টিভি অন করলেই ছেলে বলে ‘দুরন্ত’ দাও

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:৪১ | প্রকাশিত : ১৬ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:২৪

আমার ছেলে আপনাদের সকলের সন্তানের মতই এর আগে শুধু বিদেশি চ্যানেলে প্রচারিত ইংলিশ, ভারতীয় হিন্দি অথবা বাংলা কার্টুন দেখতে চাইত। ছেলের যখন দুই বছর বয়স, তখন একদিন শুনি বলছে ‘শিবা’, ‘শিবা’। এই ‘শিবা’ শব্দ আমার ধর্ম বা সংস্কৃতির নয়। আমার খুব খারাপ লাগল। কিন্তু কী করা? ‘শিবা’ ভারতের একটি কার্টুন চরিত্র। সাইকেলে করে নিত্যনতুন সব রোমাঞ্চকর অভিযান করে বেড়ায়। আমার ও আমাদের বাচ্চারাও ‘শিবা’কে ভালোবেসে ফেলল। কার্টুন নিয়ে আমার আপত্তি ছিল না, ভয় পেলাম ভারতীয় প্রোগ্রামের মধ্যে মিশে থাকা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে।

শিবা ছাড়াও মোটো পাতলু, টম অ্যান্ড জেরি, ডোরেমন ও বেনটেন ইত্যাদি কার্টুন তো আছেই। টম অ্যান্ড জেরি দেখে আমার ছেলে ইংলিশ শিখে ফেলবে, এমন আশা কখনো ছিল না। তবে অনেক বাচ্চা যে হিন্দি বা হিন্দিতে ডাবিং করা কার্টুন দেখতে দেখতে নিজ মনের অজান্তেই হিন্দি বলে ফেলে, সেটা তো আমরা অনেকেই জানি।

বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি, হিন্দি বা অন্য যে কোনো বিদেশি ভাষা শিখতে পারলে খুবই ভালো। কিন্তু ভয় হল নতুন প্রজন্মের মধ্যে ক্রমশ বড় হওয়া হীনমন্যতার বিষবৃক্ষ নিয়ে। নিজ ভাষা, সংস্কৃতিকে না জেনে, না ভালোবেসে বড় হলে একটি প্রজন্ম আত্মবিশ্বাসহীন হতে বাধ্য। ছোট বেলা থেকেই বেগানা ভাষা বা জাতিকে বড় মনে করে বয়স বাড়ে আমাদের বাচ্চাদের। বাংলাদেশ যে একটা সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র, এই সত্য অনেকের মনে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করে না।

একেবারে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার বা আপনাদের সন্তানের জন্য তেমন কিছু দেশের চ্যানেলগুলোতে ছিল কি? এক মিনা কার্টুন কখন বিটিভিতে দেখাবে তা আগে থেকে জানা খুব কঠিন কাজ। বিটিভির টাকাপয়সার অভাব না থাকলেও অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার অভাব সারাজীবনের। তাও সিসিমপুর ছিল বলে আমাদের বাচ্চারা একেবারেই সহায়হীন হয়নি কখনো। মিনা আর সিসিমপুর ছাড়া বাচ্চাদের কোনো অনুষ্ঠান বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ছিল না। অথচ দেশে টেলিভিশন চ্যানেল ৩০টির মত।

সৃজনশীলতা আর বিষয় বৈচিত্রের অভাবে দেশীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যেন একেকটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়ানোর মেশিন। গৎবাঁধা নেতিবাচক সংবাদ, রুটিন সাংবাদিকতা, মধ্যরাত অবধি প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় টক শো আর ডাবিং করা বিজ্ঞাপন, ইত্যাদি মিলে আমাদের চ্যানেলগুলো কোনোভাবেই মানুষের, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের মন ভরাতে পারছিল না। সিনিয়র দর্শকরাও কোনমতে নিউজগুলো জেনে, হয় ভারতীয়, না হয় ভারতীয় ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইংলিশ চ্যানেলে সুইচ করে। বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর নিজস্ব প্রোগ্রাম নেই বললেই চলে। মানুষ বা প্রকৃতি নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটায়; সেগুলো প্রচার করে, লম্বা সময় ধরে বিজ্ঞাপন প্রচার করে চ্যানেলগুলো চলে।

এখনো দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি। পরিবর্তন বলতে গেলে দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনেই কিছুটা এসেছে। ‘আয়নাবাজি’, ‘ঢাকা এটাক’ কিংবা ‘ডুব’- এই তিনটি চলচ্চিত্র দেশের মানুষকে সিনেমা হলে ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু বাচ্চাদের জন্য একটা চ্যানেলের খুব অভাব বোধ হচ্ছিল। সে অভাব দূর করতে শুরু করেছে শিশুতোষ টিভি চ্যানেল ‘দুরন্ত’। যখন শুনলাম, দেশে বাচ্চাদের একটা চ্যানেল আসছে, খুব ভালো কিছুর আশায় সেদিন থেকে অপেক্ষা করছিলাম। কদিন আগে চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে ‘দুরন্ত’কে পেলাম। আমার ছেলেকে ডাক দিলাম। দুরন্ত চ্যানেলের পর্দা আমার ছেলের দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হল।

কদিন হলো, টেলিভিশন অন করলেই ছেলে বলে ‘দুরন্ত’ দেখব। যদিও অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখা চোখ ও শরীরের জন্য ভালো নয়, আমি ছেলেকে দিনের নানা সময় সামান্য সময়ের জন্য টেলিভিশন দেখতে দিই। বাসায় ফিরলে বা বাসায় অনুপস্থিত থাকাকালে ঘরের লোকজনকে বলে আসি, টেলিভিশন দেখিয়ে খাওয়ানোর দরকার হলে ‘দুরন্ত’ ছেড়ে দিও। আমি নিজেও এখন বাচ্চাকে সাথে নিয়ে দুরন্ত দেখি। মজার মজার অনুষ্ঠান আছে চ্যানেলটিতে। গ্রামে আমরা ছোটবেলায় যা যা করতাম, তার ভালো প্রদর্শনী হচ্ছে নতুন এই বাংলাদেশি চ্যানেলে। যেমন ডাব গাছের পাতা দিয়ে চশমা বানানো, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, কানামাছি খেলা ইত্যাদি দেখানো হচ্ছে চ্যানেলে। সুন্দর সুন্দর বাচ্চাদের মুখে এই চ্যানেলে নানা দেশীয় গল্প, ছড়া, কবিতা শোনানো হচ্ছে।

একজন বাবা হিসেবে বলতে পারি, দুরন্ত টেলিভিশন চ্যানেলের গ্রাফিক্স, এনিমেশন, বিষয়বস্তু নির্ধারণ, অনুষ্ঠান নির্মাণ ভালো হচ্ছে। কখনো শহরের ছেলে-মেয়েরা পরিষ্কার শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছে, কখনো গ্রামের ছেলে-মেয়েরা তাদের স্টাইলেই খেলছে, কথা বলছে, গান করছে; বাংলাদেশের গ্রাম-বাংলার নানা গল্প, খেলা উঠে আসছে নানা প্রোগ্রামে। কাগজের পাখি বানিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের বাচ্চারা। দোয়েল-শালিকদের গল্প উঠে আসছে মিষ্টি মিষ্টি গলায়। জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগারের একটি আদুরে শাবক একটু পরপরই নানা প্রোগ্রামের বার্তা নিয়ে পর্দায় হাজির হচ্ছে।

পুরনো সংবাদ ঘেঁটে জানতে পারলাম, দুরন্ত টেলিভিশন পূর্ণাঙ্গ সম্প্রচারে এসেছে ১৫ অক্টোবর থেকে। চ্যানেলটির পরিচালনা করছে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের মালিকানাধীন রেনেসাঁ গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বারিন্দ মিডিয়া লিমিটেড।

পেশায় একজন শিক্ষক আমি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। কিন্তু আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, শিশুদের সঠিক শিক্ষা দিতে না পারলে, বড়বেলার শিক্ষা খুব বেশি কাজে লাগে না। বরং ছোটবেলা আর বড়বেলার শিক্ষার বৈসাদৃশ্য মানুষের মধ্যে নানা সংকট ও ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। ছোটবেলায় অর্জিত বা স্থাপিত বিশ্বাস সারাজীবন মানুষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। একটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িতদের অনেকের কথা দেশের অনেক মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না। কারণ এরা বড় হয়েছে ৭৫-পরবর্তী ইতিহাস বিকৃতির সময়। গোলাম আযম মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবাদী বিরোধী অপরাধ করেছে, এই সত্য দেশের অনেক ছেলে-মেয়ে বিশ্বাস করতে চায়না!

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে। এদেশের মুসলমানরা দিন দিন আরও মুসলমান হয়ে যাচ্ছে; হিন্দুরা দিন দিন আরও হিন্দু হয়ে যাচ্ছে। নিজ দেশকে নয়, বিদেশকে মুখ্য ও আপন মনে করে এদেশের একদল মানুষ। আমাদের স্বপ্নে রাজ করে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান কিংবা ইউরোপের কোন কোন দেশ। লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে সারাক্ষণ স্বপ্ন দেখে বিদেশে চলে যাবে। শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে কাজ করে টাকা দেশে পাঠায়, একসময় দেশে ফিরে আসে। মেধাবী, শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরা বিদেশ গেলে আর আসতে চায় না। যারা চলে আসে, তাদেরকেও আমরা কদর করি না। সব মিলে একটা হতাশাজনক অবস্থা। আর্থ-সামাজিক নানা নেতিবাচকতায় ইতিবাচক প্রবণতা ও বাস্তবতাও কিন্তু কম নেই আমাদের। ব্রিটিশ আমল থেকে আমাদেরকে শোষণ করে এসেছে দেশি-বিদেশী লুটেরারা। পাকিস্তান আমলেও সে একই শোষণ আর অত্যাচারের ইতিহাস। স্বাধীন বাংলাদেশেও জাতির পিতা ও জাতীয় নেতাদের হত্যা করা হল। দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ ও আমলাদের দুর্নীতি বাংলাদেশকে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জন করতে দেয়নি। এরপরেও আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্জন কম নয়। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে যদি নতুন প্রজন্মকে আমরা দুর্নীতিমুক্ত একটা রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা উপহার দিতে পারি। বিশেষ করে গত আট বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে গেছে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে বাংলাদেশে জাতি গঠনের গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারে দুরন্ত টেলিভিশন চ্যানেল । টেলিভিশনের প্রতি সব বয়সী মানুষের আকর্ষণ দুর্নিবার। আমাদের প্রায় ৯৯ ভাগ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তিতে আমাদের পূর্বপুরুষরা দেশ স্বাধীন করেছিলেন। আমরা বলতে গেলে ইউনিক ন্যাশন। বাংলাদেশকে বুকে ধারণ করে মেধা ও মননের সম্পূর্ণটাই মাতৃভূমির জন্য ব্যয় করতে সক্ষম এমন প্রজন্ম সৃষ্টি করতে হলে শিশুদের বিকাশের প্রতি আমাদের নজর দিতে হবে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, রূপকথা, দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির উপাদান, মানুষের সাফল্য গাঁথা ইত্যাদি দেশীয় নানা উপাদানের ভিত্তিতে দুরন্ত টেলিভিশন আরও শিশুতোষ অনুষ্ঠান নির্মাণ করে আমাদের সন্তানদের বাংলাদেশমুখী নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে, এ প্রত্যাশা রইল।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিনোদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :