বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি: বিকৃতি আসলে কার?

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ২৬ জুলাই ২০১৭, ১৮:০৬

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমিতে শিশুদের একটা চিত্রাঙ্কন প্রদর্শনী হচ্ছিল। ছবির বিষয় ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আমি নিজে ছবি তেমন ভালো বুঝি না। বুঝি যে না, সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল সঙ্গে থাকা বন্ধুটির দু-একটি মন্তব্যেই। সে বেশ শিল্পবোদ্ধা। আমাকে সে রঙের নানা ব্যবহার দেখাচ্ছিল। এক পর্যায়ে বললাম, ‘আমি অতকিছু বুঝি না। কিন্তু তুমি যেভাবে রঙের ব্যবহার নিয়ে খুঁটিনাটি বলছো, বাচ্চারা কি ওভাবে বুঝেই রং দিয়েছে?’

‘না, তা দেয়নি। ওরা দিয়েছে সহজাতভাবে। ওরা ওদের মতো করে ভেবেছে, ওদের মতো করে দেখেছে, কল্পনা করেছে, তারপর নিজের মতো করে রং দিয়েছে। প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা রং করেন নিজেদের হৃদয় আর জ্ঞান দিয়ে, ওরা করে কেবল হৃদয় দিয়ে। কেবল রং-ই নয়, চরিত্রগুলোও তারা আঁকে তাদের চিন্তার মতো করে।’

এরপর হঠাৎ করেই সে আমাকে একটা কথা বললো। ‘দেখো, ছবিগুলোতে ওরা মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য এঁকেছে। মুক্তিবাহিনী গুলি করছে পাকিস্তানি বাহিনীকে লক্ষ্য করে, রাজাকারদের লক্ষ্য করে। কিন্তু একটা বিষয় খেয়াল করেছো? সব ছবিতেই পাকিস্তানি বাহিনী বা রাজাকাররা বয়স্ক হলেও মুক্তিযোদ্ধারা কিন্তু শিশু বয়সের।’

আরে, তাই তো! আমি ছবিগুলো আর একবার ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সব ছবিতে একই ব্যাপার। তাদের দৃষ্টিতে মুক্তিযোদ্ধারা শিশু-কিশোর বয়সের, আর পাকবাহিনী রাজাকাররা গোঁফওয়ালা বয়স্ক! আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তারা তাদের মতো করে ভেবেছে। আমার খুবই ভালো লাগলো। আমি আগের চেয়েও বেশি উৎসাহ নিয়ে ছবিগুলো দেখতে লাগলাম। এরপর যখনই আমি শিশুদের আঁকা কোনো ছবির সামনে দাঁড়িয়েছি, মনে হয়েছে যেন তাদের সেই নিষ্পাপ চিন্তাকে দেখছি।

আচ্ছা, কেউ কি বলবেনÑ মুক্তিযোদ্ধাদের শিশু বানিয়ে ওই শিশুশিল্পীরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করেছে, বিকৃত করেছে? এ জন্য কি ওই শিশুদের বিরুদ্ধে মামলা হবে? কিংবা যারা এই ছবিগুলো নির্বাচন করে এভাবে প্রকাশ্যে প্রদর্শন করেছে, তাদেরকে নিয়ে জেলে ঢোকানো হবে?

অথচ বরিশালে কিন্তু তা-ই ঘটলো। একটি শিশু পরম মমতায়, তার চিন্তায় এঁকেছে জাতির পিতাকে। সেই ছবিকে পেছনের কভারে রেখে একটি আমন্ত্রণপত্র ছেপেছে উপজেলা প্রশাসন। আর সেটি দেখে আওয়ামী লীগের এক পাতিনেতার মনে হয়েছে, এভাবে বিকৃত করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির। আর যায় কোথায়, মামলা ঠুকে দিয়েছে উপজেলা প্রশাসনের প্রধান কর্মকর্তাÑইউএনওর বিরুদ্ধে। সেই মামলাতেই বিজ্ঞ বিচারক আসামি ইউএনওকে জামিন না দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য এর মাত্র দুই ঘণ্টা পরেই তাকে আবার জামিনও দেয়া হয়েছে। মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যেই উনি বুঝতে পেরেছেন, আগের কাজটি তার ঠিক হয়নি।

এই ঘটনাটির আরও একটু ডিটেইলে আমি যেতে চাই। মামলার আসামি গাজী তারিক সালমান। তিনি বরগুনা সদরের উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)। ঘটনাটি ঘটেছে মার্চের আগে। সেসময় তিনি বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার ইউএনও ছিলেন। সেসময়ই ওই আমন্ত্রণপত্রটি ছাপা হয়। এর কিছুদিন আগে সেখানকার শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছিল যে দুটি চিত্র, সে দুটি দিয়েই আমন্ত্রণপত্রটি সামনের এবং পেছনের কভার করা হয়। সন্দেহ নেই এটি একটি অভিনব আইডিয়া।

পেছনের প্রচ্ছদের ছবিটি যে এঁকেছে সে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। এই ঘটনার কয়েক মাস পর, গত ৭ জুন মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। মামলার বাদী বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ওবায়দুল্লাহ সাজু। তিনি একই সঙ্গে বরিশাল আইনজীবী সমিতির সভাপতিও বটে। এর মধ্যে ইউএনও তারিক সালমান বদলি হয়ে বরগুনায় চলে যান। বরগুনায় যাওয়ার পরই তার নামে মামলা হয়। গত ২৬ জুলাই সেই মামলায় হাজির হয়ে জামিন চাইতে গেলে বিচারক মোঃ আলী হোসাইন জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে জেলে পাঠিয়ে দেন। পুলিশ হাতকড়া লাগিয়ে তাকে জেলে নিয়ে যায়।

ওই শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবিটি আসলে কতটা বিকৃত হয়েছে? এরই মধ্যে ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে। অনেক বড় বড় শিল্পী সেটা দেখেছেন। কেউ বিকৃত বলেননি। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ছবিটি দেখেছেন, তিনি বলেছেনÑ এটি পুরস্কার পাওয়ার মতো একটা ছবি। তাহলে? আসলে ফটোগ্রাফি আর চিত্রাঙ্কনের পার্থক্যই ওই লোকগুলো বোঝে না। মূর্খ লোকের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দিলে যা হয়, তাই হয়েছে এখানে।

ভাগ্যিস ওরা বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিনের আঁকা বঙ্গবন্ধুর চিত্রগুলো দেখেনি। সেসব ছবির কোনোটিকেই কি ফটোগ্রাফির মতো পূর্ণাঙ্গ মনে হবে? তাঁর আঁকা এমন ছবিও তো আছে যেখানে বঙ্গবন্ধুর চোখ, নাক, কপালও ঠিক মতো বোঝা যায় না। তাহলে কি তার বিরুদ্ধেও লাগাতার মামলা হতে থাকবে?

পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, ওই আমন্ত্রণপত্রের ব্যাক কভারে ছাপা হওয়া বঙ্গবন্ধুর ‘বিকৃত’ ছবিটি দেখে নাকি বাদী ওবায়দুল্লাহ সাজুর হৃৎকম্পন বেড়ে যায়। উনি অপমানিত বোধ করেন এবং মামলা করেন। আমি বুঝতে পারি না, হৃৎকম্পন বেড়ে যাওয়ার পর মামলা করতে উনি তিন মাস সময় কেন নিলেন? এই তিন মাস বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হৃৎকম্পন নিয়ে কিভাবে জীবন যাপন করেছেন?

তারিক সালমানকে গ্রেপ্তারের ঘটনা প্রচার হওয়ার পর অনেক মহল থেকেই এর তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। সাজুর নিন্দায় অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকেও সোচ্চার দেখছি। এই লোকগুলো তাহলে এতদিন কোথায় ছিলেন? মামলা তো হয়েছে দেড় মাসেরও বেশি সময় আগে। কেন্দ্রীয় নেতাদের কথা না হয় বাদ দিলাম, তার জেলার নেতারা নিশ্চয়ই বিষয়টি জানতেন। তারা তখন কেন সোচ্চার হননি? কেন তাকে এই অপকর্মে বাধা দেননি?

নাকি তারা ভেবেছিলেন, এটা খুবই ভালো একটা কাজ হচ্ছে? হয়তো ভেবেছিলেন, এই কাজের পর খোদ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তাদেরকে ডেকে নিয়ে বাহবা দেবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। মূর্খরা সকলকে তাদের মতোই মূর্খ মনে করলেও সেটা যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুল হয়, সেটা আবারও প্রমাণিত হলো।

এর মধ্যে জানতে পেরেছি, এ ঘটনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম এর জন্য দোষ দিয়েছেন বরিশালের ডিসি এবং এসপিকে। তারা থাকতে এমন ঘটনা কি করে ঘটলোÑ তা জানতে চেয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

এর মধ্যে আরও অনেক পেছনের ঘটনা বের হয়ে আসছে। আগৈলঝাড়ার ইউএনও থাকাকালে তারিক সালমানের কি কি পদক্ষেপের কারণে তার উপর আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন, সেসবও বের হয়ে আসছে এক এক করে। কেবল নানা লুটপাটের প্রতিবন্ধকতাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে তারিক সালমান সেই নেতাদের ব্যক্তিগত রোষানলেও ছিলেন।

তাই বদলি হয়ে চলে গেলেও তাকে একটা ‘শিক্ষা’ দেয়া এই নেতাদের জন্য খুব জরুরি ছিল। আর মামলা করার জন্য ওবায়দুল্লাহ সাজু খুবই লাগসই একজন ব্যক্তি। তিনি কেবল আওয়ামী লীগের নেতাই নন, একই সঙ্গে জেলা আইনজীবী সমিতির নেতাও। এরকম বিভিন্ন জেলায় সরকারদলীয় আইনজীবীদের দাপট যে কতটা প্রবল, সেটাও এই দেশে তেমন নতুন কোনো বিষয় নয়।

মামলাটির ধারার দিকে তাকালেও কিছুটা বিভ্রান্ত হতে হয়। বাদী সাজু মামলা করেছেন পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে! বঙ্গবন্ধুর ছবিটি যদি ‘বিকৃত’ হয়ে থাকে, সেটা এঁকেছে পঞ্চম শ্রেণির একজন ছাত্র। সেটিকে আমন্ত্রণপত্রের শেষ প্রচ্ছদে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ইউএনও। ভুল করে থাকলে কিংবা ক্ষতি হয়ে থাকলে তাদের হয়েছে।

এতে আইনজীবীদের নেতা সাজুর ক্ষতির সুযোগটা কোথায়? নাকি ওই যে তার হৃদকম্পন বেড়ে গিয়েছিল, তার জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন? তাই যদি হয়, তাহলে তার ক্ষোভটা ঠিক কোন কারণেÑ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ‘বিকৃতির’ কারণে, নাকি ওটা দেখে তার হৃদযন্ত্র উল্টাপাল্টা আচরণ করেছে, সেই জন্য? যদি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি বিকৃতির কারণে হয়ে থাকে, তাহলে পাঁচ কোটি টাকা কেন? পাঁচ কোটি টাকা পেলে কি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির যেকোনো বিকৃতি গ্রহণযোগ্য হবে?

এরকম অনেক প্রশ্নই হয়তো করা যায়। কিন্তু এসবের কোনো জবাব যে পাওয়া যাবে না, অন্তত এই গাড়ল লোকদের কাছে যে কোনো উত্তর নেই, তা উপলব্ধি করতে তেমন একটা কষ্ট করতে হয় না। এরা এই রকমই করে, করে নিজেদের স্থূল স্বার্থ চরিতার্থ করতে। এই করে করে এরা প্রমাণের চেষ্টা করে যে, ওই এলাকায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের তার চেয়ে বড় সৈনিক আর কেউ নেই।

তাই আগামীতে সুযোগ-সুবিধা তারই বেশি প্রাপ্য। এমনকি আগামীতে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার কথাও বিবেচনা করতে পারেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। দলের জন্য ক্ষতিকর এরকম অতি উৎসাহীর অভাব নেই আমাদের রাজনীতিতে। এদের কারণে দল, নেতা, দলীয় আদর্শ বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয় সাধারণ মানুষের কাছে। বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বিকৃত আসলে এরাই করে।

তবে, আমি নিজে খুবই অবাক হয়েছি বিচারকের ভূমিকায়। জেলা জজ তো একেবারে জুনিয়র কোনো বিচারক নন। তিনিই বা কোন বিবেচনায় এই মামলা গ্রহণ করলেন? এই মামলার ইনটেনশন বুঝতে তো কোনো আনাড়ি ব্যক্তিরও তেমন একটা কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তাহলে উনি সেটা বুঝতে পারলেন না কেন? নাকি ওনারও বিবেচনাতেও কাউকে তুষ্ট করার চিন্তা কাজ করেছে? আমরা সাধারণ মানুষ, আম জনতা।

মনে আসলেও অনেক কথা মুখে উচ্চারণের সাহস পাই না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের কণ্ঠেও যখন একই উচ্চারণ শুনি, তখন কিছুটা হলেও ভরসা পাই। তিনি সরাসরিই সমালোচনা করেছেন, বলেছেনÑ‘এটি করা যায় না। কারণ ইউএনও হচ্ছেন উপজেলা পর্যায়ে সরকারের সবচেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাকে কোনো শাস্তি দিতে হলে বা তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা কোনো রকম কিছু করতে হলে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন।’

খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে এরই মধ্যে জানা গেছে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, যে ছবি দেখে সাজু উকিলের হৃদকম্পন বেড়ে গিয়েছিল, পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছিল, সেই ছবি দেখে প্রধানমন্ত্রী মুগ্ধ হয়েছেন। বলেছেনÑ এই ছবি পুরস্কার পাওয়ার মতো, ইউএনও যে কাজ করেছেন সেটাও পুরস্কার পাওয়ার মতো! তাহলে দাঁড়ালোটা কি? জানতে বড় ইচ্ছা করেÑ উকিল সাহেবের হৃদযন্ত্রের এখন কি অবস্থা? নাকি তার বিবেচনায় ‘বিকৃত’ একটা প্রতিকৃতিকে পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত বলায় রেগে মেগে তিনি এখন খোদ বঙ্গবন্ধু কন্যার বিরুদ্ধেই মামলা করে বসবেন?

মাসুদ কামাল: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :