মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই শুনানিতে জীবন্ত হয়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধ

সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই চলছে -এটি এখন বাসি খবর। এর মধ্যে কোনো বড় ঘটনা ঘটলে হয়তো তা খবর হিসেবে জায়গা পাবে। তা না হলে কোনো কোনো খবর ভ্যালু নাই।
কিন্তু রিপোর্টার হিসেবে আমার কাছে এ ঘটনাটিকে অসাধারণ মনে হয়। আমি সকাল ১০ টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত বসে থাকি যাচাই বাছাই কমিটির সামনে, পর্যবেক্ষকের সারিতে। সারাটা দিন আমাকে চুম্বকের মতো টানে প্রতিটি ব্যাক্তিকে যাচাইয়ের ঘটনা। পর্দা উন্মোচিত হয় কুড়িগ্রাম অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের।
কত অজানা যুদ্ধের ঘটনা, একজন সাধারণ নিরক্ষর কৃষক কীভাবে একজন লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠেন। একজন স্কুল পড়–য়া ছাত্র কীভাবে সাত দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে ১০ জন রাজাকারকে মেরে ফেলার অপরেশনে নেতৃত্ব দেন।
কত জায়গার নাম যে জানলাম! যে জায়গাগুলোতে ছিলো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় পদচারণা। আসামের মাইনক্যার চর, কাকড়িমারী, কোচবিহারের দিনহাটা, আটিয়াবাড়ি, চৌধুরিহাট; দার্জিলিং।
এই শুনানিতেই জেনেছি কুড়িগ্রামের উলিপুরের দলদলিয়ায় বিএলএফের (মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট) লড়াই। আরও জেনেছি চিলমারীর বালাবাড়ী ব্রিজ অপরেশন, যতিনেরহাট ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া, উলিপুর ডাকবাংলো অপরেশন। চাঁন কোম্পানি, থারটি সিক্স গ্রেনেড, কীভাবে তা ছুড়ে মারে। স্টেনগান কীভাবে খোলে, এসএলআর এর পুরা নাম কী- কী করে সেলফ লোড হয়। ‘খোলনা-জোরনা-গিরনা.....।
যাচাই-বাছাই প্রতিদিনই আমার কাছে এক একটি গুলির লড়াই, আমি যেনো সেই দিনগুলোতে নিজেকে খুঁজে পাই।
ভারতের তৎকালীন পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাট শহর। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আমরা এখানে এসেছি। অক্টোবরের শুরুতে এলো আবার এক ভয়ঙ্কর রাত। সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় এই শহরে পাকিস্তানি সেনাদের ছোঁড়া বিকট শব্দে কামানের গোলা এসে পড়তে শুরু করলো। কালো রাত পেড়িয়ে সকাল হয়। গোটা শহরে তখন কান্নার রোল। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়িতে কামানের গোলা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে।
দীডপালীনগর নামের এক জায়গায় গিয়ে দেখলাম, একটা বাড়ির ছাদে খামানের গোলা পড়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। একই পরিবারের ঘুমন্ত ১০ জন মারা গেছেন। ওখান থেকে এসে মোক্তারপাড়া রোডে দেখলাম, এক বাড়ির তিনজন মারা গেছেন। ওইদিন ওই শহরে মারা গেছে ২০ জন সাধারণ মানুষ।
বাড়ি বাড়ি বাংকার খোড়া হলো। এরপর প্রতিরাতে কামানের গোলার বাতাস কেটে আসার শিস দেয়া শব্দে আমরা বাংকারের ভিতরে রাত কাটাতাম। তারপর দিনেও গোলা পড়তে শুরু করলো। মানুষজন শহর ছেড়ে পালালো।
মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতাম, প্রতিদিন যুদ্ধ শেষে দল বেঁধে শহরে ঢুকতেন। শহরের একটা বাড়িতে ছিলো ওদের ক্যাম্প। আমি ওদের পিছু নিতাম। দেখতাম, সেই বাড়ির সামনে একটা জামগাছ ছিলো। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই অস্ত্রগুলো সেই জামগাছের গোড়ায় ঠেস দিয়ে খারা করে রাখতেন। তারপর সামনে পুকুরে লাফদিয়ে গোসলে নামতেন।
নভেম্বরের শুরুতে একদিন দেখলাম, পাকিস্তানি একটা ট্যাংক ভারতীয় সেনারা দখল করে এনে শহরের প্রবেশ মুখে বসিয়ে দিলেন। এটা তারা উপহার দিলেন পাকিস্তানি কামানের গোলায় নিহত বালুরঘাটের নিহতদের স্মরণে।
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ট্রাক ভর্তি পাকিস্তানি বন্দি সেনাদের নিয়ে আসতে শুরু করলো যৌথ বাহিনী। তাদের গলায় ফুলের মালা। ভারতীয় সেনাদের কন্ঠে সেদিন শ্লোগান শুনে ছিলাম, ‘শেখ মুজিব কি- জয়, ইন্দিরা গান্ধি কি- জয়’। আমরা উল্লাস করছিলাম ‘বাকসো বোমার’ চকলেট বোম’ ফুটিয়ে।
শরণার্থী শিবিরে কাদায় দাঁড়িয়ে খালি মাটির সানকি হাতে খাদ্যের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকার দিন শেষ হলো। এরপর একদিন জাতিসংঘের সাদা রঙয়ের ট্রাকে জয় বাংলা শ্লোগানে কাঁপিয়ে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে স্বাধীন দেশে বাড়ি ফিরে আসি।
লেখক: সাংবাদিক

মন্তব্য করুন