আদালত অঙ্গনে দুর্নীতি ও ভোগান্তি কমাবে ই-জুডিশিয়ারি

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
| আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২০, ১৩:৩৪ | প্রকাশিত : ২৫ জানুয়ারি ২০২০, ০৯:৩৭

এতে করে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৩) অনুযায়ী ও ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হইবেন।’

বিচারাঙ্গনে জবাবদিহি নিশ্চিত ও দুর্নীতি রোধ, কোনো মামলায় যেকোনো ধরনের আদেশের কপি সহজে অন্যত্র পৌঁছানোর জন্য ই-জুডিশিয়ারি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তির পাশাপাশি কমবে অর্থ খরচও। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর আদালতে ই-জুডিশিয়ারি প্রচলিত। বাংলাদেশে এটি করা হলে মামলা জট নিরসনের পাশাপাশি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫ (৩) অনুযায়ী দ্রুত বিচার পাবেন সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা।

বাংলাদেশের অনেক সরকারি সংস্থার দাপ্তরিক কাজকর্ম এখন ডিজিটালাইজড। সরকারও ই-গভার্নেন্সে জোর দিচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের আদালতে ই-জুডিশিয়ারি প্রচলনের জন্য উচ্চ আদালতে একটি নির্দেশনা চেয়ে একটি রিট হয়েছে সম্প্রতি। আইনজীবী ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভুঁইয়ার ওই রিটে রুল জারি করেছে হাইকোর্টে।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় ই-জুডিশিয়ারির উপকারিতা-অপকারিতা এবং এর মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবের বিস্তারিত নিয়ে ঢাকা টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন রিট আবেদনকারী আইনজীবী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা টাইমসের সিনিয়র রিপোর্টার আমিনুল ইসলাম মল্লিক।

ঢাকা টাইমস: আপনি ই-জুডিশিয়ারি চালুর জন্য রিট করেছেন। ই-জুডিশিয়ারি সম্পর্কে কিছু শুনি।

ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভুঁইয়া: আসলে ই-জুডিশিয়ারি হলো আমাদের দেশের যত বিচারকক্ষ বা আদালত কক্ষ আছে সেগুলো তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসা। ই-জুডিশিয়ারিতে কাগজের ব্যবহার কম থাকবে। এখানে ইলেক্ট্রনিক বায়োমেট্রিক সিস্টেমে অ্যাটেনডেন্স (হাজিরা) থাকবে। অর্ডার (আদেশ) কমিউনিকেশন অনারেবল জাজেসরা যখন কোনো অর্ডার দিবেন বা বায়েডিক (রায়) দিবেন সেক্ষেত্রে বিষয়গুলো নিয়ে কমিউনিকেট করতে হয় সংশ্লিষ্ট রেসপন্ডেন্টদের (বিবাদী) কাছে। বর্তমান মেনুয়াল পদ্ধতিতে কমিউনিকেশনের কাজগুলো করতে অনেক সময় লেগে যায়। কেস নিষ্পত্তি হতে অনেক সময় দেরি হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীদের কষ্ট করতে হয়। পদে পদে তাদের অনেক পয়সা খরচ করতে হয়। এটা আমাদের জন্য হয়রানি।

আরেকটা বিষয় হলো- অটোমেশন সিস্টেমে একটি পদ্ধতি ডেভেলপ করতে হয় ই-জুডিশিয়ারিতে। উন্নত বিশ্বে সেটা আছে। এটা যদি ডেভেলপ হয়ে যায়, কোর্ট রুমগুলো যদি ডিজিটালাইজড তথা তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় পুরোপুরি চলে আসে, তাহলে বিচারপ্রার্থীরা দ্রুত বিচার পাবেন। মামলা-মোকদ্দমা পেন্ডিং থাকবে না। নিষ্পত্তি হয়ে যাবে খুব দ্রুত। আমরা অনেক সময় দেখি কেউ যদি দেওয়ানি মামলা করে মারা যায় তার পরবর্তী প্রজন্মকে সেই মামলার ঘানি টেনে যেতে হয়।

ঢাকা টাইমস: ই-জুডিশিয়ারিতে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমবে বলছেন।

ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভুঁইয়া: অবশ্যই সময় কমবে। এটা ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মতো। ই-জুডিশিয়ারি শুধু অর্ডার কমিউনিকেশনের জন্যই নয়, ই-ফাইলিংও কিন্তু এর মধ্যেই পড়ে। ভিডিও কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে সাক্ষ্য নেয়া যায়। অনেক সময় খুব দুর্ধর্ষ আসামি থাকে, তাকে হাজত থেকে আদালতে আনা-নেয়ার সময় ঝুঁকি থাকে। আসামি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটেছেও। এ ধরনের আসামিদের সশরীরে হাজির না করেও কিন্তু কারাগারে রেখে তাদের কাছ থেকে ভিডিও কনফার্ন্সের মাধ্যমে সাক্ষ্য নেয়া যায়।

ঢাকা টাইমস: আমাদের বিদ্যমান আইন কি এটা সমর্থন করবে?

ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভুইয়া: এটা করতে আবশ্য সাক্ষ্য আইন পরিবর্তন করতে হবে। সেটা আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের ব্যাপার।

আবার, ধরুন ঢাকার বাইরের একজন বিচারপ্রার্থী হাইকোর্টে মামলা করেছেন। তাকে ওখান থেকে ঢাকায় এসে থাকতে হবে। আইনজীবী নিয়োগ দিতে হবে। কত ধাপ পার করে তারপর তাকে ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের আদালতগুলো যদি ই-জুডিশিয়ারির আওতায় চলে আসে। তাহলে ই-ফাইলিং সিস্টেমের সঙ্গে তারা পরিচিত হয়ে যাবে।

এতে করে আইনজীবীরা তাদের পাসওয়ার্ড এবং ইউজার আইডি দিয়ে তাদের মামলাগুলো ফাইল করে ফেলতে পারবেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে। অথবা এমনও আছে বিশ্বে সরাসরি বিচারপ্রার্থীরা তাদের নিজস্ব এলাকা থেকে অনলাইনের মাধ্যমে তাদের আর্জি দাখিল করতে পারে। এই পদ্ধতিতে অনেকটাই অর্থ অপচয় কম হবে। সময় বাঁচবে। মোদ্দা কথা, ডিজিটালাইজেশনের একটা নির্যায়স এটি। আমরা বর্তমান যুগে এটা প্রত্যাশা করতেই পারি।

ঢাকা টাইমস: একটু আগে উন্নত বিশ্বে অটোমেশন ও ই-জুডিশিয়ারি নিয়ে বলছিলেন।

ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভুঁইয়া: আমেরিকা, ইউকে, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশগুলো তো আছেই, এমনকি নাইজেরিয়াতেও আছে। সফলতার সঙ্গে সেখানে এই সিস্টেম চলছে। আমাদের দেশে এটা হওয়া খুব জরুরি বলে আমি মনে করি। লাখ লাখ মামলার জট দেশের আদালতগুলোতে। বিচারপ্রার্থীরা দিনের পর দিন হয়রান হচ্ছে মিডলম্যানদের (বিচারক বাদে আদালতের অন্য লোকজন) কাছে। বিচারপ্রার্থীরা অনেক আশা করে ন্যায়বিচারের জন্য আদালতে আসে। অনেক সময় বিচার বিলম্ব হয়ে যায়। এ কারণে তারা অনেক সময় বিচার নিজের হাতে তুলে নেন। উন্নত বিশ্বে যেহেতু ই-জুডিশিয়ারি আছে, আমাদের দেশেও এটা হওয়া জরুরি।

ঢাকা টাইসম: এটা করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে নিশ্চয়।

ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভুঁইয়া: রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিতে হবে। বিচার বিভাগ থেকে রাষ্ট্র অনেক রাজস্ব পাচ্ছে। এই রাজস্ব থেকে ইচ্ছা করলে অর্থের জোগান দিতে পারবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রের তো জুডিশিয়ারির জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকেই।

ঢাকা টাইমস: সার্ভার ডাউন অথবা হ্যাক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে ই-জুডিশিয়ারিতে।

ফরহাদ উদ্দিন আহেমদ ভুঁইয়া: এটা কিন্তু একেবারেই ইন্টারনেট ভিত্তিক হবে না। কাগজের কাজও থাকবে কিছুটা। এবং এটার জন্য স্পেশাল ব্যাকআপ থাকবে। এটি যেন হ্যাকিং না হয় সে বিষয়টিও অনেক সতর্কতা ও যত্নের সঙ্গে ব্যবস্থাপনা করতে। শক্তিশালী পাসওয়ার্ড থাকবে। আইটি বিশেষজ্ঞরা এগুলো নিয়ে কাজ করবেন। আমাদের দেশে কিন্তু মন্ত্রণালয়সহ অনেক জায়গায় এ রকম কাজ হচ্ছে। আশা করি, দেশি-বিদেশি আইটি বিশেষজ্ঞরা কাজ করলে কোনো সমস্যা হবে না।

আমাদের ফৌজদারি কার্যাবিধি ও সংবিধান অনুযায়ী একজন আসামি দ্রুত সময়ের মধ্যে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারী। রাষ্ট্রকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

ঢাকা টাইমস: আপনাকে ধন্যবাদ।

ফরহাদ উদ্দিন আহেমদ ভুঁইয়া: ঢাকা টাইমস ও আপনাকেও ধন্যবাদ।

গত বছরের ১১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ই-জুডিশিয়ারি পদ্ধতি চালু করার নির্দেশনা চেয়ে রিট করেন এই আইনজীবী। শুনানি শেষে গত ১৯ জানুয়ারি আদালতে ই-জুডিশিয়ারি ও ই-কোর্ট রুম দ্রুত স্থাপনে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন।

আদেশের পর ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, আদালত রুল জারির পাশাপাশি ৯০ দিনের মধ্যে ই-জুডিশিয়ারি স্থাপনের বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর চার সপ্তাহের মধ্যে আইন সচিব, আইসিটি সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, অর্থ সচিবসহ সংশিøষ্ট নয় বিবাদীকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

রিটে বলা হয়, বিশ্বের অনেক দেশের আদালতসমূহ ই-জুডিশিয়ারির আওতাভুক্ত, যা গ্রিন কোর্ট কনসেপ্টকে প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থাৎ বিচার বিভাগ ডিজিটাল হলে কাগজের ব্যবহার কমবে, ফলে গাছ বেঁচে যাবে। এছাড়া মামলাজটের কারণে বিচারপ্রার্থীর সময় ও সম্পদ (অর্থ) নষ্ট হচ্ছে যা সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ পরিপন্থি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

আদালত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আদালত এর সর্বশেষ

পরিবেশ রক্ষায় ঢাকাসহ সারাদেশে গাছ কাটা বন্ধে হাইকোর্টে রিট

এ জে মোহাম্মদ আলীর সম্মানে আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকাজ বন্ধ ঘোষণা

সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী আর নেই

লভ্যাংশের টাকা আত্মসাৎ মামলা: ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি আজ

সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিচার বিভাগ আরও শক্তিশালী হবে: প্রধান বিচারপতি

জি কে শামীমের জামিন ঘিরে আবারও প্রতারণা, এক সপ্তাহ নিষিদ্ধ আইনজীবী 

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের বিরুদ্ধে মামলা

ধর্ষণ মামলায় মুশতাক-ফাওজিয়ার স্থায়ী জামিন

ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ হাইকোর্টের

টিপু-প্রীতি হত্যাকাণ্ড: আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফসহ ৩৩ জনের বিচার শুরু

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :