ত্রাণ নিতে আসা ৯২ ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করল ইসরায়েল, অনাহারে মৃত্যু ১৯

গাজা উপত্যকায় দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে আরও এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। রবিবার (২০ জুলাই) বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১১৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু উত্তর গাজার জিকিম ক্রসিং, রাফাহ ও খান ইউনিসে ত্রাণের জন্য জড়ো হওয়া ৯২ জনকে গুলি করে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সেনারা। একই দিনে অনাহারে মারা গেছেন আরও ১৯ ফিলিস্তিনি। খবর আল জাজিরার।
আল জাজিরার খবরে বলা হয়, গাজার মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। অবরোধে খাদ্য সংকট চরমে পৌঁছেছে। উত্তরাঞ্চলের জিকিম ক্রসিংয়ে জাতিসংঘের ত্রাণবাহী ট্রাক থেকে সামান্য আটা পাওয়ার আশায় হাজারো মানুষ জড়ো হলে ইসরায়েলি বাহিনী সেখানে গুলি চালায়। এতে ৭৯ জন নিহত হন বলে জানিয়েছে চিকিৎসা সূত্র।
রাফাহর একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে ৯ জন এবং খান ইউনিসের অপর এক কেন্দ্রে আরও ৪ জনকে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী। রাফাহর ঘটনায় একদিন আগেই একই স্থানে ৩৬ জন নিহত হয়েছিলেন।
জিকিমে হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া ফিলিস্তিনি রিজেক বেতার বলেন, “এক তরুণকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। সাইকেলে করে আমরা তাকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু কোথাও কিছু নেই—না আছে অ্যাম্বুলেন্স, না আছে খাবার, না আছে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা। জীবন বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই।”
আরেক ফিলিস্তিনি ওসামা মারুফ বলেন, “এই বৃদ্ধ মানুষটা শুধু একমুঠো আটা নিতে এসেছিলেন। আমি সাইকেলে করে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করি। এখন আমার আর আটার প্রয়োজন নেই—এই মানুষটা আমার বাবার মতো। আল্লাহ যেন আমাদের সহ্যশক্তি দেন।”
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এ ঘটনায় ‘তাৎক্ষণিক হুমকি’ প্রতিরোধে সতর্কতামূলক গুলি চালানোর দাবি করলেও কোনো প্রমাণ দেয়নি। হতাহতের সংখ্যাও তারা স্বীকার করেনি।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ইসরায়েলের বক্তব্য নাকচ করে বলেছে, নিহতরা সবাই ত্রাণের আশায় আসা সাধারণ মানুষ। সংস্থাটি জানায়, ২৫টি ত্রাণবাহী ট্রাক জিকিম পয়েন্ট অতিক্রম করার পরপরই সেগুলোর সামনে ভিড় করা জনতার ওপর ইসরায়েলি ট্যাংক, স্নাইপার ও অন্যান্য অস্ত্র থেকে গুলি চালানো হয়।
ডব্লিউএফপি আরও জানায়, ইসরায়েল আগেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, মানবিক সংস্থাগুলোর সহায়তার পথকে নিরাপদ রাখা হবে। বাস্তবে হচ্ছে উল্টো।
সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, “গাজায় ক্ষুধার্ত মানুষের অবস্থা চরমে পৌঁছেছে। প্রতিদিন মানুষ খাদ্যাভাবে মারা যাচ্ছে। ৯০ হাজার নারী ও শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। তিনজনের মধ্যে একজন দিনের পর দিন না খেয়ে থাকছে।”
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, রবিবার অনাহারে ১৯ ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। আরও শত শত অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ খুব শিগগিরই মৃত্যুর মুখে পড়তে পারেন।
মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, “শরীর ক্ষয়ে যাওয়া শত শত মানুষ এখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।” তিনি জানান, ২০২৩ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অপুষ্টিতে অন্তত ৭১ শিশু মারা গেছে এবং আরও ৬০ হাজার শিশু চরম অপুষ্টির লক্ষণ দেখাচ্ছে।
আল জাজিরার হিন্দ খুদারি গাজার কেন্দ্রীয় এলাকা থেকে জানান, গাজা শহরে ৩৫ দিন বয়সী এক শিশু এবং দেইর আল-বালাহ এলাকায় চার মাস বয়সী আরেক শিশু অপুষ্টিতে মারা গেছে।
খুদারি বলেন, “এক মা তার মৃত শিশুর দেহ ছুঁয়ে বলছিলেন, ‘তোমায় খাওয়াতে পারিনি বলে দুঃখিত।’ আরেক মা আমাদের জানান, তিনি শুধু পানি খাইয়ে সন্তানদের পেট ভরাচ্ছেন। কারণ আটা কেনার সামর্থ্য নেই, আর পেলেও তা পাওয়া যাচ্ছে না।”
গাজার বাজারগুলোতে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চরম সংকট চলছে। নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী। ২৩ লাখ মানুষের জন্য দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদা মেটানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের প্রধান ইয়ান এগেল্যান্ড বলেন, “গত ১৪২ দিনে আমরা একটি ট্রাকও গাজায় প্রবেশ করাতে পারিনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু নেতা বলছেন সহায়তা স্বাভাবিক হচ্ছে—তা বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না।”
জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানিয়েছে, তারা মিসরের সীমান্তে গাজার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রেখেছে। কিন্তু ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞার কারণে তা প্রবেশ করতে পারছে না। সংস্থাটি বলছে, “সীমান্ত খুলুন, অবরোধ তুলে নিন এবং আমাদের কাজ করতে দিন।”
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের একজন শীর্ষ নেতা রয়টার্সকে বলেন, “ইসরায়েলের হত্যাকাণ্ড ও খাদ্য সংকট ফিলিস্তিনিদের ক্ষুব্ধ করে তুলছে। এসব ঘটনা কাতারে চলমান যুদ্ধবিরতির আলোচনাকেও প্রভাবিত করতে পারে।”
(ঢাকাটাইমস/২১ জুলাই/আরজেড)

মন্তব্য করুন