ফেনীর রাজত্ব নিয়ে দুই হাজারীর দ্বন্দ্ব

হাজারী। শুধু এই একটা শব্দ বললেই সারা দেশের মানুষ একজনকেই চেনেন, তিনি জয়নাল হাজারী। ফেনীতে রাজত্ব করেছেন গত শতাব্দীর গোটা নব্বই দশক। ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা, একাধিকবারের সংসদ সদস্য।
তবে গেল ১৫ বছরে এই জয়নাল হাজারীকে পেছনে ফেলে ফেনীর দখল নেন তারই এক সময়ের শিষ্য নিজাম হাজারী। এমনকি এই নিজাম হাজারীর ভয়ে ২০০৯ সালের পর নিজের বাড়িতেও যেতে ভয় পেতেন তারই গুরু জয়নাল হাজারী।
এক সময় সমুদ্রপথে আসা চোরাচালানের পণ্য স্থলপথে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য জেলায় পৌঁছে দেয়ার অন্যতম রুট ছিলো ফেনী। ব্যবসা-বাণিজ্যের বেশ প্রসারও ছিলো ফেনীতে। এখনও মুরুব্বীরা বলেন, ফেনীতে কাঁচা টাকা উড়তো। চোরাচালানের বখরা আর ব্যবসা-বাণিজ্যের উড়ন্ত কাঁচা টাকায় ভাগ বসাতেই ফেনীকে কব্জায় রাখার চেষ্টা করতেন এখানকার পেশীশক্তি নির্ভর রাজনীতিবিদরা।
জয়নাল হাজারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনবার, ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে। তবে জাতীয় র্পযায়ে আলোচনায় আসতে শুরু করেন ১৯৯১ সালে এমপি হওয়ার পর থেকে। তখন বিএনপি ক্ষমতায় এলেও ফেনীতে নিজের রাজত্ব কায়েম করতে গড়ে তুলেছিলেন স্টিয়ারিং কমিটি। এদের কাজ ছিলো কোথাও কেউ যেনো জয়নাল হাজারীর বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেই ব্যবস্থা করা। কোনো ব্যবসায়ী চাঁদা দিতে না চাইলে তাকে ঠান্ডা করে দেওয়া। কোনো ঠিকাদার জয়নাল হাজারীর ঠিক করে দেয়া কমিশন না দিলে তাকে সাইজ করা। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার মত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জয়নাল হাজারীর অনুগতদের জয় নিশ্চিত করা। জয়নাল হাজারীর এই স্টিয়ারিং কমিটির অন্যতম নেতা ছিলেন তারই ফুপাতো ভাই নিজাম উদ্দনি হাজারী। যার কথা বলবো একটু পরে।
১৯৯৬ সালে দ্বিতীয় দফা এমপি হয়ে জয়নাল হাজারীর ত্রাস আরো ভয়াবহ হয়ে ও্ঠে। সন্ত্রাসের পাশাপাশি কখনো কখনো তার বিচিত্র কর্মকাণ্ডও তাকে সারাদেশে আলোচতি করে তোলে। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় তখন একবার ঢাকা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে রোড মার্চ করেছিলেন তখনকার সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। রাজধানী থেকে বের হওয়ার মুখেই বেগম জিয়ার গাড়িবহর আটকে দেয় আওয়ামী লীগেরই আরেক আলোচিত নেতা নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান। তখন ফেনীতে বেগম জিয়ার রোড মার্চে অংশ নেয়াদের জন্য রাস্তায় পানি নিয়ে অপেক্ষা করেন জয়নাল হাজারী।
তবে সেই লোক-দেখানো কাজের পাশাপাশি জয়নাল হাজারীর দুর্বৃত্তপনাও থেমে থাকেনি। সেই দুর্বৃত্তপনার কারণেই ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জয়নাল হাজারীর বাড়িতে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান জয়নাল হাজারী। সেবার সংসদ সদস্যও হতে পারেননি জয়নাল হাজারী, ফেনী সদরের সেই আসনটি চলে যায় বিএনপির হাতে। এরপর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তার অনুপস্থিতিতে ৫টি মামলায় তাকে ৬০ বছররে কারাদণ্ড দেন আদালত। অবশ্য তার আগেই সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডের দায়ে তাকে বহস্কিার করে আওয়ামী লীগ।
তখন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ধীরে ধীরে নিজের কব্জায় নিতে শুরু করেন নিজাম হাজারী। তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিলো চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাধ্যমে। তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জয়নাল হাজারীর স্টিয়ারিং কমিটির নেতা হিসাবে ফেনীতে রাজনীতি শুরু করনে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে নিজাম হাজারী হন ফেনী পৌরসভার মেয়র। তখন জয়নাল হাজারী ভারত থেকে দেশে ফিরলেও ফেনতে আর আগের মতো ঠাঁই পাননি। কারণ ততোদিনে নিজাম হাজারী হয়ে উঠছেনে ফেনীর নতুন রাজা। পুরনো কাউকে সেই রাজত্বের ভাগ দিতে রাজি হননি তিনি। এক র্পযায়ে দুই হাজারীর দ্বন্দ্ব এমনই চরমে ওঠে যে, ফেনীতে জীবনাশঙ্কা দেখা দেয়ায় রাজধানীতে বসবাস করতে থাকনে জয়নাল হাজারী। অনকে কাঠখড় পুড়িয়ে আবারো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামণ্ডলীতে জায়গা করে নিতে পারলেও নিজাম হাজারীর ভয়ে আর ফেনীতে ফিরতে পারেননি। ২০২১ সালে ঢাকাতেই একটি হাসপাতালে মারা যান জয়নাল হাজারী।
পৌর মেয়র হিসাবে শুরু করলেও দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে টানা তিনবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন নিজাম হাজারী। গুরুর কাছে শেখা পথেই হয়ে ওঠেন ফেনীর নতুন রাজা। প্রতিপক্ষকে হত্যার মতো ঘটনার পাশাপাশি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির পাশাপাশি বেআইনি অস্ত্র ব্যবসাতেও জড়িয়ে পড়ে নিজাম হাজারীর নাম। জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসায় নেমে সেখানেও হয়ে ওঠেন মাফিয়া। তবে দুর্বৃত্তদের রাজত্ব কখনো চিরস্থায়ী হয় না। গেলো ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতে পানিয়ে যান নিজাম হাজারী।
(ঢাকাটাইমস/২৪জানুয়ারি/আরবি)

মন্তব্য করুন