মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আদালত

মোহাম্মদ জমির
| আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৬:১৯ | প্রকাশিত : ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৬:১৩

পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম জাতিগত নিধনযজ্ঞ চলছে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন প্রদেশে। দেশটির সরকারের পৃষ্ঠপোষকে গণহত্যা করা হচ্ছে। যার শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। ধর্মীয় পরিচয়ে যাদের প্রায় সবাই মুসলমান। সেখানে তারা সংখ্যালঘু। মিয়ানমারে সংখ্যাগুরু হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। যাদের সরকার মহামতি বুদ্ধের অহিংসার নীতি ভুলে গিয়ে হিংসা ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেনাদের নেতৃত্বে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের আবাস। হত্যার শিকার সাধারণ মানুষ। ধর্ষিত হচ্ছে নারীরা। তাই প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা আসছে বাংলাদেশে। সরকারি হিসাবেই গত কয়েক মাসের সংঘাতপর্বে এই আগমনী মানুষের সংখ্যা প্রায় সাত লাখ। আর বেসরকারি হিসাবে তা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

তাদের কিছু অনুরাগী রাষ্ট্র বাদে পুরো বিশ্বই মিয়ানমারে সু চির সরকার ও সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার নিন্দা করছে। বিপরীতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সবার কাছে মানবিকতার এক নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করে দিতে পেরেছে। আমরা দুর্গত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ত্রাণ দিচ্ছি। আশ্রয়, আবাসন, চিকিৎসা, এমনকি শিক্ষাও নিশ্চিত করার কাজ নিজের হাতে তুলে নিয়েছে অনেকে। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য সারা বিশ্ব থেকেই আমরা ত্রাণ পাচ্ছি। তবে এতে বিপন্ন মানুষ সাময়িকভাবে জীবন রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সংকটের স্থায়ী সমাধান না পেলে, তা সংকট উত্তরণে কার্যকর কোনো ভ‚মিকা রাখতে পারবে না।

ইতিবাচক দিক হচ্ছে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক রাষ্ট্রই রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলছে। কেবল চীন, রাশিয়া, ভারত মিয়ানমার সরকারের প্রতি একটু বেশি সহানুভ‚তিশীল। এ কারণেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতির নতুন বলয়ে প্রবেশ করেছে। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থান আমাদের স্বার্থকে সংরক্ষণ করছে। তবে এর জন্য যে তারা বাংলাদেশকে সমর্থন করছে তা নয়। যুক্তরাষ্ট্র আর ইইউ মূলত রাশিয়া-চীন বলয়কে ঠেকানোর বিষয়টি মাথায় রেখে অবস্থান নিয়েছে। যদিও তারা মানবিকতার বিষয়টি সামনে রেখে সব প্রচারণা চালাচ্ছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গারা যদি মুসলিম না হয়ে অন্য কোনো ধর্মের অনুসারী হতো, তাহলে হয়তো মধ্যপ্রাচ্য তাদের নিয়ে কোনো মাথাই ঘামাতো না। ঠিক এই কারণে তুরস্ক রোহিঙ্গাদের প্রতি দারুণ সহানুভ‚তিশীল। যেখানে বাংলাদেশে একাত্তরের দেশীয় ঘাতকদের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থা নিয়েছিল তুরস্ক, যার কারণে তাদের সঙ্গে এক ধরনের টানাপড়েন তৈরি হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের। সেখানে রোহিঙ্গা সংকট নতুন করে বাড়ার পর তুরস্কের একের পর এক উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশে আসছেন। সর্বশেষ এসেছেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম। ১৮ ডিসেম্বর তিনি ঢাকায় আসেন। পরদিন তিনি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলো সারেন। ২০ ডিসেম্বর তিনি চলে যান কক্সবাজার। উদ্দেশ্য রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলাপ করা। উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন তিনি। এরপর তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গেও আলাপ করেন। বিনালি ইলদিরিম তখন গণমাধ্যমে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে অনেকটাই উচ্চকণ্ঠ হন। তিনি বলেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতন আসলে জাতিগত নিধন। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো এবং নিরাপদে বসবাসের ব্যবস্থার জন্য আন্তর্জাতিক সব মহলের একযোগে কাজ করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। ইলদিরিম রোহিঙ্গাদের জন্য মেডিকেল ক্যাম্পের উদ্বোধন এবং ২টি অ্যাম্বুলেন্স হস্তান্তর করেন। এসময় নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলাপ করেন তিনি। এরপর কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে খাবার বিতরণ করেন। এভাবেই তার বাংলাদেশ সফর সমাপ্ত হয়।

গত কয়েক মাসে অভিবাসী রোহিঙ্গাদের দেখতে বাংলাদেশে এসেছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও দেশের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ। তাদের প্রায় সবাই বলছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী গণহত্যার শিকার হচ্ছে। জাতিসংঘ অবশ্য গণহত্যার বিষয়টি সামনে এনেছে অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ শেষে। তার আগে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসসহ অন্য কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা নির্যাতনকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে অভিহিত করে আসছিলেন। ১৯ অক্টোবর জাতিসংঘের প্রিভেনশন অব জেনোসাইডের বিশেষ উপদেষ্টা অ্যাডামা দিয়েং এবং রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্টের বিশেষ উপদেষ্টা ইভান সিমোনোভিচ এক বিবৃতিতে মিয়ানমার সরকারকে রাখাইনে সংঘটিত ‘অ্যাট্রোসিটি ক্রাইম’ অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান করেন। বিবৃতিতে অ্যাট্রোসিটি ক্রাইম শব্দটির অর্থ উল্লেখ করা হয় ‘গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে।

গণহত্যার প্রসঙ্গ এলে চলে আসে আন্তর্জাতিক অপরাধী আদালতের (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টÑ আইসিসি) প্রসঙ্গ। রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন-নিপীড়ন, অগ্নিসংযোগসহ তাদের জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায্য বিচারের দাবিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধী আদালত (আইসিসি) ও আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজি) মামলাও অবশ্য হয়েছে। ২ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সাবেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট এম. এ কাইয়ুম চৌধুরী এই মামলা করেন। মামলার আবেদন অনুযায়ী, মিয়ানমার সরকার যেন অবিলম্বে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যথাযথ সম্মান, নিরাপত্তা ও নাগরিকত্ব দিয়ে বাড়িঘরে ফিরিয়ে নিয়ে পুনর্বাসন, তাদের প্রতি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ন্যায্য বিচার নিশ্চিত এবং তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ সে দেশের অন্য নাগরিকদের মতো সব গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার প্রদান করেÑ এসব বিষয়ে আদেশ দিতে আদালতের প্রতি আবেদন করা হয়েছে। মামলার আবেদনে আরো বলা হয়, মিয়ানমার সরকার কর্তৃক গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতির ভয়াবহতায় বাংলাদেশ আর্থিক ক্ষতি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। তার জন্য বাংলাদেশকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে যথাযথ ডিক্রি প্রদান করার জন্যও দাবি জানানো হয়। এর আগে সেপ্টেম্বর মাসেই মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে আন্তর্জাতিক গণআদালতের রায়েও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা, কাচিন, কারেনসহ কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা এই অভিযোগ করেছিলেন। ওই গণআদালতে আমন্ত্রিত বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকেও রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতনের প্রমাণ তুলে ধরা হয়।

রাখাইনে গণহত্যার দায় যাদের কাঁধে বর্তায় তাদের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধী আদালতে (আইসিসি) করা যায় কি না তার জন্য এই আদালতের উত্থান আর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। এই আদালত ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। যেখানে সাধারণত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ইত্যাদির জন্য দায়ীদের অভিযুক্ত করে থাকে। ১৯৯৭ সালের ১৭ জুলাই রোম নীতিমালা গৃহীত হয়। রোম নীতিমালা হলো আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের মূল ভিত্তি। এ নীতিমালা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আদালত গঠনের সিদ্ধান্ত। তবে রোম নীতিমালা কার্যক্রম করতে ১২০টি দেশের স্বীকৃতির প্রয়োজন ছিল। ১২০টি দেশের স্বীকৃতির পর ২০০২ সালের ১ জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধী আদালত তার কার্যক্রম শুরু করে। নেদারল্যান্ডসের হেগ শহর থেকে এ আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ২০০৪ সালে আইসিসি প্রথমবারের মতো অপরাধের অভিযোগের তদন্তে নামে। ওই বছর গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু করে সংস্থাটি। একই বছর মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা সংস্থাটিতে হস্তান্তর করা হয়। ২০০৭ সালে এর তদন্ত শুরু করা হয়। ২০০৫ সালে সুদান ও উগান্ডায় যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে আইসিসি। ২০১০ সালে কেনিয়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধ ও ২০১১ সালে আইভরিকোস্টে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে আইসিসি। ২০১১ সালেই লিবিয়ায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু করে সংস্থাটি। এছাড়া আফগানিস্তান, কলম্বিয়া, জর্জিয়া, গিনি, হন্ডুরাস, ইরাক, নাইজেরিয়া, ফিলিস্তিন ও ইউক্রেনে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে খতিয়ে দেখছেন সংস্থাটির প্রসিকিউটরা। আইসিসি এ পর্যন্ত ৩৬ জনকে বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত করেছে। এদের মধ্যে রয়েছে উগান্ডার বিদ্রোহী নেতা জোশেফ কোনি, সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা, লিবিয়ার প্রয়াত নেতা মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফি ও আইভরিকোস্টের প্রেসিডেন্ট লরেন্ট জিবাগবো। এভাবেই এ আদালত বিচারের মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তি বা সংগঠনকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে। এমনকি গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করতে পারে সংস্থাটি। তবে এর নিজস্ব কোনো বাহিনী না থাকায় অভিযুক্তদের ধরতে বা দণ্ড কার্যকর করতে পারে না। এ জন্য তারা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র ও অপরাপর অন্যান্য রাষ্ট্রকে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারের আহ্বান জানায়। রাশিয়া, চীন, ভারত ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ আদালতকে স্বীকৃতি দেয়নি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন রোম নীতিমালায় স্বাক্ষর করলেও প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তা প্রত্যাহার করে নেন।

রোম স্ট্যাটু অব ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট ১৯৯৮ এ বলা হয়েছে, ‘যেসব সদস্য দেশ রেকটিফাই করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের (আইসিসি) পূর্ণাঙ্গ সদস্য হয়েছে, তারা যদি যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ করে তাহলে আইসিসি তাদের বিচার করতে পারবে।’ কিন্তু মিয়ানমার এতে রেকটিফাই না করলেও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ একটি রেজ্যুলেশন পাস করে সরাসরি আইসিসিকে বিচারের জন্য বলতে পারে। আবার কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে আইসিসি স্বপ্রণোদিত হয়েও অনুসন্ধান করে মামলা নিতে পারে। এর বাইরে যেহেতু মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, তাই ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) গিয়ে রোহিঙ্গাদের খাবার, আশ্রয়, ভরণ-পোষণ চেয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে। আইসিসি আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংগঠন আইসিসির প্রসিকিউটরের (ওপিপি) অফিসে অভিযোগের বিষয়ে তথ্য পাঠাতে পারে। এটি পোস্ট, ফ্যাক্স বা ই-মেইলেও পাঠানো যায়। আইসিসির প্রসিকিউটর অফিস বিষয়টি আমলযোগ্য মনে করলে তারা অভিযোগের তদন্ত করবে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি যেহেতু এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ চালাচ্ছে বলে খোদ জাতিসংঘও স্বীকার করেছে, সুতরাং আইসিসির পক্ষে স্বপ্রণোদিত হয়েই এর অনুসন্ধান করা সম্ভব। আইসিসিতে বাংলাদেশের তরফে কোনো নাগরিক, আইনজীবী বা মানবাধিকারকর্মী রাখাইনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তথ্য-উপাত্তসহ একটি অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। তবে বৈশ্বিক কোনো পদক্ষেপের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের ঐক্য জরুরি। কারণ তাদের কেউ ভেটো দিলেই জাতিসংঘের কাজ থমকে যায়। এটা রোহিঙ্গা ইস্যুতে অবশ্যই হতাশার দিক। কারণ পরিষদের শক্তিশালী দুই স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের পক্ষে।

রোহিঙ্গাদের প্রতি যে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে, তা মিয়ানমারের বাইরে বিশ্বের অন্য কেউ অস্বীকার করতে পারছে না। বরং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের ধরন-ধারণ, আহত-নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা কাজ করছে। বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠান মেদসঁ সঁ ফ্রঁতিয়ে (এমএসএফ) বলছে, ২৫ আগস্ট থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তত ৯ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে মারা যায়। এর মধ্যে অন্তত ৬ হাজার ৭০০ মৃত্যুর কারণ সহিংসতা, যার মধ্যে পাঁচ অথবা তার চেয়ে কম বয়সের শিশু ছিল ৭৩০ জন। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা অভিবাসীদের ওপর করা এক জরিপ শেষে এই তথ্য জানায় সংস্থাটি। এমএসএফ বলছে, মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ পরিচালিত ব্যাপক সহিংসতার স্পষ্ট ইঙ্গিতের মাধ্যমে উঠে আসে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এর আগে দাবি করেছে, নিহতের সংখ্যা ৪০০ যাদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলিম জঙ্গি। সাংবাদিক ও গবেষকদের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ ও শরণার্থীদের সাক্ষাৎকার পর্যালোচনা করলে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। খোদ জাতিসংঘ রাখাইনে গণহত্যা হওয়ার কথা বলছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর অভিযুক্ত সদস্যদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালত হতে পারে ভরসার জায়গা। তবে এক্ষেত্রে কার্যকর কিছু হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত আসেনি। বাংলাদেশ বরং নজর দিয়েছে দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগে রোহিঙ্গাদের সসম্মানে ফেরানো যায় কি না। তার বাস্তবায়ন নিয়েও অনেকে আশাবাদী হতে পারছে না। কারণ মিয়ানমার একদিকে আলোচনা করছে, আবার রোহিঙ্গাদের প্রতি নিপীড়ন ঠিকই চালাচ্ছে। তবে অং সান সু চির সরকার ও সেনা প্রশাসনের অমানবিক আচরণ বন্ধে বিশ্ব বিবেককে তার কণ্ঠ সরব রাখতে হবে। তবেই একদিন মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দরজা খুলে যেতে পারে। যদিও জানা নেই দিনটি কবে আসবে; তবু সেই দিনটি দেখার অপেক্ষায় থাকলাম আমরা।

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং প্রধান তথ্য কমিশনার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :