মানুষকে বোকা বানানোর প্রতিযোগিতা!

আগের চেয়ে মানুষ এখন বেশি সচেতন। এখন লেখাপড়ার প্রতিও ছেলেমেয়েদের ঝোঁক বেশি। বর্তমান সময়ে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে মানুষ দেশ-বিদেশের খোঁজ একটু বেশি রাখে। হাতে হাতে স্মার্টফোন থাকায় মুহূর্তের মধ্যেই সবকিছু জেনে যায় মানুষ। বর্তমান সময়কে বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগ। প্রযুক্তির প্রসার মানুষের জীবনযাত্রাকে একেবারে সহজ করে দিয়েছে। মানুষের অনেক কাজই করে দিচ্ছে রোবট। বলা হচ্ছে, সামনে উৎপাদন ক্ষেত্রে শ্রমিকদের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হবে এই রোবট।
কিন্তু একদিকে মানুষ যতই এগোচ্ছে, মানুষকে বোকা বানানোর পদ্ধতি ততোই সূক্ষ্ম হচ্ছে। কে মানুষকে কত অভিনব উপায়ে বোকা বানাতে পারে চলছে সেই প্রতিযোগিতা। কিছু উদাহরণ দেখলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কথা দিয়েই শুরু করি। এখন এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘সামাজিক ব্যাধি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে গুজব ছড়ানোর সবচেয়ে সহজ মাধ্যম এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম (ফেসবুক, টুইটার, ভাইবার, ইউটিউব ইত্যাদি)। চটকদার শিরোনাম দিয়ে এখন ইউটিউবে মানহীন এবং অনেক ক্ষেত্রে অশ্লীল এমন কিছু ভিডিও ছাড়া হয় যা মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে। এসবে শিক্ষণীয় কোনো বিষয়ও থাকে না। মানুষের গুরুত্বপূর্ণ সময়কে খেয়ে দিচ্ছে এসব মাধ্যম।
এখন ইন্টারনেট মানুষের জন্য সহজ করে দেয়া হচ্ছে। স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট পেয়ে স্কুল-কলেজপড়ুয়ারা পড়াশোনা বাদ দিয়ে ডিভাইস নিয়ে মশগুল থাকছে। আমার কাছে মনে হয়, ইন্টারনেটের ব্যবহার সবক্ষেত্রে একেবারে উন্মুক্ত করে দেয়া ঠিক হবে না। কার কতটুকু প্রয়োজন সেটা দেখে নির্ধারণ করে দিতে হবে যে, কে কতটুকু ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে। সেটা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, সর্বোপরি দেশের জন্যই মঙ্গল হবে বলে মনে করি।
কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধুর ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার থেকে আমার ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে একটি ম্যাসেজ এসেছিল। তাতে লেখা ছিল, ‘রকেটে জরুরি ভিত্তিতে আমাকে ৩/৪ হাজার টাকা পাঠাতে পারবি? উপকার হতো। আর সমস্যা নাই। টাকা কাল সকালেই দিয়ে দেব ইনশাল্লাহ।’
কিন্তু আমি টাকা দেয়নি। কিছুদিন পর আমার বন্ধু আমাকে ম্যাসেঞ্জারে জানায়, ‘বন্ধু আইডি হ্যাক হইছিল। এখন ফিরে পেয়েছি।’ আপনার আমার চারপাশে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। অনেকে এই পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনছে।
ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখলাম। সেখানে একজন প্রবাসী বাংলাদেশি আর্তনাদ করছেন। তিনি ওমানের একটি মরুভূমিতে থাকেন। সেখানে এক মালিকের উট ও ছাগল চরান। সেখানে তারা কয়েকজন মিলে থাকেন। খুবই মানবেতর জীবন যাপন করেন। ভিডিওতে ওই ভাই দুঃখ নিয়ে বলছেন, ‘তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে এসেছি। যার মাধ্যমে এসেছি সে বলেছিল, দোকানে কাজ দেব। ভালো বেতন। কিন্তু এখানে এসে মরুভূমি এই কাজ (ছাগল চরানো) করছি। আমার মতো এরকম ভুল কেউ করবেন না।’
দিন যাচ্ছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। সুতরাং, মানুষ এখন আধুনিক সব জিনিসপত্র ক্রয় করতে পারছে। এই সুযোগেও মানুষকে বোকা বানানোর সুযোগ নিচ্ছে অনেকে। কয়েকদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম, ত্বক ফর্সাকারী ১৩টি স্কিন ক্রিম পরীক্ষা করে ছয়টিতে বিপজ্জনকমাত্রার পারদ পেয়েছে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। এছাড়া দুটি ব্র্যান্ডের ক্রিমে মাত্রাতিরিক্ত পারদের পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত হাইড্রোকুইনোন পাওয়া যায়। বিএসটিআই জানিয়েছে, মাত্রার চেয়ে বেশি পারদ ও হাইড্রোকুইনোন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এসব ক্রিম দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ হতে পারে।
অথচ যেসব ব্র্যান্ডে এমন ক্রিম পাওয়া গেছে, বাংলাদেশের বাজারে তা অহরহ পাওয়া যায় এবং সেসব ব্র্যান্ড খুব জনপ্রিয়। এসব ভয়ানক সব ক্রিমই ব্যবহার করে চলেছে লাখ লাখ মানুষ।
গণমাধ্যমের খবরে আমরা প্রায়ই দেখি, জাল টাকা তৈরির চক্র আটক, দোকানে অভিযান চালিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ আটক, মানবপাচারের সময় পাচারকারী আটক ইত্যাদি। বর্তমানে সারা বিশ্বে এমন অসংখ্য প্রতারণা চলছে। আর এসব প্রতারকদের টার্গেট মানুষ। অর্থাৎ, বনে বন্যপ্রাণীরা যেমন আরেক বন্যপ্রাণীকে শিকারের টার্গেট করে, ঠিক তেমনই চলছে এই মানবসমাজে।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী

মন্তব্য করুন