‘পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দাড়াবে’

মাহমুদ উল্লাহ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৬ জুন ২০১৭, ১৭:৪৩ | প্রকাশিত : ১৬ জুন ২০১৭, ১২:৪৫

গাউসুল আলম শাওন। অভিনয় করে পরিচিতি পেলেও লেখালেখিই তার পেশা ও নেশা। জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘আয়নাবাজি’র লেখক তিনি। দেড় যুগ ধরে বিজ্ঞাপনজগতে কাজ করছেন। লিখেছেন শত শত জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন। অভিনয়ও করেছেন বেশ কিছু বিজ্ঞাপনে। আয়নাবজি সিনেমায় ফটোগ্রাফারের ভূমিকায় নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। একাধারে গ্রে অ্যাডভার্টাইজ লিমিটেডের ম্যানেজিং পার্টনার ও কান্ট্রি হেড । আসছে ঈদের নাটক আয়নাবাজি অরিজিনাল সিরিজের চারটি গল্প তার লেখা। এখন মনোযোগ দিয়েছেন রোমান্টিক সিনেমার গল্প লেখায়। সম্প্রতি কথা হয় এই গুণী মানুষটির সঙ্গে। তিনি আয়নাবাজির সাফল্যের রহস্য তুলে ধরেছেন ঢাকাটাইমসকে। দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনার কথাও তিনি খোলাখুলি তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহমুদ উল্লাহ।

অভিনয় শিখলেন কোথা থেকে?

আমি তো অভিনয় জানি না। কোথাও অভিনয় শিখিওনি। বিজ্ঞাপন ও সিনেমায় ছোট কিছু চরিত্রে অভিনয় করেছি। আমাকে অভিনেতা বললে অভিনেতাদের অপমান করা হবে।

ক্যারিয়ার শুরুর গল্পটা শুনতে চাই।

আমি দিল্লতে ইকোনোমিকস ও জহরলাল নেহেরু ইউনিভাসিটিতে ব্র্যান্ড মার্কেটিং নিয়ে পড়াশোনা করেছি। প্রথমে দিল্লিতে সাত বছর পড়াশোনার পর এক বছর সেখানে একটি চাকরি করি। কিন্তু সেখানে আর ভালো লাগছিল না। আট বছর পর ২০০০ সালে দেশে আসি। এখানে এসে ইউনিক ট্রেন্ড অ্আডভার্টাইজিং ফার্মে চাকরিতে যোগ দিই। পরে এশিয়াটিক এবং তারপর গ্রে অ্যাডভার্টাইজিংয়ে যোগ দেই। গত ছয়-সাত বছর ধরে আছি গ্রে অ্যাডভার্টাইজিংয়ে।

এ পর্যন্ত কী কী বিজ্ঞাপনের গল্প আপনি লিখেছেন?

আমি এ পর্যন্ত অনেক বিজ্ঞাপনের গল্প লেখেছি। জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনগুলো হলো গ্রামীণফোন, বিউটিফুল বাংলাদেশ, গ্রামীণ কাছে আসার গল্প, বিউটিফুল ওয়ার্ল্ড, চলো বহুদূর, আমরা আমরাই তো, ফ্রুটিকা, প্রথম আলোর বদলে যাও বদলে দাও। ডিপ্লোমা দুধের বিজ্ঞাপনে তো ডাকাতের চরিত্রে অভিনয় করেছি। এ রকম অসংখ্য বিজ্ঞাপন রয়েছে।

আচ্ছা, আয়নাবজি সিনেমা বানাবেন এই আইডিয়া এল কীভাবে?

বহুদিন ধরে বিজ্ঞাপনে কাজ করার ফলে গল্প বলার একটা টেন্ডেন্সি তৈরি হয়েছে। অমিতাভও আমার অনেক বিজ্ঞাপন বানিয়েছে। আমরা প্রায় ১৫ বছর ধরে একত্রে কাজ করছি। আমাদের একটি আন্ডারস্ট্যান্ডিং রয়েছে। আমরা তো এক-দেড় মিনিটের গল্প বলিই। গল্প বলার একটা প্রবণতা থাকেই। সেই জায়গা থেকেই ভেবেছি তাহলে একটি সিনেমাও বানানো যায়। এভাবেই সিনেমা বানানো। অনেক দিন ধরেই আমি সিনেমা নিয়ে ভাবছি। অমিতাভও সিনেমা নিয়ে ভাবছে। সেখান থেকেই আয়নাবাজি গল্পটি আমি লিখেছি।

স্ক্রিপ্ট কে লেখে?

অনম বিশ্বাস কপি রাইটিংয়ের কাজ করত। তখন আমি আয়নাবাজির গল্প লিখি, আর ও স্ক্রিপ্ট লেখে। এরপর তো সবই জানেন।

‘আয়নাবাজি অরজিনাল’ সিরিজ কী?

এটি সাত পর্বের সাতটি নাটক। সাতজন পরিচালক তৈরি করছেন। আমরা ভেবেছি কী করে টিভির জন্য ভালো কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করা যায়? আমরা আয়নাবাজিতে দেখিয়েছি একজন মানুষ আরেকজন মানুষের কপি করে। তেমন ধরনের ভিন্ন আরো সাতটি গল্প নিয়ে তৈরি করছি ‘আয়নাবাজি অরিজিনাল’ টিভি সিরিজ। এর চারটি গল্প আমার লেখা। এগুলো এই ঈদে বিভিন্ন টিভিতে প্রচার হবে। এর একটি অমিতাভ রেজা তৈরি করছে। শুটিং শুরু হয়ে গেছে এর।

এ ছাড়া আর কী নিয়ে ব্যস্ত এখন?

এখন আমাদের দর্শকরা সবাই ভিন্ন দেশের টিভি দেখে, কিন্তু আমাদের দেশীয় চ্যানেল দেখে না। সবাই স্টার জলসা আর জি বাংলা নিয়ে ব্যস্ত। কলকাতার প্রডাকশন অনেকটা যাত্রার মতো মনে হয়। অথচ সেগুলোই সবাই দেখে। আমাদের চ্যানেলে বিজ্ঞাপনের আধিক্যের কারণে ভালো কন্টেন্টও কেউ দেখতে চায় না। সবাই বিরক্ত হয়ে যায়। এটাকে বদলাতে হবে। আমাদের দর্শকদের ফিরিয়ে আনতে ভালো কিছু কন্টেন্টও তৈরি করছি আমরা।

আচ্ছা, যেমন?

আয়নাবাজি অরজিনাল সিরিজ করছি। ‘একদিন প্রজ্ঞার দিন’ ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। ‘এক ডিশ দুই কুক’ তৈরি করেছি যেখানে সেলিব্রেটিদের বিভিন্নভাবে সারপ্রাইজ দেয়া হয়। এ ছাড়া আমরা ফেলুদার সব স্বত্ব কিনে নিয়েছি। এখন এগুলো তৈরি করব। এ রকমই টেলিভিশন ও অনলাইনের জন্য বিভিন্ন ভালো কন্টেন্ট বানাচ্ছি।

সবই তো টিভির জন্য। সিনেমার কী খবর?

আমরা নুরুল আলম আতিকের ‘পেয়ারার সুবাস’ নামের একটি সিনেমা তৈরি করছি। খুব ভালো একটি ছবি হয়েছে। এটি নিয়েও অনেক প্ল্যান রয়েছে। বিভিন্ন ফ্যাস্টিভ্যালে যোগ দেব। এখন আমি রোমান্টিক সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখছি। পিওর রোমান্টিক। অনেক আগে থেকেই রোমান্টিক একটা সিনেমা করার স্বপ্ন ছিল। গল্প লেখা শেষ। ঈদের পর এর চিত্রনাট্য লেখার কাজে হাত দেব।

বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? ইন্ডাস্ট্রির অবস্থান কেমন?

বাংলাদেশের সিনেমার ডিস্ট্রিবিউশনের অবস্থা খুবই খারাপ। হলে ছবি চললে তা থেকে প্রযোজক যে টাকা পান তা খুবই সামান্য। এই টাকা দিয়ে কোনো ছবি লাভে আসতে পারে না। এ ছাড়া হল থেকে বা বুকিং এজেন্টদের কাছ থেকে পেমেন্টের স্ট্রাকচার ভালো না। ছবিতে টাকা লগ্নিকারী অর্থাৎ প্রযোজকরা এ দেশে প্রথম প্রায়োরিটি পান না। প্রথম প্রায়োরিটি পান হল মালিকরা। তাহলে হবে কী করে।

তাহলে এখন এর সমাধান কী?

এর সমাধান একটাই- নতুন হল তৈরি করতে হবে। এক হাজার আসনের হল প্রয়োজন নেই। ২৫০ থেকে ৩০০ আসনের এক-একটা প্রজেকশন হল হলেই হবে। এখন অনেকেই হল তৈরির কাজে নেমেছে। স্টার সিনেপ্লেক্সের মালিক রয়েল ভাই হল তৈরি করছেন। সরকারি উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন হল তৈরি করছে। এভাবে তৈরি হচ্ছে বলেই বলা যায়, সামনেই সিনেমার সুদিন চলে আসছে। খুব বেশি দেরি নয়। দেশে রাজনৈতিক কোনো সমস্যা না হলে আগামী পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে দেশের চলচ্চিত্রশিল্পঅনেক পরিবর্তন হয়ে যাবে।

আর কোনে কোন দিকে বেশি ঘাটতি আছে বলে আপনি মনে করেন?

প্রয়োজক, ইনভেস্টার, পোস্ট প্রডাকশন-এর জন্য ভালো লোক দরকার। এখানে ট্যালেন্টের অভাব নেই। আমাদের প্রচুর ট্যালেন্ট রয়েছে। পুরনোরা একভাবে ফেল করেছে। নতুন প্রজন্ম চলে আসছে। তারা ঠিকই উতরে যাবে।

শুনেছি আয়নাবাজি মুক্তি নিয়ে কাকরাইলে সমস্যার মুখে পড়েছিলেন। সেটা কী ধরনের?

আমরা যখন আয়নাবাজি নিয়ে কাকরাইলে সিনেমাপাড়ায় যাই, তখন সবাই বলে ‘চঞ্চল চৌধুরীকে নিয়েছেন? আইটেম গান নাই? তাহলে চলবে না।’ এমনভাবে আমাদের নিরুৎসাহিত করেছে। কাকরাইলের কেউ ছবিটি নিতে চায়নি। তারা বলে, ‘আপনারা তো পুতলার (অ্যাওয়ার্ড) জন্য ছবি বানান।’ তারা কেউ আমাদের ছবির ওপর ভরসাই করতে পারছিল না। সবাই মাসের প্রথম দিকে ছবি মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করে। তখন ঈদ হচ্ছে ১৩/১৪ তারিখ। আমরা এরপর ঝুঁকি নিয়ে ২৯ তারিখ মুক্তির ডেট নিই।

এরপর?

আমরা মোট ১৮টি সিনেমা হল পেয়েছিলাম প্রথমে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে হল বেড়ে ৪২টি হয়। পরে ৭০টি হলে আয়নাবাজি চলে। কোনো ছবির ভালো-মন্দ অবস্থান বুঝতে এক সপ্তাহই যথেষ্ট। আমি এক মাস কাকরাইলে বসেছি।

আপনাদের প্রচারণা কৌশলও অনেক শক্তিশালী ছিল।

মুক্তির এক মাস আগে থেকে প্রচারণা শুরু করি। চঞ্চলকে খেলার সময় মাঠে নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন ডিজিটাল মার্কেটিং করতে থাকলাম। ফেসবুকে ক্যাম্পেইন করলাম। ফেসবুকে ইন্টারেস্টিং বিভিন্ন পোস্ট করতে থাকি। প্রচুর পিআর নিউজ করি। এভাবে মানুষের মাঝে একটা কৌতূহল তৈরি হয় আয়নাবাজি নিয়ে।

আয়নাবাজির সংলাপে অনেক আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আয়নাবাজির সফলতায় এরও নিশ্চয় একটা ভূমিকা আছে?

সংলাপ করেছে আদনান আদীব খান ও অনম বিশ্বাস। আমাদের তিনজনের একটা ভালো বোঝাপড়া ছিল অনেক আগে থেকে। সংলাপগুলো আধুনিক বা কন্টেম্পোরারি করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিছু হিউমার দেয়ারও চেষ্টা ছিল। এ উপমহাদেশে ছবি বা নাটকের জনপ্রিয়তায় সংলাপ অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের মানুষ ভিজুয়্যাল দেখার চেয়েও কানে শুনতে বেশি পছন্দ করে। জনপ্রিয় সংলাপ তারা মুখে মুখে বলে।

আমরা কাস্টিংটাও অনেক ভেবেচিন্তে করেছি। যে চরিত্রটি যাকে দিয়ে হবে তাকেই কাস্ট করেছি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে চঞ্চল চৌধুরী চরিত্রে নিজেকে ভাঙতে পারবে, নাবিলাকে মনে হয়েছে শিক্ষিত ও শহুরে। এমন চরিত্রই দরকার ছিল। আবার কম বয়স হলেও হবে না। ম্যাচিউরড ম্যান্টালিটির মনে হতে হবে। তাই নাবিলাকে নিয়ে নিয়েছি।

অভিনয় ছাড়াও গল্পটি খুবই পাওয়ারফুল, আনকমন গল্প। এ ছাড়া অমিতাভের পরিচালনা খুব ভালো ছিল। ফটোগ্রাফি ভালো ছিল। প্রতিটি পয়েন্টে আমরা ভালো করেছি।

প্রথমে কি ভেবেছিলেন আয়নাবাজি এত ব্যবসা করবে?

বিজ্ঞাপন করার সময় আমরা জানি কোনটা মানুষ দেখবে। তাই এটুকু জানতাম যে মানুষ আয়নাবাজি দেখবে। কিন্তু এত বেশি হয়ে যাবে কেউ ভাবিনি।

সিনেমা বানানোয় কোনো চ্যালেঞ্জ দেখেছেন?

এ দেশে সিনেমা বানানো অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। সিনেমা বানাতে যা যা প্রয়োজন তার কোনো কিছু তৈরি না। কোনো কিছুই ঠিক নেই। আমাদের এখানে সময় নেই। ফাইন্যান্স নেই। সিকিউরিটি নেই।

সিনেমা বানাতে হলে বর্তমানে নতুনদের কোন বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে?

আজকের পৃথিবীতে নিজেদের গল্প বলতে হবে। এখন বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ মানুষের বয়স ৩৫ এর নিচে। তারা ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। বাইরের ছবি দেখে অভ্যস্ত। দেখতে ছবিটি নান্দনিক হতে হবে। প্রডাকশন ভাল হতে হবে। শিল্পীদের অভিনয় ভাল হতে হবে। পরিস্কার ছবি থাকতে হবে। লোকজনের চোখে ফাঁকি দেয়া সম্ভব না এই সময়ে। আর দিতে পারলেও তা হিট হওয়া সম্ভব না।

এ পর্যন্ত কি কি নাটকে অভিনয় করেছেন? প্রথম অভিনয়ের কথা বলেন।

নাটকে প্রথম অভিনয় করি মতিয়া বানু শুকু আপার দশ পর্বের নাটকে। আর বিজ্ঞাপনে প্রথম একটি অন্য এজেন্সির বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেছিলাম। সম্ভবত ফ্রুটিকা ড্রিংকস এর বিজ্ঞাপন ছিল সেটি। পরচুলা পরে অভনয় করেছিলাম পলিটিশিয়ানের চরিত্রে।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আপনাকে ও ঢাকাটাইমসকেও অনেক ধন্যবাদ।

ঢাকাটাইমস/১৫জুন/এমইউ

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিনোদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :