বিরহী নিসর্গের বিলাপ

নূরুন্নাহার মুক্তা
  প্রকাশিত : ১০ মার্চ ২০২০, ১২:১০| আপডেট : ১০ মার্চ ২০২০, ১২:৩০
অ- অ+

বৃক্ষসখা মোকারম হোসেনের নিসর্গ আখ্যান গ্রন্থটি পাঠ করে উপর্যুক্ত শিরোনামটি ছাড়া আর কিছু মনে এলো না। কারণ, গ্রন্থের প্রায় প্রতিটি লেখায় কান পাতলে নিসর্গের বিলাপই শোনা যাবে। সবুজে মোড়ানো এই দেশে আমাদের অগোচরে প্রকৃতি ধ্বংসের এক মহাযজ্ঞ চলছে। লেখক অকপটে সেসব কথাই বলার চেষ্টা করেছেন। তিনি ঘুরেছেন সারা দেশে। বন-পাহাড়, বিল-হাওর আর পার্ক-উদ্যান তার মধ্যে অন্যতম। তবে এসব লেখায় সব কিছু ছাপিয়ে উদ্ভিদই রয়েছে মূল কেন্দ্রে। প্রায় প্রতিটি লেখা আবর্তিত হয়েছে উদ্ভিদকে ঘিরে। এসব লেখায় উদ্ভিদ নিয়ে লেখকের গভীর ভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে। প্রায় এক দশক ধরে লেখক দেশের বনাঞ্চল, নদী, পাহাড় ও বিল-হাওর ঘুরে এই লেখাগুলো তৈরি করেছেন। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার পাশাপাশি নিজস্ব পর্যবেক্ষণ লেখাগুলোকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। শালবনের কফিনে শেষ পেরেক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘১৯৮৭ সালের দিকে বন বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় বনের ভেতর বিদেশি গাছ লাগানো আরেকটি আত্মঘাতী কাজ। শালবনকে নতুনভাবে জেগে ওঠার সুযোগ না দিয়ে কৃত্রিমভাবে বন তৈরির চেষ্টা খুবই হাস্যকর ও হঠকারী উদ্যোগ। এক সময় আয়তনের দিক থেকে দেশের সমতল অঞ্চলে সম্ভবত শালবনই সবচেয়ে বড় ছিল। এমনকি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভারত পর্যন্ত ছিল এর বিস্তৃতি। অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার তথ্য মতে, ভারতের ডুয়ার্স থেকে মেঘালয়ের গারো পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত শালবন গোটা বরেন্দ্র অঞ্চল হয়ে ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। প্লিয়োস্টিন যুগের ২ লক্ষ বছর আগে শেষ ভূমিকম্পে সৃষ্ট লালমাটির আত্মজ এই শালবন খুবই প্রাচীন [নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা]।’ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ইকোসিস্টেম এই শালবনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘শালবন নিয়ে নৈরাজ্যের যেন আর শেষ নেই। এসব দেখারও যেন কেউ নেই। কাগজে-কলমে বন বিভাগ শালবনের অভিভাবক হলেও তারা যে বন রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ সে কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। অথচ আমরা কেউ কি একবারও ভেবেছি, শালবন ধবংস হওয়া মানে দেশের একটি অন্যতম প্রাণ-ভাণ্ডারের বিলুপ্তি ঘটা। কারণ শালবন আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইকোসিস্টেম। শালবন মানে শুধু শালগাছই নয়, অসংখ্য লতাগুল্ম, অন্যান্য বৃক্ষ ও বিচিত্র প্রাণীদের আবাসও এখানে। গবেষকদের মতে, এই বনে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৫ শতাধিক প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্মের বসবাস।’ মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া বনসহ প্রায় সব বন সংরক্ষণে সরকারের উদাসীনতা লক্ষণীয়। প্রসঙ্গত তিনি লিখেছেনÑ ‘২০০৮ সালে বহুজাতিক গ্যাস-তেল অনুসন্ধান কোম্পানি শেভরন লাউয়াছড়া বনাঞ্চলে ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ পরিচালনা করে। জরিপ কাজে ৯ হাজার বিস্ফোরণ ঘটানো হয় বলে জানা যায়। বিস্ফোরণ শব্দের মাত্রা ছিল প্রায় ৭৫ দশমিক পাঁচ ডেসিবল। কিন্তু তখন বন এলাকায় এ ধরনের ক্ষতিকর জরিপ কাজ থামানোর জন্য পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো নানাভাবে আপত্তি তুললেও সরকার ছিল নির্বিকার [লাউয়াছড়ার বিপন্ন বন]।’ এমন অসংখ্য তথ্য ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ নিসর্গ আখ্যান গ্রন্থটি।

প্রকৃতির নিজস্ব জীবনচক্র ও আন্তঃপ্রক্রিয়ার বহুমাত্রিকতা নিসর্গ আখ্যান গ্রন্থের প্রাণ। একাধিক শিরোনামে বিন্যস্ত ছোট-বড় প্রায় ৪৫টি প্রবন্ধ এখানে স্থান পেয়েছে। প্রতিটি লেখাই ইতিপূর্বে কোনো না কোনো পত্রিকা-সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। এসব লেখায় প্রকৃতির প্রতি আমাদের মনোভাবের কথা সবিস্তারে উঠে এসেছে। দেশজুড়ে প্রকৃতি ও বন ধ্বংসের যে মহোৎসব শুরু হয়েছে মোটাদাগে তারই কিছু খণ্ডচিত্র এখানে পাওয়া যাবে। প্রকৃতির নানান অসংগতির কথা অনেকটা আর্তনাদের মতোই। কিন্তু প্রকৃতির এসব আর্তনাদ নির্বিকার কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছায় কি না তা আমাদের জানা নেই। তবে আমাদের বিশ্বাস কখনো বা কখনো, কেউ না কেউ এই কথাগুলো পড়বেন, প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখবেন, প্রকৃতি সংরক্ষণ করারও চেষ্টা করবেন।

দেশের বিশিষ্ট লেখক, রাষ্ট্রনায়ক এবং ভিনদেশি বৃক্ষবিদের বৃক্ষ-মনস্ক ভাবনা এই বইয়ের বিশেষ দিক। আছে বিলুপ্ত কয়েকটি উদ্যানের বর্ণনা। ইংলিশ রীতিতে তৈরি বাগানের প্রসঙ্গ। ছয় ঋতুর শহর এবং পুষ্প উৎসববিষয়ক স্বপ্নের কথা। সদিচ্ছা থাকলে ছয়টি বিভাগীয় শহরকে ছয় ঋতুর প্রাধান্য দিয়ে গড়ে তোলা যেতে পারে। ঢাকা হতে পারে ছয় ঋতুর শহর। এখন যদিও বছরের অর্ধেকটা সময় ঢাকা শহর বিবর্ণ ও নি®প্রাণ থাকে। ছয় ঋতুর শহর হলে প্রায় সারা বছরই নান্দনিক পুষ্প-বৃক্ষে সুশোভিত থাকবে রাজধানী। আমরা অনেকেই জানি, শুধুমাত্র একটি ফুল নিয়ে জাপানে চেরি উৎসব হয়। কানাডায় হয় পপি উৎসব। অথচ গ্রীষ্মে আমাদের জারুল সোনালু কৃষ্ণচূড়ার বর্ণাঢ্য প্রস্ফুটন নিয়ে চমৎকার পুষ্প উৎসব হতে পারে। বিভিন্ন আলোচনায় লেখক মূলত এসব স্বপ্নের কথাই বুনেছেন।

ঐতিহাসিক বলধা গার্ডেনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। রেসকোর্স বন্ধ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তৈরির অনন্য দৃষ্টান্তও স্থাপন করেন এই মহান রাষ্ট্রনায়ক। মোকারম হোসেন লিখেছেন- ‘তিনি ১৯৭২ সালে রমনা মাঠে (রেসকোর্স ময়দান) ঘোড়দৌড়ের মাধ্যমে জুয়াখেলা বন্ধ করেন। নারিকেলের চারা রোপণের মধ্য দিয়ে একটি উদ্যান তৈরির উদ্বোধন করে উদ্যানটির নামকরণ করেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এখন নগরীর কোটি কোটি মানুষের ফুসফুস সচল রাখার গুরুদায়িত্ব পালন করছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে এই যে উদ্যান যাত্রা তা এখন অনেকটাই বিস্মৃত [বঙ্গবন্ধুর বৃক্ষপ্রেম]।’

লেখকের ব্যক্তিগত অনুসন্ধানে ঢাকার শতবর্ষী বা শতোর্ধ্ববর্ষী কিছু বৃক্ষের খবরাখবর এখানে পাওয়া যাবে। বিশ্বব্যাপী বৃক্ষ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র প্রাণিজগৎ নিয়ে যে মাতামাতি শুরু হয়েছে তা খণ্ডিত মনোভাবেরই নামান্তর। বৃক্ষ ছাড়া প্রাণী যেমন বাঁচতে পারে না তেমনি গাছপালার বংশপরম্পরার ক্ষেত্রেও প্রাণী ও পতঙ্গদের দরকার। এই বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কাজেই প্রকৃতি সংরক্ষণে আমাদের একপেশে মনোভাব পরিহার করে সমগ্র প্রাণীবৈচিত্র্য নিয়েই ভাবা উচিত। এমন উদার ভাবনাই কেবল আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে। নিসর্গ আখ্যান গ্রন্থে মূলত এসব কথাই বারবার উঠে এসেছে।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
জাতীয় প্রেস ক্লাবের বিবৃতি: মিডিয়াকে হুমকি প্রদানের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ
কুমিল্লায় নার্সারি থেকে বৃদ্ধের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার
ঝিনাইদহে সুদীপ হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার দাবিতে মানববন্ধন
সখীপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে কৃষকের মৃত্যু
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা