অন্ধকার সময়ে পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ: প্রধান উপদেষ্টা

বাংলাদেশের জনগণ গত বছরের জুলাই-আগস্টে সাহসিকতার সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং নিজেদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। তিনি বাংলাদেশের অন্ধকার সময়ে পাশে থাকার জন্য জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) বিকেলে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জাতিসংঘ আয়োজিত ‘জুলাই বিপ্লব ও অনুসন্ধান প্রতিবেদন’ বিষয়ক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন উপদেষ্টা।
এ সময় প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের সহায়তা ও সংহতির জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের সংস্কার ও দায়বদ্ধতার কথা তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আজ আমরা এক গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষে একত্রিত হয়েছি—জুলাই বিদ্রোহের প্রথম বার্ষিকী। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যখন লাখো বাংলাদেশি নারী ও পুরুষ, যাদের অধিকাংশই তরুণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজেদের মর্যাদা ও ভবিষ্যৎ পুনরুদ্ধার করেছিল। তাদের সাহস কেবল বাংলাদেশের পক্ষেই কথা বলেনি, বলেছে গোটা মানবতার পক্ষেও।’
এই স্মরণীয় দিনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বিশেষ করে জাতিসংঘের প্রতি, যারা সব সময় বাংলাদেশের পাশে থেকেছে—স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, রোহিঙ্গা সংকটে, এবং গত বছরের জুলাই-অগাস্টের অন্ধকার সময়েও। ‘
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, জাতিসংঘ মানবজাতির অবিচ্ছেদ্য অধিকারকে সংজ্ঞায়িত ও রক্ষা করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়—যা জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা অবস্থান নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। সেই ভিত্তিতে ‘মৌলিক মানবাধিকার সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণা’ তৈরি হয়, যা আজও আমাদের বিশ্বমানবতার নৈতিক দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে। এর মূলনীতি বাংলাদেশের সংবিধানের মাঝেও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কিন্তু বিগত ষোল বছর ধরে এই অধিকারগুলো বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো জিম্মি করা হয়েছিল, স্বাধীনতাগুলো হরণ করা হয়েছিল, এবং শাসনের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছিল সহিংসতা। গত জুলাইয়ে বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে এই বাস্তবতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তারা তাদের অধিকার পুনরুদ্ধার করে স্পষ্টতা, দৃঢ়তা ও অপরিসীম সাহসিকতার সঙ্গে।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘গত বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরপরই আমি মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের হাইকমিশনার অফিসকে অনুরোধ করি যেন ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করতে একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন অনুসন্ধান মিশন পরিচালনা করা হয়। আমাদের বিশ্বাস ছিল, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য সত্য উদঘাটন কেবল ন্যায়ের জন্য নয়, জাতির আরোগ্য প্রক্রিয়ার জন্যও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।’
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘ হাইকমিশনারের প্রতিবেদন সেই সময়ের নির্মম বাস্তবতাকে উদঘাটন করে- এ কথা উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘এতে উল্লেখ করা হয়, মাত্র কয়েক সপ্তাহে আনুমানিক ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়েছিল। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই সহিংসতা ছিল পরিকল্পিত, সংগঠিত এবং পূর্ববর্তী শাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে পরিচালিত। এতে সম্ভাব্য মানবতাবিরোধী অপরাধের ব্যাপারেও গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।’
এই প্রতিবেদনকে আরও সমর্থন করেছে আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা—বিশেষ করে বিবিসি ও আল-জাজিরার প্রতিবেদন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা কৃতজ্ঞ জাতিসংঘের হাইকমিশনার অফিসের প্রতি, যারা কেবল নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করেননি, বরং একটি সমন্বিত সুপারিশপত্রও দিয়েছেন যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন আর কখনো না ঘটে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা
এই সুপারিশগুলো অন্য কারও প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে নয়, বরং নিজের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে তার সরকার গ্রহণ করেছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা।
ড. ইউনূস বলেন, ‘সরকার গঠনের পর থেকে আমরা ব্যাপক সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করেছি এবং ‘জোরপূর্বক গুমের সকল ব্যক্তি সুরক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশন’-এ স্বাক্ষর করেছি। এ মাসের শুরুতে আমরা জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার অফিসের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছি, যার মাধ্যমে ঢাকায় একটি সহায়ক মিশন স্থাপিত হবে। এই মিশন আমাদের সংস্কার কার্যক্রমে কারিগরি সহায়তা দেবে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং সুশীল সমাজের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে—সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস, অর্থাৎ মানবাধিকার রক্ষায়।’
প্রথম দিন থেকেই জাতিসংঘ বাংলাদেশের এই রূপান্তর অভিযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিল উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি কৃতজ্ঞ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের প্রতি। তার অটল সমর্থনের জন্য, সহমর্মিতার জন্য এবং চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশ সফরের জন্য। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক, অনুসন্ধান দলের সদস্যবৃন্দ, জাতিসংঘ আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস এবং আমার বন্ধু হুমা খান যিনি জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার উপদেষ্টা।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘আমাদের কাজ এখনও শেষ হয়নি। সংস্কারের পাশাপাশি আমরা মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কাজ করছি। তবে, ন্যায়বিচার কেবল শাস্তি দেওয়ার বিষয় নয়—ন্যায়বিচার হলো এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা কখনোই আর নিজ জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না।
‘আমরা একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য জাতীয় ঐকমত্য গঠনের চেষ্টা করছি- যেখানে নির্বাচন হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য। আমাদের লক্ষ্য স্পষ্ট: এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে প্রতিটি বাংলাদেশি শান্তিতে, মর্যাদায়, স্বাধীনতায় জীবনযাপন করতে পারবেন।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আজ এক বছর পর ফিরে তাকালে আমরা তাদের কথা স্মরণ করি—যারা জীবন দিয়েছেন এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য। তাদের আত্মত্যাগ আমাদের সামনে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তারা সৃষ্টি করেছেন এক নতুন বাংলাদেশ, যেটি গঠিত হয়েছে আশার উপর, মানবাধিকারের উপর, এবং গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের উপর।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘অন্ধকার সময়ে আমাদের পাশে থাকার জন্য বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমি জাতিসংঘকে জানাই অন্তরের গভীর থেকে কৃতজ্ঞতা। এবং আমি আগামীতেও একসাথে কাজ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।’
(ঢাকাটাইমস/২৯জুলাই/মোআ)

মন্তব্য করুন