেরাই নিজেদের শাসন করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়, তখন এক পর্যায়ে তারা সফল হলে জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়। ইতালি, ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি প্রভৃতি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এরূপ লক্ষ করা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ধর্মীয় আত্মপরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ-উপনিবেশের মধ্যে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। এরপর ভাষার দাবিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সবশেষে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বেশি প্রাধান্য পেতে থাকলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। এই পরিস্থতিতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সংবিধান সংশোধন করে মূলত ভূখণ্ডগত পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের বিপরীতে এটিকে তাই ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ বলা যায়। বিশ্বে ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ বেশি আধুনিক। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি দেশে ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ বিদ্যমান। ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের দেশে সকল ধর্মের, সকল ভাষাভাষীর, সকল জাতিগোষ্ঠীর লোকের সমান অধিকার সংরক্ষণের ঘোষণা দেওয়া হয়।
ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদও এখন নানাভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন। বিশেষত উপনিবেশোত্তর দেশগুলিতে পরাধীনতা থেকে স্বাধীন জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা অনেক চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ। এখানে জাতিগত, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি সাধারণ জাতীয় পরিচয় তৈরি করা দুঃসাধ্য কাজ। জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতির বিভিন্ন ধারার মধ্যে বিভেদ বা বিরোধের কারণে এসব দেশে প্রায়শই রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতায় ব্যাঘাত ঘটতে দেখা যায়।
এ প্রসঙ্গে, আমরা নাগরিক জাতীয়তাবাদের মূলনীতিগুলি পর্যালোচনা করে দেখতে পারি। প্রথমত, নাগরিক জাতীয়তাবাদ তার জাতিগত প্রতিকূলতার বিপরীতে জাতিগত, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক পার্থক্য অতিক্রম করে মৌলিক বিষয়ে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক আদর্শ, প্রতিষ্ঠান এবং আইনি কাঠামো নির্মাণ করে। যেমন: সাম্য। দ্বিতীয়ত, নাগরিক জাতীয়তাবাদ প্রতিটি নাগরিকের পটভূমি নির্বিশেষে তাদের সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানবিক মর্যাদা বজায় রাখে। এটি ব্যক্তি অধিকারকে সমুন্নত রাখে। তৃতীয়ত, এটি একটি ন্যায্য সমাজের ভিত্তি হিসাবে বাক্, ধর্ম এবং সমাবেশের স্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকারগুলিকে সর্বোচ্চ বিবেচনা করে। চতুর্থত, এটি নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দেয়, সক্রিয় নাগরিকত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেয়, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করে এবং নেতাদের দায়বদ্ধ রাখে। এ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তিমূলক নাগরিকত্বের সুযোগ থাকে। পঞ্চমত, এটি সাংবিধানিক গ্যারান্টি প্রদান করে। সংবিধানে মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা সংযোজন একটি ন্যায় ও ন্যায়পরায়ণ সমাজের জন্য ভিত্তি প্রদান করে ইত্যাদি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশি ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কার করার জন্য ৬ কমিশন গঠন করেছেন।
সমন্বয়করা আন্দোলনের শুরু থেকেই রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি করে আসছেন। এটা তাদের বিজয় বলে মেনে নিতে হবে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর কেউ কেউ বলেছেন- ১৭ বছর যাবৎ তারা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে পতনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছেন। অথচ সমন্বয়করা তাদের কোনো স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছেন না (পড়ুন বাংলাদেশ প্রতিদিনে ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ প্রকাশিত মাহমুদুর রহমান মান্নার 'শেষ বিচারে রাজনীতিই সমাজের পরিচালক' শীর্ষক কলাম)। তাদের দাবি যৌক্তিক। কিন্তু ১৭ বছর সরকার বিরোধী আন্দোলনে কেউ কি বলেছেন- শাসনতন্ত্রেই ফ্যাসিবাদের বীজ লুকিয়ে আছে। তারা ভুলে যান- কলোনিয়াল দেশগুলোর শাসকরা ধাক্কা দেওয়া ছাড়া কিছু করে না। তরুণ প্রজন্ম সেই ধাক্কাটিই দিয়েছেন।লেখকবৃন্দ: গণতন্ত্রায়ন বিষয়ক গবেষক ও সিডিএলজির সদস্য

মন্তব্য করুন