ভারত-পাকিস্তান যতবার যুদ্ধে জড়িয়েছে

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কাশ্মীর অঞ্চল। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই ভূখণ্ড নিয়ে দুটি যুদ্ধ করেছে। দুই দেশই এই অঞ্চলের পুরোটা নিজেদের দাবি করে, তবে নিয়ন্ত্রণ করে আংশিকভাবে। চীনও এই অঞ্চলের কিছু অংশে শাসন পরিচালনা করে এবং এটি বিশ্বের অন্যতম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সামরিকায়িত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
১ম সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে কাশ্মীর অঞ্চল হিন্দুধর্ম ও পরে বৌদ্ধধর্মের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে, পরে নবম শতাব্দীতে কাশ্মীর শাইভিবাদের উত্থান ঘটে। ১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলমান শাসক হন এবং সালতিন-ই-কাশ্মীর বা শাহ মীর রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। কাশ্মীর ১৫৮৬ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ ছিল এবং পরে ১৮২০ সাল পর্যন্ত আফগান দুররানি সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। এই বছর রঞ্জিত সিঙের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মীর দখল করে। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে শিখরা পরাজিত হয় এবং জম্মুর রাজা গুলাব সিং অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশদের কাছ থেকে এই অঞ্চল ক্রয় করে কাশ্মীরের নতুন শাসক হন। তার উত্তরসূরিরা ব্রিটিশদের অধীনে এই অঞ্চলের শাসন করে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পূর্ব পর্যন্ত। ভারত বিভাজনের পর সাবেক ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের এই রাজ্যটি অমীমাংসিত অঞ্চলে পরিণত হয় এবং বর্তমানে এটি তিনটি দেশ কর্তৃক শাসিত হচ্ছে, দেশ তিনটি হল ভারত, পাকিস্তান ও চীন।
ভারতের জম্মু-কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ভারত-পাকিস্তান দুদেশের সম্পর্কে আগুন লেগেছে আবার নতুন করে।
পাকিস্তান ভূখণ্ডে বুধবার (৭ মে) ভোর রাতে হামলা চালিয়েছে ভারত। এ ঘটনার পর পারমাণবিক ক্ষমতাধর দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে চলা উত্তেজনায় পারদ আরও চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হামলা নতুন কিছু নয়। এর আগেও দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশ দুটি একাধিক বার হামলায় জড়িয়েছে। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেলেও হামলা থামেনি। জেনে নিন কোন কোন সালে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়েছে-
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মূলত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। আর ভারত গঠিত হয় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে।
হিন্দু মুসলিম বিভাজনের কারণে দুই দেশে ব্যাপক রক্তপাত ঘটে। এতে প্রায় এক থেকে দেড় কোটি মানুষ তাদের বাসস্থান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় এবং ১০ লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়।
পাকিস্তানের হামলায় ভূপাতিত ভারতীয় পাঁচ যুদ্ধবিমানের পাইলটদের নিয়ে যা জানা যাচ্ছে
জরুরি বৈঠকে পাকিস্তান, ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে পাল্টা পদক্ষেপের নির্দেশ
ওই সময়ে কাশ্মীর রাজ্যটি ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেওয়া নিয়ে দ্বিধায় ছিল। এই অনিশ্চয়তা থেকেই উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ সালে ভারত-পাকিস্তান এ নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে জাতিসংঘের সমর্থনে ৭৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি যুদ্ধবিরতি রেখা স্থাপন করা হয়, যা কাশ্মীরকে বিভক্ত করে।
এই যুদ্ধবিরতি রেখা পরবর্তীতে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ নামে পরিচিত হয়। যা নিয়ে আজও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। উভয় দেশই কাশ্মীরকে সম্পূর্ণ অংশের দাবি করে, যদিও বর্তমানে দুই দেশই কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।
১৯৬৫ সালে কাশ্মীর যুদ্ধ
ভারত অবৈধভাবে কাশ্মীর দখল করেছে এই অভিযোগে ১৯৬৫ সালের আগস্টে পাকিস্তান দ্বিতীয়বার সেখানে হামলা চালায়। এতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। পরবর্তীতে সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে যুদ্ধ
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যা বর্তমানে বাংলাদেশ নামে পরিচিতি। ওই সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার লক্ষ্যে দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষোভ দমাতে পাকিস্তান হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েন করে। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ভার ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ নামকরণ হয়।
ওই যুদ্ধে ৩০ লাখের বেশি মানুষ শহিদ হয়েছে। নয় মাস ধরে চলা ওই যুদ্ধ হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। সে সময়ে ভারতের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
১৯৮৯-৯০ কাশ্মীর যুদ্ধ
১৯৮৯ সালে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এক গণবিদ্রোহ শুরু হয়, যখন বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে। পরবর্তী কয়েক দশকে বহু সেনা, স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা ও সাধারণ নাগরিক নিহত হন। এর জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদেরকে অর্থায়ন ও অস্ত্র প্রশিক্ষণের অভিযোগ তুলে ভারত।
১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধ
ওই সময়ে পাকিস্তান কারগিল পর্বতের বরফাচ্ছন্ন উচ্চভূমিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকটি ঘাঁটি দখল করে নেয়।
তবে সংঘাত এলাকায় পারমাণবিক অস্ত্রের অংশ মোতায়েনের গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর, যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর চাপের মুখে পাকিস্তান পিছু হটে। সে সময়ে ১০ সপ্তাহব্যাপী সংঘাতে অন্তত ১ হাজার মানুষ নিহত হয়।
২০১৯ সালে কাশ্মীর সংঘাত
২০১৯ সালে ভারতের পুলওয়ামাতে এক ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ৪০ জন নিহত হয়। ওই সময়ে জাতীয় নির্বাচনের প্রচারণায় ব্যস্ত থাকা ভারত যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা চালায়। এতে পাকিস্তান ভারতের একটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করে এবং ভারতীয় বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার অভিনন্দনকে আটক করে। পরবর্তীতে ওই সদস্যকে ফেরত দেয় পাকিস্তান।
২০২৫ ভারত–পাকিস্তান সীমান্তে কাশ্মীরে সংঘর্ষ
২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল, পহেলগামে একটি মারাত্মক সন্ত্রাসী হামলা ঘটে, যাতে ২৬ জন পর্যটক নিহত হন। ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার পর এটি ছিল ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের উপর সবচেয়ে মারাত্মক আক্রমণ। সবশেষ ভারত শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে হামলার পর দেশ দুইটির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পহেলগামে ২৬ পর্যটককে হত্যার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে বিমান হামলা চালালো ভারত। এতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নিহত বেড়ে ২৬ জনে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে হামলার সময় ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছে।
কাশ্মীরের বিভাজনরেখা নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলওসি) একটি সামরিক চৌকিতে ‘সাদা পতাকা’ উত্তোলন করে পালিয়েছে ভারতীয় সেনারা—এমন দাবি করেছে পাকিস্তান। আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত এই সাদা পতাকা তোলার ঘটনা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান এই উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উভয় দেশেরই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। আন্তর্জাতিক মহলও দুই দেশকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/৮ মে/আরজেড)

মন্তব্য করুন