শেখের বেটির গ্রাম দেখা

শেষ কবে শেখ হাসিনা নিজ গ্রামের নিশুতি রাতের নির্জনতায় ফজরের নামায পড়ে শিশির ভেজা মেঠোপথে হেঁটেছেন; ভ্যানে ঘুরে গ্রাম দেখেছেন, মধুমতীর নৌকায় চড়েছেন, সে কথা সঠিক, দিনক্ষণ উল্লেখ করে বলা সহজ নয়। এমনই এক রাত, ভোর, সকাল দুপুর পেয়ে শুক্রবার শেখ হাসিনা সম্ভবত এক যুগ পর প্রধানমন্ত্রীত্বের পরিচয় ভুলে হয়ে উঠেছিলেন টুঙ্গিপাড়ার ‘শেখের বেটি হাসু’।
কয়েকদিন আগেই ঢাকাটাইমসের এক প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছিল শেখ হাসিনা তাঁর ছোটবোন শেখ রেহানার সাথে বরফ নিয়ে খেলছেন। সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে অর্থনৈতিক সম্মেলন শেষ করে ফিরে আসার পথে বরফে ঢাকা প্রকৃতি দেখে ছোটবোনের সাথে খেলায় মেতেছিলেন। ডাভোসের সৌন্দর্য দেখে কি শেখ হাসিনা নিজ গ্রাম টুঙ্গিপাড়াকে মিস করতে শুরু করেছিলেন? তখনই কি মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন, দেশে গিয়ে এবার গ্রামে থাকার একটা প্রোগ্রাম বানাতে হবে!
কিন্তু ১২ বছর গ্রামকে কাছে না পাওয়ার আফসোস কি এক রাতেই দূর করা সম্ভব?
যুগের প্রতীক্ষায় গ্রামকে কাছে পেয়ে ২৪ ঘণ্টায় যেন পেতে চাইলেন ফেলে আসা শৈশব, কৈশোরের সমস্ত স্মৃতির স্বাদ! গ্রামের প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলেছেন, রসের পিঠা খেয়ে মুখ ভরিয়েছেন, বিদেশে থাকা নাতিদের নিজ হাতে গ্রামের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ঢাকার সাধারণ মানুষই গ্রামে গিয়ে একটু থেকে আসার ফুরসত পান না, সেখানে তিনি তো দেশের প্রধানমন্ত্রী।
টুঙ্গিপাড়ার মুরুব্বিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কমপক্ষে ১২ বছর পর শেখ হাসিনা এভাবে গ্রামে এসে থাকলেন। বিভিন্ন দিবসে প্রধানমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে বছরে দু-চারবার আসা হলেও রাতে থাকার ঘটনা এক যুগ পরে আবার ঘটল।
বুধবার বেলা দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রী একটি হেলিকপ্টারে চড়ে টুঙ্গিপাড়া পৌঁছান। এসময় হাজারো মানুষ তাঁকে স্বাগত জানান। শেখ হাসিনা বাড়িতে থাকবেন এই আনন্দ প্রতিটি পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে। সবার মুখে মুখে শেখ হাসিনার বিষয়ক আলোচনা ঘুরে ফিরছে। বার্ধক্যে পৌঁছানো মানুষের মুখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নানা স্মৃতিচারণ।
বাবার বাড়িতে শেখ হাসিনা শীতকালীন নানা পিঠা খেয়েছেন। এর মধ্যে খেজুরের রসে ভেজানো দুধচিতই, ধুঁপি পিঠা (ভাঁপা), শুকনো চিতই পিঠা, তক্তি পিঠাসহ গোপালগঞ্জের স্থানীয় অনেক পিঠা ছিল। বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী দেশীয় বিভিন্ন মাছ দিয়ে ভাত খান। পিঠা, মাছ খাওয়ার সময় শেখ হাসিনাকে টুঙ্গিপাড়ায় কাটানো তাঁর শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে শোনা যায়। একান্ত পারিবারিক এ সফরে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আনন্দদায়ক সময় কাটান বলে জানা গেছে।
রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ সংলগ্ন পৈতৃক বাড়ির দোতলায় প্রধানমন্ত্রী নিদ্রাযাপন করেন।
বৃহস্পতিবার সকালে ভ্যানে করে প্রিয় টুঙ্গিপাড়ার পুরোটা ঘুরে দেখবেন বলে কথা থাকলেও পরে তা বাদ দেয়া হয়। তবে কিছুক্ষণ ভ্যানে চড়েন তিনি ও পরিবারের অনেকে। বেলা সাড়ে এগারোটায় গাড়িতে করে টুঙ্গিপাড়া ও বাগেরহাটকে সংযোগকারী শেখ লুৎফর রহমান সেতু দেখতে যান প্রধানমন্ত্রী। এসময় তাঁর সঙ্গে শেখ নাসেরের পুত্র ও প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই শেখ হেলাল, শেখ জুয়েল, শেখ সোহেল, ভাগ্নে ও বোন শেখ রেহানার পুত্র ববি ও তার স্ত্রীসহ শেখ পরিবারের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় ঘরের মেয়ে প্রিয় শেখের বেটিকে দেখতে এসে অনেকে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' শ্লোগানও দেয়। প্রধানমন্ত্রী তাদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে ভালবাসায় সিক্ত হন।
সেখানে উপস্থিত স্থানীয় ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নৌকার মাঝির সাথেও দরদভরা কন্ঠে কথা বলেন। নিজের শৈশবের নানা কথা এসময় পরিবারের মানুষের সাথে আলাপ করেন।’
বেলা একটার দিকে প্রধানমন্ত্রী সমাধিসৌধে পৈতৃক নিবাসে চলে আসেন। রহমত আলী নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমাগে শেখের বেটি এহন দেশের উন্নতি করতেছে। আইজকে বাড়ি আইছে তাই দেখতি আইছি’।
তবে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য অনেকেই প্রাণের ‘শেখের বেটি’কে এক নজর দেখতে পায়নি বলে অভিমান করেন। দিন শেষে বাড়িতে আসার পর প্রধানমন্ত্রীর রাত্রিযাপন নিয়ে সবাই মুগ্ধতা প্রকাশ করে। শুক্রবার বেলা চারটার পর প্রধানমন্ত্রীর রাজধানীতে ফিরে আসেন।
লেখক: সাংবাদিকতার ছাত্র, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন