ভিসির বাড়িতে তালা মেরে প্রকৃত সমাধান হবে কি?

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ২৭ মে ২০১৭, ২৩:০২ | প্রকাশিত : ২৭ মে ২০১৭, ২২:৫৯

প্রিয় জাহাঙ্গীরনগরে এখন জটিল পরিস্থিতি। খুব জটিল। অল্প কথায় এর ব্যাখ্যা দেয়া যাবেনা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং রাষ্ট্র নিশ্চয়ই নিহত দুজন ছাত্রের পরিবারের পাশে দাঁড়াবে। স্থানীয় এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের এটা নৈতিক দায়িত্ব। তাবলীগ করত দুটি ছেলে। ক্যাম্পাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তাবলীগ করা ছাত্ররা ক্যাম্পাসের কোনো ধরনের আইন বা প্রথাবিরোধী কিছু করেনা। পড়ালেখা আর স্রষ্টার ইবাদত নিয়ে থাকে। এরকম দুটি ছেলের অকাল অপমৃত্যুতে অন্যদের মত আমিও ক্ষুব্ধ। গভীরভাবে ভাবলে চোখে পানি আসে। দুটি ছেলে দুদিন আগেও জীবিত ছিল, প্রাণবন্ত ছিল। বিভাগে ক্লাস করেছে, বন্ধুদের সাথে হয়ত মজা করেছে। আজ তাঁরা নেই। কলমা এলাকার মার্কাজ মসজিদে তাবলীগের কাজ শেষে ফজরের নামাজ পড়ে পবিত্র সময়ে তারা রিক্সায় ক্যাম্পাসে ফিরছিলেন। হয়ত আর এক/দুই মিনিট চলতে পারলেই ক্যাম্পাসের নিরাপদ ঘরে ফিরতে পারত। কিন্তু ঘাতক বাস তাদের হত্যা করল নির্মমভাবে। এমন ঘটনায় ছাত্র-অছাত্র সব মানুষেরই ক্ষুব্ধ হওয়া খুব স্বাভাবিক। বয়সের কারণে শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ হওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকেনা। আর এটিতো বাসের ধাক্কায় দুটি তাজা প্রাণের হত্যা। গাড়ির চালক, হেল্পার, যাত্রী সবাই নিশ্চয় দেখেছিল রিকশার সবাই ছিটকে পড়েছে। কিন্তু কী অমানুষ একেকটা! বাস নিশ্চয় আরও দ্রুত গতিতে পালিয়ে গিয়েছিল নিরাপদে।

ক্যাম্পাসে জানাজা পড়তে না পেরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়েছে। সেই ক্ষোভ থেকেই নানা যৌক্তিক দাবিতে রাস্তা অবরোধ। প্রচণ্ড গরমে যারা রাস্তা অবরোধ করেছে, তাদের যেমন ভয়াবহ কষ্ট হয়েছে, আবার রাস্তায় যানবাহনে আটকে থাকা সাধারণ মানুষেরও কষ্ট হয়েছে। অনেকে হয়ত খোলা ট্রাকে দাঁড়িয়েছিল, অনেকে হয়ত কম ভাড়ায় বাড়ি যাবে ভেবে বাসের ছাদে চড়ে বসেছিল। তবে এ্যাম্বুলেন্স আটকায়নি কেউ। পুলিশ এসে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে আন্দোলনকারীদের রাস্তা থেকে উঠিয়ে দেয়। রাবার বুলেটের আঘাতে, পুলিশের লাঠিচার্জে অনেক জখম হয়েছে শিক্ষার্থীরা। পুলিশি আক্রমণে রাস্তায় টিকতে না পেরে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের একটা অংশ বিকেলের পর থেকে উপাচার্যের বাড়ির সামনে অবস্থান নিয়েছে। একটা অংশ বললাম, এ কারণে সকাল থেকে রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে কম করে হলেও ৪০০ শিক্ষার্থী। আমি ব্যক্তিগতভাবে হাজির ছিলাম না, নানা সোর্স থেকে আপডেট পেয়েছি। ফলে আমার বর্ণনায় ভুল থাকতে পারে। এরপরেও বলছি, বিকেলের পর থেকে ভিসি বাড়ির সামনে বেশী হলে ১০০ ছেলে-মেয়ে থাকতে পারে। আমি একটু বাড়িয়ে বললাম। আমি শুনেছি, ৪০/৫০ জন হবে। এবং এরা ক্যাম্পাসের বিশেষ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের। এই ছাত্র সংগঠন কিংবা সংগঠনগুলোর অনেক ভালো কাজ রয়েছে ক্যাম্পাসে। বিশেষ করে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের নানা দাবি আদায়ে এরা অতীতে অনেক অবদান রেখেছে, ভবিষ্যতেও রাখবে। কিন্তু বিকেল থেকে ভিসির বাড়িতে তালা মেরে দেওয়াটা মানতে পারছিনা। এটা সঠিক পথ নয়।

আমাদের উদ্দেশ্য কী? খুব সহজ, সরল এবং পরিষ্কারভাবে বললে, এ মুহূর্তে আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হল, নিহত দুজন ছাত্রের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। এমনিতেই ওদের পরিবারে মাতম চলছে। এরা নিশ্চয় আমার আপনার মত সাধারণ পরিবার থেকেই এই সবুজ ক্যাম্পাসে পড়তে এসেছিল। কদিন পরেই হয়ত এরা চাকরি বা অন্য কোনো বৈধ কাজ করে পরিবারের জন্য রোজগার করত। স্বজন হারানোর বেদনা টাকা দিয়ে পূরণ করা যায়না। এটা সম্ভব না। এরপরেও যদি এই দুই পরিবারের জন্য আমরা সবাই মিলে কিছু করতে পারি তাহলে একটা কাজের কাজ হয়। কিন্তু আমরা কি সে পথে আছি? রাস্তায় পুলিশি বর্বর আক্রমণে ক্যাম্পাসে ফিরে এসে ভিসির বাড়িতে তালা দেওয়াটা কোনোভাবেই বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। ভিসি বা প্রশাসনকে অন্যভাবেও চাপ দেয়া যায়। ফেসবুকের মাধ্যমে জেনেছি, গতকাল যখন রাস্তা অবরোধ করা হল প্রথমবারের মত, তখন সাতদিনের মধ্যে দাবিপূরণে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্রশাসন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রায় বড় একটা অংশ সাতদিনের মধ্যে সকল দাবিপূরণে প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি মেনে নিয়ে বলাবলি করছিল, ‘সাত দিন মানে সাতদিন’; এর পরে যদি দাবি পূরণ না হয় তাহলে আবার রাস্তা অবরোধ করা হবে’। কিন্তু একদিন না পার হতেই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী, বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরা শনিবার সকালে আবার রাস্তা অবরোধ করে। উপাচার্য শনিবার স্বাক্ষর করে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, দাবিদাওয়া পূরণে। ১০ লাখ টাকা এক পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদান এবং এক ছাত্রের পরিবারের কাউকে চাকরি দেয়ার দাবি আছে। স্পিড ব্রেকার তৈরি করার দাবিও আছে হাইওয়ের উপর। তাছাড়া গতিসীমা নির্ধারণ করে দাবিও আছে। বাসগুলো আমাদের গেটগুলোর কাছে আসলে যেন গতি আরও বাড়িয়ে দেয়। আজ পর্যন্ত পাবলিক বাসে আরাম করে নামতে পারিনি কোনো গেটে। চলন্ত অবস্থায় নামতে হয়। ফলে খুব শিক্ষার্থীদের দাবি যৌক্তিক। কিন্তু দাবি পূরণে ভিসি একা কী করতে পারে এই অল্প সময়ের মধ্যে। ভিসি একা ক্যাম্পাস চালান না, প্রক্টর আছে, সহকারী প্রক্টররা আছেন। বিভাগের শিক্ষকরা আছেন, চেয়ারম্যান আছেন। হলের প্রভোস্টরা আছেন। কোনো না কোনো সিদ্ধান্তে প্রায় সকলেরই সম্পৃক্ততা থাকে। ফলে একা ভিসিকে টার্গেট করে তাঁর বাসায় তালা মেরে “পতনের” দাবিতে আন্দোলন করা যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত বলে আমার মনে হয়না।

ফলে তাৎক্ষনিক দুর্ঘটনার জন্য কোনোভাবেই ভিসি বা প্রশাসনের কেউ দায়ী নয়। সংকট অন্যদিকে মোড় নিয়েছে নিহত ছাত্রদের জানাজা ক্যাম্পাসে না হওয়ায় । জানাজা পড়তে পারলে সাধারণ ছাত্রদের ক্ষোভ প্রশমিত হত বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা। হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী হল ঘাতক বাস। যে বাস কোম্পানিই হোক না কেন, মালিক সমিতিকে চাপ দিলে এরা আর্থিক একটা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হবে। যদিও জীবনের দাম টাকা দিয়ে হয়না। সকলের মনে রাখতে হবে, ভিসি এদেশের প্রধানমন্ত্রী নন। প্রধানমন্ত্রীও একটা কাজ করতে সময় নিয়ে করতে বাধ্য হন। রাস্তা অবরোধরত ছাত্র-ছাত্রীদের উপর, কর্মরত সাংবাদিকদের উপর পুলিশ হামলাও নিন্দনীয়। কিন্তু পুরো আন্দোলনটাই যেন এখন ভিসির বাড়ির সামনে চলে গেছে। ভিসির বাড়ির গেটে তালা মেরে দেওয়া হয়েছে। আমি আন্দোলনের এই পর্যায়ের সাথে মোটেও একমত নই। ভিসিকে তালা মেরে নিহত ছাত্রের পরিবারের কী লাভ? সবাই একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন। ভিসিকে বিব্রত করে শুধু কতপিয় মানুষের লাভ হতে পারে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, কীভাবে নিহত ছাত্রদের পরিবারের জন্য ভালো কিছু করা যায় কি না, সে বিষয়ে সকলের চেষ্টা করা। শান্তিপূর্ণভাবে এটা করা সম্ভব। মালিক সমিতিকে, রাষ্ট্রকে সঠিক বার্তা দিতে পারলে, ১০ লাখ কেন, ২০ লাখ টাকাও আদায় করা সম্ভব। কিন্তু ভিসির বাড়ির সামনে যা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে উদ্দেশ্য ভিন্ন। এটা ঠিক হচ্ছেনা। সাবেক উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির এর সময়ও দেখেছি, এক ইস্যু থেকে আরেক ইস্যুতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মিডিয়াকে বাজেভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। জয়েন করার পর থেকে শুধু আন্দোলনই দেখে আসছি। সরকার এবং জাবি ক্যাম্পাসের সবার কাছে অনুরোধ থাকবে, চোখ কান খোলা রাখতে হবে। প্রিয় ছাত্রের, বন্ধুর লাশ নিয়ে অপরাজনীতি করে যেন কেউ ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিল করতে না পারে। সকলের মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে হবে। সিদ্ধান্ত সঠিক হলে, ইস্যু তৈরি করে কোনো লাভ হবেনা বলে আমার বিশ্বাস। নৈতিক জোর না থাকলে কোনো আন্দোলন সফল হবেনা। শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাসচিব, ঢাকা জেলার ডিসি মহোদয়, বাসমালিক সমিতি সবার কাছে অনুরোধ, আপনারা ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি পূরণে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেন। শুধু জাহাঙ্গীরনগরের সমস্যা এটি নয়। রাস্তার গতিরোধক আগে ছিল। কিন্তু একজন বিদেশী মেহমানকে দ্রুত সাভার স্মৃতিসৌধে নেয়া উপলক্ষে এক রাতের মধ্যে সবগুলো গতিরোধক উঠিয়ে দেয়া হয়। এর পর আমার জানামতে দ্রুতগামী যানের ধাক্কায় দুজন ছাত্র ও একজন ভ্যানচালক মারা গেল। রাস্তায় কিছু করার এখতিয়ার জাবি প্রশাসনের নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের কাজ এগুলো। প্রান্তিকে একটা ফুট ওভারব্রিজ তৈরি করা ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেইরি গেটে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো দরকার। এমএইচ হলের গেট থেকে সিএন্ডবি পর্যন্ত পুলিশি টহল নিয়মিত করা না শুধু, একটা স্থায়ী নিরাপত্তা চৌকি বসানো দরকার। কয়েকদিন আগে এমএইচ হলে আমাদের এক মেয়ের গলায় ছুরি ধরে তার মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনতাই করা হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষার সময় এই রাস্তায় গণছিনতাই হয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একা সব পারেনা। তাই সরকারের উচ্চমহলকে আরও দ্রুত সব সিদ্ধান্ত নিয়ে জাবি প্রশাসনের পাশে দাঁড়াতে হবে। এক ইস্যু থেকে আরেক ইস্যুতে নিয়ে গিয়ে ক্যাম্পাসকে অশান্ত করতে দেয়া যাবেনা।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :