মানবসম্পদ বিকাশ: সুযোগ ও উদ্দেশ্য

লিপন মুস্তাফিজ
| আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০১৯, ১৩:৫৭ | প্রকাশিত : ৩০ নভেম্বর ২০১৯, ১৩:০৩

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বলতে একটি সংস্থার কর্মচারীদের নিয়োগ, মোতায়েন ও পরিচালনার কৌশলগত পন্থাকে বোঝায়। মূলত চারটি উদ্দেশ্যে মানব সম্পদ ধারণার জন্ম হয়েছিল ১৯০০ সালের শেষের দিকে। ৬০ এর দশকে, যারা সংস্থার পক্ষে কাজ করেছিলেন, তাদের সামগ্রিকভাবে বর্ণনা করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।

১৯৭০ সালে, লিওনার্ড ন্যাডলার তার ‘মানবিক সংস্থান বিকাশ’ বইটি প্রকাশ করেছিলেন যাতে তিনি ‘মানবসম্পদ উন্নয়ন’ (এইচআরডি) শব্দটি তৈরি করেছিলেন। মানব সম্পদ বলতে সেই ব্যক্তির প্রতিভা এবং শক্তি বোঝায় যা সংস্থার লক্ষ্য, দৃষ্টি, মান এবং লক্ষ্যগুলি তৈরি ও উপলব্ধিতে সম্ভাব্য অবদানকারী হিসাবে কোনো সংস্থায় উপলব্ধ। এইচআরডি হলো ব্যক্তিগত, গোষ্ঠী এবং সাংগঠনিক কার্যকারিতা উন্নত করার প্রশিক্ষণ, সাংগঠনিক এবং ক্যারিয়ার বিকাশের প্রচেষ্টার সমন্বিত ব্যবহার।

সামাজিক উদ্দেশ্য হলো নীতিগত ও সামাজিক চাহিদা এবং এর কর্মচারীদের চ্যালেঞ্জের প্রতিক্রিয়া জানায় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সাংগঠনিক উদ্দেশ্য হলো সংগঠনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কার্যকরী উদ্দেশ্য হলো সামগ্রিকভাবে সংস্থার মধ্যে মানব সম্পদ সঠিকভাবে পরিচালনা করতে নির্দেশিকার ব্যবহার। ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হলো প্রতিটি কর্মচারীর ব্যক্তিগত লক্ষ্য সমর্থন করার জন্য ব্যবহৃত সংস্থানসমূহ যেমন শিক্ষা বা কর্মজীবনের উন্নয়নের পাশাপাশি কর্মীদের সন্তুষ্টি বজায় রাখার সুযোগ করে দেওয়া।

আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন থেকেই বই পড়া শুরু করি। আমার মনে আছে ‘কুয়াশা’ আর ‘দস্যু বনহূর’ দিয়ে আমার গল্পের বইয়ের জগতে প্রবেশ। এরপরে ক্লাস এইট বা নাইনে যখন পড়ি তখন আমরা কাছাকাছি তিন বন্ধু থাকতাম। একসাথে স্কুলে যেতাম আবার টিফিনে বাসায় খেতে আসতাম, ছুটি হলে ফিরে আসতাম একসাথে। বিকেলে মাঠে খেলতাম। আজান দিলে যার যার বাড়ি চলে আসতাম। শুক্রবারে মসজিদে নামাজে যেতাম এক সাথে, এক কাতারে নামাজ পড়তাম। এখন আমরা যারা ঢাকায় বসবাস করি তাদের সন্তান কি এই সকল সুযোগ পাচ্ছে? কিম্বা ফেলে আসা সেই ছোট্ট শহরে?

আশির দশকের শেষের দিকে আমরা তখন কিশোর ক্লাসিক, রহস্য পত্রিকা, তিন গোয়েন্দা, রিডার ডাইজেস্ট, ইত্যাদি বই পড়তাম। যেহেতু ঢাকার বাইরের জেলা শহরে থাকতাম তাই এগুলো প্রকাশের কিছুদিন পরে আমরা স্থানীয় বইয়ের দোকানে পেতাম। দোকানগুলো আবার বাসার কাছে না, সাইকেলে চড়ে খোঁজ নিতাম দোকানে বা বইঘরে। এভাবে যারা বইয়ের দোকানি ছিলেন তাদের সাথে আমাদের সখ্যতা ছিল। অনেক সময় তারা ভালো কিছু বই আমাদের হাতে তুলে দিতেন পড়ার জন্য। তখন সেবা বা অবসর প্রকাশনীর বইয়ের দাম ছিল ছয় থেকে আট টাকা, আমরা তিনজনে মিলে চাঁদা দিয়ে বই কিনতাম। আগেই ঠিক করে নিতাম, পালা করে বই পড়া হলে কে কোনটা নেবে। এভাবেই আমাদের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর সংগ্রহ সম্মৃদ্ধ হত। আমাদের পঠিত গল্পের বইয়ের সংখ্যা বাড়ত। ফলে আমাদের স্কুল বা পাড়া বা এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ার বই পড়ুয়াদের মধ্যে এক ধরনের যোগাযোগ বৃদ্ধি পেত। এমনও হতো একটা বই আমি নিলাম অন্যজন আমার কাছ থেকে বই নিত। এভাবে নিজের বইয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতাম কখনো কখনো। আবার বই হারিয়ে ফেলার কষ্টও আছে আমাদের বই পড়ার গল্পে। ঈদ সংখ্যা, শারদীয় সংখ্যা, লিটল ম্যাগাজিন বের হত, সেগুলোও পড়ার চেষ্টা করতাম, ধার করে বা কিনে। যদিও তখন বাবা মায়ের কাছ থেকে টাকা বের করা এখনকার মতন এত সহজ ছিল না।

পাড়ায় মহল্লায় অনেক সাহিত্য চর্চা হত, নাটক, বিভিন্ন দিবসে বড় ভাইয়েরা মিলে আয়োজন করতেন, কিন্তু এখন হয়ত কিছু চর্চা হয়ে থাকে কিন্তু রাজনীতিতে যারা আছেন তারা এগুলো আয়োজন করে থাকেন। তাদের শিল্প, সাহিত্যবোধ থাকুক বা না থাকুক তারা এর ক্রীম খেতে আসেন। আর আসেন লোক দেখাতে। এভাবেই ভাল মানুষ সংগঠক হারিয়েছে অনেক আগেই। আর যার বর্তমানে ভাল চিন্তা করেন তারা আর কোন উদ্যোগ নিতে চান না মান সম্মানের ভয়ে। এভাবেই আস্তে আস্তে আমাদের এলাকা ভিত্তিক সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ হয়েছে প্রায়। আমাদের সুমুকার বৃত্তিগুলো আজ মৃত। কাফনের সাদা কাপড়ে আবৃত। যার ফলে স্বাভাবিক নিয়মের ভিতরে বেড়ে ওঠা মানব সম্পদ ধীরে ধীরে অব্যবস্থাপনার ভিতরে ডুবে যাচ্ছে। বর্তমান সমাজের এই চিত্র আমাদের দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার অন্তরায়।

অফিস আদালতে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার চারটি বুনিয়াদি কাজ রয়েছে: কর্মী, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন, অনুপ্রেরণা এবং রক্ষণাবেক্ষণ। স্টাফিং হলো সম্ভাব্য কর্মচারীদের নিয়োগ এবং নির্বাচন, সাক্ষাৎকার, অ্যাপ্লিকেশন, নেটওয়ার্কিং ইত্যাদির মাধ্যমে করা ইত্যাদি কর্মীদের নিযুক্ত করার দুটি প্রধান কারণ রয়েছে- মেধাবী নিয়োগকারীদের আকর্ষণ করা এবং সংস্থানসমূহের নিয়োগ দেওয়া। শুধুমাত্র অফিসে নিয়োগের পরে প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব না। এর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদেরকে আগ্রহী করে তোলা।

আজকাল প্রায়ই একটা কথা শুনতে পাই দেশে নাকি অনেক ম্যান আছে কিন্তু পাওয়ার নেই, তার মানে আগামীতে ম্যানপাওয়ার শূন্য হতে পারে। তাহলে আমাদের দেশে শুধু মানুষ থাকবে, কাজের মানুষ থাকবে না এটা ধরে নেয়া যায়। তাই মহল্লায় ক্লাব, লাইব্রেরী আর সংগঠন চর্চা খুব দরকার। শুধুমাত্র একটি প্রথাগত ডিগ্রি আর কিছু দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণ আমাদের দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করবে বলে মনে হয় না।

মানবসম্পদ পরিচালন কোনো মানবসম্পদ পরিচালকের কাজ নয়। সন্দেহ নেই যে মানবসম্পদ পরিচালক একটি সংস্থায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কিন্তু একটা সংস্থার সমস্ত নির্বাহী এবং পরিচালকদের দায়িত্ব ওই প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক মানবসম্পদ উন্নয়নে ভুমিকা রাখা। মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিচালক পরিবর্তনের জন্য অনুঘটক হিসাবে কাজ করলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ পরিচালকদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা একটি সংস্থার প্রয়োজন অনুসারে মানবসম্পদ বিকাশের সাথে সম্পর্কিত। সুপরিকল্পিত মানবসম্পদ পরিকল্পনা বিশ্বে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে অতীব জরুরী।

কর্মীদের নতুন প্রত্যাশা এবং প্রযুক্তিতে দ্রুত পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য করার প্রয়োজনীযতা আবশ্যক। সংস্থাগুলির স্থায়ী নেতৃত্ব তাদের মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সাফল্যের উপর নির্ভর করবে। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা সামাজিক প্রসঙ্গেও গুরুত্বপূর্ণ। কর্মক্ষেত্রে বিকাশের অভাব পরিবার এবং সমাজে অসন্তুষ্ট সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটায়। কর্মক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা তরুণদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এবং প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্রোধের অবদানকে অবদান রাখে; সহযোগিতামূলক সামাজিক সম্পর্ক বিকাশের জন্য কাজের ক্ষেত্রে ইতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলি প্রয়োজনীয়। মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা অসম্ভব। আর এর ফলে দেশের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।

লেখক: ব্যাংকার ও গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :