তাৎক্ষণিক
কৈলাসের সত্যভাষণ, পণ্ডিতমশাই এবং তালেব মাস্টার

প্রাথমিকে, মাধ্যমিকে অনেক কিছুই পড়তে হয়েছে। ভালো ফলের তাড়ায় অনেক কিছুই মুখস্থ, ঠোঁটস্থ, গলাধঃকরণ করতে হয়েছে। বমি উগড়ে দিলেই তো রাশি রাশি নম্বর! বিনিময়ে হাজিরা খাতায় নামটি প্রথম দিকে। যা পড়েছি, তার সবটা কী ফেলনা? দরকারি যা যা, তার কিছু ঠিকই আনমনে আত্মস্থ হয়ে আছে। এই যেমন, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পণ্ডিতমশাই’ গল্পখানি। নানান কারণে, নানান প্রেক্ষিতে এটি সামনে এসে দাঁড়ায়। বিশেষ করে শেষের পঙতিগুলো। মূল কথায় যাওয়ার আগে পাঠকের দরবারে একবার পেশ করি:
‘‘স্কুল ইন্সপেক্টরের তিন ঠেঙে কুকুরের পেছনে ব্যয় মাসে ৭৫ টাকা। আর বিদ্যালয়ের পণ্ডিতমশাইয়ের মাসিক বেতন ২৫ টাকা। তাহলে পণ্ডিতমশাইয়ের বেতন ইন্সপেক্টরের কুকুরের কয় ঠ্যাংয়ের সমান?
মূর্খের মতো একবার পণ্ডিতমশাইয়ের মুখের দিকে মিটমিটিয়ে তাকিয়েছিলুম। দেখি, সে মুখ লজ্জা, তিক্ততা, ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গিয়েছে। ক্লাসের সব ছেলে বুঝতে পেরেছে, কেউ বাদ যায়নি, পণ্ডিতমশাই আত্ম-অবমাননার কী নির্মম পরিহাস সর্বাঙ্গে মাখছেন, আমাদের সাক্ষী রেখে।’’
ঢাকায় চলছে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৬তম সম্মেলন। এর সাধারণ আলোচনায় মূল প্রবন্ধ পড়তে এখন আমাদের প্রিয় রাজধানী শহরে আছেন নোবেল বিজয়ী অধিকার কর্মী কৈলাস সত্যার্থী। প্রাবন্ধিক হিসেবে এলেও নিজের জন্যে নির্ধারিত সময়ে মৌখিক বক্তব্য রাখেন এই ভারতীয়। বিশ্বের ১৩১ দেশের আইনসভার সদস্যদের কাছে পেয়ে কৈলাসের জিজ্ঞাসা, বিশ্ব কি এতই দরিদ্র যে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাও নিশ্চিত করা যাবে না?
তিন বছর আগে শান্তির নোবেল নেয়া এই মানুষটি বিশ্বে আয় ও সম্পদের বৈষম্য সর্বোচ্চ জনপ্রতিনিধিদের সামনে পেশ করেন। তার অনুযোগ, কয়েক দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রে একজন প্রনিক (সিইও) ২০ জন শ্রমিকের সমান আয় করতেন। আর এখন এই বৈষম্য বেড়ে ১:২০০ হয়েছে। বিশ্বের ৫০ শতাংশ মানুষের সমপরিমাণ সম্পদ মাত্র আট জন ধনীর কাছে আছে। দিনে দিনে এই বৈষম্য বাড়ছে।
“আমরা যখন এই সম্মেলন করছি, তখন ২৭০ মিলিয়ন শিশু স্কুলে যেতে পারছে না। ২১ মিলিয়ন মানুষ বিক্রি হয়ে শ্রম দাসে পরিণত হয়েছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না, সহ্য করা যায় না।’’
....
“আজই সময়, এই ঢাকা থেকেই আমাদের শিশুদের জন্য কিছু করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সহানুভূতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার এখনই সময়।”
বিশ্বের সব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে দরকার ২২ বিলিয়ন ডলার। যা পুরো পৃথিবীর সাড়ে তিন দিনের প্রতিরক্ষা বাজেটের সমান। এই তথ্য দিয়ে কৈলাসের প্রশ্ন- “আমাদের এই বিশ্ব কি এতই গরিব যে ওই পরিমাণ অর্থ প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে পারব না?’’
সবার জন্য শিক্ষা- এই বাণীর প্রাথমিক ধাপ মোটামুটি পূরণ করেছে বাংলাদেশ। এতে করেই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) জয়ী দেশের কাতারে শক্ত অবস্থানে আসতে পেরেছি আমরা। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষার কথা যদি আসে। সেখানে আমরা কতটা যোগ্যতার পরিচয় দিতে পেরেছি? এই কারণেই বৈশ্বিক পর্যায় থেকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) নতুন সড়ক দেখানো হয়েছে। যার যাত্রা শেষ করতে এক যুগের বেশি সময় আছে আমাদের হাতে।
টেকসই উন্নয়নের প্রধান শর্ত সামাজিক বৈষম্য বিলোপ। কৈলাসের কথায় কিন্তু সেই বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তার ইচ্ছে যদি আমাদেরও ইচ্ছে হয়, তবে আমাদের দেশে প্রাথমিকের পড়াশোনার নানা মত, নানা পথ বর্জন করে একমুখী কাতারে আসতে হবে। বিদ্যালয় আর মাদ্রাসা, বাংলা আর ইংরেজি- আলাদা নামে শিক্ষায়তন থাকতেই পারে। কিন্তু অভিন্ন কিছু জাতীয়, আন্তর্জাতিক পাঠ; বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, গণিতের অভিন্ন পাঠ্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে। এর বেশি পাঠ নিজ দায়িত্বে গ্রহণ-বর্জন করতে হবে। সরকারি, বেসরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধায় ব্যবধান ঘোচাতে হবে। জীবন-ধারণে তাদের যাতে কোচিং, প্রাইভেটের দিকে যেতে না সেই বিষয়ের সমাধান আনত হবে। একদিকে বঞ্চিতদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে গরিবি হটাতেও কাজ করতে হবে। শিক্ষকদেরও ভালো রাখতে হবে। ‘পণ্ডিতমশাই’দের লজ্জা ঘোচাতে হবে। ‘তালেব মাস্টার’দের মূল্য দিতে হবে সমাজকে, রাষ্ট্রকে। তালেব মাস্টারকে চেনেননি? তবে পড়ুন নিচের চরণগুলো:
কিন্তু দশ টাকার বেমী প্রমোশন হয়নি আমার!
কপালে করাঘাত করেছিলাম জীবনে প্রথম সেবার
যখন টাকার অভাবে একটি মাত্র ছেলের পড়া বন্ধ হল!
আক্রার বাজার। চাল-নুনেই কাবার!
কীই বা করার ছিল আমার!
ঘরে বৃদ্ধ মা-বাপ
পুরাতন জ্বরে ভুগে ভুগে তারাও যখন ছাড়ল শেষ হাঁফ
দুঃখ করে শুধু খোদাকে বলেছিলাম একবারঃ
এতো দরিদ্র এই তালেব মাষ্টার!
তবু ছাত্রদের বুঝাই প্রাণপণঃ
‘সকল ধনের সার বিদ্যা মহাধন’। [-তালেব মাস্টার, আশরাফ সিদ্দিকী]
তায়েব মিল্লাত হোসেন : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

মন্তব্য করুন