বাংলাদেশের বিজয় দিবস নিয়ে মোদির মন্তব্য ‘বন্ধুত্ব’ নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলছে

বিজয়ের ৫৩তম দিবস, লাখো শহীদের আত্মত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে গর্বিত এক বাংলাদেশ। এই দিনটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই স্বাধীনতা ছিল রক্ত, ত্যাগ, আর দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল। এটি ছিল এমন এক বিজয়, যা কেবলমাত্র বাংলাদেশিদের লড়াই আর আত্মবিশ্বাসের কারণে সম্ভব হয়েছিল।
কিন্তু এবারের বিজয় দিবস যেন ভিন্ন এক মাত্রা পেয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক মন্তব্য বাংলাদেশের জনমানসে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তার বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে এবং ভারতের সেনাদের আত্মত্যাগকে প্রধান হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এমন একটি দিনে এই ধরনের মন্তব্য, যা বাংলাদেশের ইতিহাস ও গর্বকে ম্লান করার চেষ্টা করে, তা শুধু বিস্ময়কর নয়, নিন্দনীয়।
ভারতের ভূমিকা: কৃতজ্ঞতা ও সীমারেখা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯৭১ সালে এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া, সামরিক সহযোগিতা প্রদান, এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণে সহায়তা—এসবের জন্য বাংলাদেশ চিরকাল ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই যুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার লড়াই। এটি কোনোভাবেই শুধুমাত্র ভারত-পাকিস্তান সংঘাত ছিল না। ভারতের ভূমিকাকে স্বীকার করেও মুক্তিযুদ্ধের আসল আত্মত্যাগ ও নেতৃত্বকে খাটো করা মেনে নেওয়া যায় না।
মোদির মন্তব্য ও তরুণ সমাজের প্রতিক্রিয়া
মোদির বিতর্কিত পোস্টে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ ক্ষুব্ধ। তারা মুক্তিযুদ্ধকে বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখে। এই লড়াইয়ের নেতৃত্ব, পরিকল্পনা, এবং প্রাণের দানে বাংলাদেশিদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ভারতের তরুণ প্রজন্ম যদি নিজেদের ইতিহাস জানে, তবে তারাও বুঝবে যে এই বিজয়ের মূল চালিকাশক্তি ছিল বাংলাদেশি জনগণের সংগ্রাম।
তরুণরা প্রশ্ন তুলেছে, কেন ভারত এবার এমন মনোভাব প্রকাশ করল? কেন তারা এমন এক বিজয় নিজেদের বলে দাবি করল, যা মূলত বাংলাদেশিদের অর্জন? তরুণদের ধারণা, সাম্প্রতিক ‘জুলাই বিপ্লব’ এবং ভারতের আঞ্চলিক দাপটের হ্রাসের কারণে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
বন্ধুত্বের নতুন প্রশ্ন
মোদির মন্তব্যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর নতুন আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক নানা সময়ে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। তবে বর্তমান সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারিত্ব বলা হলেও, এর মধ্যে নানা স্বার্থের টানাপোড়েন বিদ্যমান।
বহুদিন ধরে বলা হয়, ভারত বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র। কিন্তু মোদির মন্তব্য এই বন্ধুত্ব নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলছে। এর আগেও সীমান্তে হত্যা, পানির ন্যায্য হিস্যা না দেওয়া, এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের বৈষম্য নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
সরকারের করণীয়
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সরকারের নীরব থাকা উচিত নয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতের এমন মন্তব্যের নিন্দা জানানো উচিত। সরকারের উচিত কূটনৈতিক পথে বিষয়টি তুলে ধরা এবং মোদির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনার দাবি করা। যদি ভারত এই ধরনের মন্তব্যের জন্য কোনো দুঃখপ্রকাশ না করে, তবে ভবিষ্যতে দুদেশের সম্পর্ক আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
উপসংহার
বাংলাদেশের বিজয় এক অনন্য ইতিহাস। এটি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় আসেনি; এটি এসেছে বাংলাদেশি জনগণের আত্মত্যাগ, সংগ্রাম এবং অনুপ্রেরণার মাধ্যমে। ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী এবং কৃতজ্ঞতার জায়গায় আমাদের তাদের সহযোগিতাকে স্মরণ করা উচিত।
কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ, বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এই ক্ষোভ দূর করতে হলে ভারতের উচিত নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে সম্মান জানানো।
মরিয়ম ইসলাম শাওলী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী

মন্তব্য করুন