শিক্ষার্থীদের নিয়ে পলিটিক্স শিক্ষকদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছে: অধ্যাপক নাজনীন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন। শিক্ষার্থীবান্ধব হিসেবে সমাদৃত এই অধ্যাপক সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে ঢাকা টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন অধ্যাপক নাজনীন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি শেখ শাকিল হোসেন।
ঢাকা টাইমস: বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় দেশের একমাত্র দূরশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি আপনি বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ে আপনার পরিকল্পনা জানতে চাইছি।
অধ্যাপক নাজনীন: ইতোমধ্যে উপাচার্য, আরেকজন উপ-উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার সঙ্গে আমরা বসেছি। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বিগত ১৬ বছরে অনেক অনিয়ম হয়েছে। পড়াশোনাটাও অনেকটা অবহেলিত ছিল। আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করব। যারা অবহেলিত ছিলেন, তাদের সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায়, সেটি আমরা দেখব। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু স্টাডি সেন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। কী কারণে বন্ধ হলো, সেগুলো আবার কীভাবে চালু করা যায়, তা আমরা দেখব। আমাদের পরিকল্পনা হলো, যে উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই লক্ষ্যে অর্থাৎ দূরশিক্ষণে আমরা এগিয়ে যাব।
ঢাকা টাইমস: আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দূরশিক্ষণ কতটা ফলপ্রসূ?
অধ্যাপক নাজনীন: আমাদের মতো দেশেই এটি বেশি দরকার। কারণ, দেশের প্রান্তিক মানুষেরা একটা পর্যায়ে শিক্ষা থেকে ঝরে যায় কিংবা বঞ্চিত হয়। তারা কাজে ঢুকে যেতে বাধ্য হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের মনে হয়, সুযোগ পেলে পড়তে পারতেন। ওই সুযোগটাই দেয় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। একদম এসএসসি থেকে পিএইচডি পর্যন্ত। যারা পড়াশোনা থেকে ঝরে গেছে, তারা যখন আবার পড়তে চায়, তখন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে পড়াশোনা শুরু করতে পারে।
ঢাকা টাইমস: দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় কি দূরশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করতে পারে?
অধ্যাপক নাজনীন: ওপেন ইউনিভার্সিটি একটি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই আছে। পাকিস্তানে আছে, ইন্ডিয়াতে আছে, চীনে আছে, আরও অনেক দেশে আছে। এর পাঠদান প্রক্রিয়া ভিন্ন। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আমাদের অনেকগুলো স্টাডি সেন্টার আছে। এসব সেন্টারে শুক্র-শনিবারে পড়ানো হয়। কর্মজীবীরা সারা সপ্তাহ কাজ করে শুক্র-শনিবারে ক্লাস করেন। এটি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সম্ভব হবে না। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সারা সপ্তাহ অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালায় এবং শুক্র-শনিবার ছুটি থাকে। ছুটির দিনে অনেকে কাজ করতে চাইবে না।
ঢাকা টাইমস: উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি, এমনকি সনদ জালিয়াতির মতো ঘটনার অভিযোগ রয়েছে।
অধ্যাপক নাজনীন: সনদ জালিয়াতির ঘটনায় ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি হয়েছে। কারা কারা জড়িত আমরা সেটি খুঁজছি। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভবিষ্যতে যাতে কেউ এসব না করতে পারে সেজন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেটিও দেখব।
ঢাকা টাইমস: উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন ক্যাম্পাসের পরিধি বাড়ানোর দাবি রয়েছে। এ বিষয়ে কী ভাবছেন?
অধ্যাপক নাজনীন: উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অন ক্যাম্পাস কার্যক্রম ছিল না। এটি বিগত প্রশাসনের একটি অগোছালো পদক্ষেপ। তখন কয়েকটা ক্লাসরুম করে শুধু একটি ডিপার্টমেন্টকে অন ক্যাম্পাসে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালানোর ব্যবস্থা করা হয়। এখন সবাই অন ক্যাম্পাস কার্যক্রম চায়। কিন্তু, এখানে এ ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। যেহেতু দাবি উঠেছে, আমাদের পরবর্তী বোর্ড অব গভার্নেন্সে এ বিষয়ে আলোচনা তুলব। সবাই সম্মতি দিলে আমাদের অন্তত একটি ছেলেদের হল এবং একটি মেয়েদের হল তৈরির চিন্তাভাবনা আছে। ক্লাসরুমও তৈরি করতে হবে। এসব বিষয় চিন্তাভাবনার পর্যায়ে আছে, এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
ঢাকা টাইমস: আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৭ সাল থেকে শিক্ষকতা করছেন। ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের দাবি দীর্ঘদিনের। এ বিষয়ে আপনার মূল্যয়ন কী?
অধ্যাপক নাজনীন: এ বিষয়ে আমার ভিন্নমত আছে। রাজনীতি প্রত্যেকের অধিকার। এখন আমি আমার অধিকার ছাড়ব কেন? নেতিবাচক রাজনীতি না করলেই হলো। রাজনীতিটা ইতিবাচক হলে তো কোনো সমস্যা নেই।
ঢাকা টাইমস: শিক্ষার্থীরা কীভাবে শুদ্ধ রাজনীতির চর্চা করতে পারে? অধ্যাপক নাজনীন: শিক্ষার্থীদের যেটা শেখানো হবে, ওরা সেটাই শিখবে। ওদের নেতিবাচক জিনিস না শেখালে ওরা সেগুলো শিখবে না। ওদের ভালো জিনিস শেখাতে হবে। তাহলে আর কোনো ঝামেলা হবে না।
ঢাকা টাইমস: জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকালীন ও অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এই দূরত্ব উত্তরণে কী করা উচিত?
অধ্যাপক নাজনীন: যে শিক্ষকরা বেশি ‘পলিটিক্স’ করে, শিক্ষার্থীদের সাথে পলিটিক্স করে, তাদের সাথে দূরত্ব তৈরি হবেই। শিক্ষকদের তো শিক্ষার্থীদের নিয়ে পলিটিক্স করা উচিত না। তারা আমাদের সন্তানতুল্য। আমার ৩৮ বছরের শিক্ষকতা জীবনে শিক্ষার্থীদের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়নি। যারা ছাত্রদের ব্যবহার করেছেন বা করতে চেয়েছেন, তাদের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাদের অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। ছাত্রদের সাথে এমন কিছু করা যাবে না, যাতে ওরা আহত হয়। আঘাত করলে আঘাত ফিরে আসবেই।
ঢাকা টাইমস: জুলাই-আগস্ট বিপ্লবোত্তর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কী?
অধ্যাপক নাজনীন: আমি সব সময়ই শিক্ষার্থীদের মন দিয়ে পড়াশোনা করতে বলি। পড়াশোনাটাই আলটিমেটলি কাজে লাগে। এটি একটি পরামর্শ। দ্বিতীয় পরামর্শটি হলো, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পরে এখনকার যে পরিবেশ, এখন অনেক ধরনের চিন্তাভাবনা-আচরণ দেখা যাচ্ছে। আমি শুধু বলি, সবকিছুই হবে, শুধু ধৈর্য ধরতে হবে। ধৈর্য ধরলে ধীরে ধীরে সবকিছু হবে। পড়াশোনায় মন দিতে হবে এবং ধৈর্য ধরতে হবে।
ঢাকাটাইমস: আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক নাজনীন: ঢাকা টাইমসকেও ধন্যবাদ।
(ঢাকাটাইমস/২২নভেম্বর/মোআ)
মন্তব্য করুন