বাবার সাথে মাছ ধরা শৈশব

রেজাউল মাসুদ
  প্রকাশিত : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৩
অ- অ+

বর্ষার সময় আমরা বিভিন্ন ভাবে মাছ ধরতাম। বাড়ীতে বন্ধুদের পাশাপাশি চাচাতো ভাই বোনদের সাথেও পুকুরে বিলে খালে ধানের জমিতে জাল ও হাত দিয়ে এমনকি সেচেও মাছ ধরেছি।

সেই সব জমিতে বর্ষা শুরুর সময়ে পানি উঠার পর পুটি, টেংরা, নন্দই, টাকি, কই, বোয়াল ও পুকুর থেকে ছুটে আসা নানা পদের দেশী মাছ পাওয়া যেত। অনেকেই মাছ ধরতো বিভিন্ন ধরনের জাল পেতে। কইয়া জাল, তৌরা জাল, জালি, শিবজাল, বাইর বুচুনা, ঠুই, কারেন্ট জালসহ বিভিন্ন উপায়ে মাছ ধরার মধ্যে বড়শি দিয়ে মাছ ধরাটা বেশ রোমাঞ্চকর ছিলো।

আমার বাবার মাছ ধরার প্রচুর নেশা ছিল। আব্বা মাছ ধরতেন সাথে আমি থাকতাম। বড়শি দিয়েও মাঝে মাঝে মাছ ধরেছি তবে আমার বড়শিতে খুব কমই মাছ উঠতো। আমাদের গ্রামে কোন নদী নেই। তবে গ্রামের পাশে দুদিকে দুটি বিল আছে। জলাশয় আছে অনেক আমরা যেটাকে মান্দার বলতাম। সেই সব বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত।আব্বাকে দেখতাম সেই সব জায়গায় তৌরা জাল দিয়ে মাছ মারতে। অনেকে হয়তো তৌরা জাল জিনিসটা কি জানে না। আব্বা নিজ হাতে জাল বুনতেন, এতো কিছু পারতেন যে আমি উনাকে দেখে তখন মুগ্ধ না হলেও এখন মুগ্ধ হই আর ভাবি আমি আব্বার ধারে কাছেও যেতে পারিনি।

মাছ ধরার সময় আব্বার পাশে পাশে থাকতাম এবং মাছগুলো খালোই নামে বাশের কঞ্চি সরু করে কেটে তৈরি একটি পাতিলে রাখতাম। আমাদের একটি পুরোন বাড়ি ছিলো যেখানে আমার দাদার বাবারা বাস করতেন সেখানে গাব গাছ ছিলো। বাবা সেই গাব গাছ থেকে গাব এনে কুচি কুচি করে কেটে একটি চাড়িতে রাখতেন। সেটাতে গাব গুলো পানি দিয়ে তার মাঝে জাল ভিজিয়ে কিছুক্ষণ পর উঠিয়ে রোদে শুকাতে দেওয়া হতো। এতে করে জালের সুতা গুলো মজবুত হতো।

বর্ষার শুরুতে পুইল্লা বিলের পানি কাটাখালি পুলের নিচ দিয়ে স্রোতের ন্যায় প্রবাহিত হতো। রাস্তার উপরে পাঁচ সাত জন আর পানির উপরে ব্রিজ বানিয়ে আরও কয়েকজন তৌরা জাল নিয়ে হাতের কনুইয়ে রেডি পজিশনে থাকতো। এখানে রাজ্জাক ভাইসহ আব্বাও মাছ ধরতেন। আব্বা এই এলাকার হাই স্কুলের হেডমাস্টার থাকাতে সবাই কদর করে মাছ ধরার সবচেয়ে ভালো স্পেসটা আব্বাকে দিয়ে দিত। রাজ্জাক ভাই যিনি গত বছর মারা গেছেন মাছ ধরার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় আব্বার অন্যতম সঙ্গী হতেন। কি সুন্দর দৃশ্য! বর্ষাকালে চারদিকে পানিতে থৈ থৈ; আর সবাই স্ব স্ব পজিশন থেকে যখনই মাছের উপস্থিতি টের পেত তখন সবাই একযোগে তৌরা জাল খেও মারতো। শোল, বোয়াল, সর পুটি, রুই কাতলা সহ বড় মাছগুলো এই তৌরা জালে ধরা পড়তো , সাথে সাথে মাছগুলো আমি হাত দিয়ে ধরে খালৈতে রাখতাম।

মাছ ধরতে যাচ্ছি আব্বার সাথে। আব্বার একহাতে কইয়া জাল, আরেক হাতে ছাতা দিয়ে আগলে রেখেছে আমার মাথা-যাতে কোনোভাবেই ভিজে না যাই; কিন্তু আব্বা ঠিকই ভিজে যাচ্ছে! কর্দমাক্ত মেঠোপথ! মাছের খালৈ হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে আব্বার ভেজা গেঞ্জি শক্ত মুঠোয় জড়িয়ে ধরে হাঁটছি। আমাদের পাশে একটি সবুজে ঢাকা গ্রাম আটাপাড়। গ্রামের শেষ মাথায় দক্ষিণ মোড়ে পুলের কাছে অনেকক্ষণ মাছ ধরছি। প্রায় খালৈ ভর্তি মাছ পেয়েছি।এতো মাছ পেয়ে আমি ভীষণ খুশি। হঠাৎ আব্বার দিকে নজর দিয়ে দেখলাম,শরীর সাদা হয়ে এসেছে। ঠান্ডায় কাঁপছে। শৈশবে আব্বার সাদা হয়ে আসা শরীর, কাঁপা শরীরের অর্থ কিছুই বুঝতামনা! কিন্তু এখন গভীরেই বুঝি! ফেরার পথে আব্বা ঠিক আগের মতো আমার মাথায় ছাতা ধরে হাঁটছে। বৃষ্টির ঝড়ো হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে নিজে ভিজে যাচ্ছে,তবুও আমাকে উষ্ণতায় আগলে রেখেছে।আমি বাবার ভেজা শরীর দু’হাতে ভীষণ চেপে ধরে হাঁটছি; বাবার শরীর থেকে অন্যরকম এক ভেজা ঘ্রাণ আমার শরীর জুড়ে মেখেছে। এক যুগেরও বেশী সময় আব্বা নেই, সেই ঘ্রানও নেই! অথচ চোখ বন্ধ করলে-আমার নাকে এখনো সেটার অস্তিত্ব পাই। শৈশবে আব্বাকে না বুঝলেও এখন ঠিকই বুঝি -বাবারা হয়তো এমনই। তারা সন্তানকে উষ্ণতায় আগলে রাখে সবসময় , তীব্র ঠান্ডাতে ভিজলে নিজেরাই ভিজে যায়।

লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
গণতন্ত্রের লড়াই এখনো শেষ হয়ে যায়নি: মজনু 
বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে ৩০ মিলিয়ন ডলার দেবে বিশ্বব্যাংক
বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক যানবাহন কারখানা স্থাপনে চীনের প্রতি আহ্বান পররাষ্ট্র উপদেষ্টার
এক ব্যক্তি একাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক হতে পারবেন না: ডিএমপি কমিশনার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা