রাজধানীতে বেড়েছে ছিনতাই!

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৪৪| আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:১৫
অ- অ+

শুক্রবার রাত ৯টায়। বাসায় ফিরছিলেন সুমন চন্দ্র বর্মণ। আদাবর এলাকা থেকে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান যাওয়ার পথে নবোদয় হাউজিং এলাকায় আট থেকে দশজন ব্যক্তি তার পথরোধ করে। এ সময় চাইনিজ চাপাতি দিয়ে সুমনের পায়ে আঘাত করে মোবাইল ফোন ও নয় হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সুমন বলেন, ‘আমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। কয়েকটা ছেলে এসে আমাকে ধরল। তাদের হাতে ছুরি, চাপাতিও ছিল। তারা আট-দশজন ছিল, আমি একা। আমার পকেট থেকে মোবাইল, টাকা সব বের করে নিয়ে গেল। রাস্তায় অনেক মানুষ ছিল। পাশে দুইটা চায়ের দোকান। আমি সবাইকে বললাম। কেউ আমাকে কোনো হেল্প করল না। উল্টো কয়েকজন বলল, চলে যাও, নইলে তোমাকে মেরে ফেলবে।’

এ ঘটনায় আদাবর থানায় অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ ছিনতাইয়ের মামলা করতে বলে। কিন্তু মামলার ভোগান্তি এড়াতে মোবাইল ফোন ও টাকা হারিয়ে গেছে উল্লেখ করে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন এই কিশোর।

সুমন যেখানে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন, সেখানে গিয়ে জানা যায়, গত এক সপ্তাহে ওই জায়গায় অন্তত পাঁচটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। মাস দুয়েক আগেও ছিনতাইয়ের প্রবণতা এতটা ছিল না বলে জানান স্থানীয় লোকজন।

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক বাসিন্দা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘প্রতিদিন সন্ধ্যার পর নবোদয় থেকে ঢাকা উদ্যান যাওয়ার পথে যে কালভার্ট, সেখানে শেখেরটেক থেকে ছেলেরা আসে। ছিনতাই করে। এলাকার কিছু পোলাপানও জড়িত। সবাই জানে। কেউ কিছু বলে না। এমন ঘটনা তো মাস খানেক ধইরা। আগে এমন ছিল না।’

ঢাকাটাইমসের অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেখেরটেক ৬ নম্বর সড়কের আফসু মিয়ার বাড়ির পাশে ভাঙারির দোকান এবং ময়লার ডাস্টবিনে কাজ করা ছেলেরা এই ছিনতাই করে থাকে। তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শ্যামলী হাউজিং এলাকার একাধিক দল সহযোগিতা করে।

কেবল নবোদয় হাউজিংয়ের এই জায়গাতেই নয়, মোহাম্মদপুর থানা এলাকার মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড, বেড়িবাঁধ তিন রাস্তার মোড়, লাউতলা, কাটাসুর, শ্যামলি, কলেজগেট, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের লেগুনা থেকে পকেট মারার ঘটনা এখন নিয়মিত।

এছাড়া আদাবর থানা এলাকার শেখেরটেক, আদাবর ১০, ১৬ নম্বর, মনসুরাবাদ, সুনিবিড় হাউজিং, বেড়িবাঁধ সংলগ্ন তুরাগ হাউজিং, হাড্ডিপট্টি, স্লুইজ গেট, আহমেদ নগর এলাকার ঘুরে ছিনতাইয়ের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া গেছে।

গাবতলী দ্বীপনগর এলাকার বাসিন্দা শাহজালাল বলেন, ‘বেড়িবাঁধে তো লাইট নাই। সন্ধ্যার পর অন্ধকারে ছিনতাইকারীরা খুব সহজে ছিনতাই করার সুযোগ পায়। আশপাশের লোকজন ভয়ে কেউ কিছু বলে না। কারণ ছিনতাইকারীদের কাছে ছুরি থাকে।’

বেড়িবাঁধ বুড়িগঙ্গা ফিলিং স্টেশন থেকে আহমেদ নগর পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে ওত পেতে থাকে চারটি দল। এই ছিনতাইকারীদের সবাই আদাবর ও তুরাগ হাউজিং এলাকার বাসিন্দা।

জেনেভা ক্যাম্প সূত্র জানায়, ক্যাম্পের উত্তর অংশ, বাবর রোড, শ্যামলি, শিশুমেলা, কলেজগেট, শাহজাহান রোড এলাকায় ছিনতাইয়ে জড়িতদের বেশির ভাগই জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা। ক্যাম্পে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়ায় গত দুই মাস ধরে ক্যাম্পের বেশ কিছু সংঘবদ্ধ চক্র বর্তমানে ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল লতিফ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের এলাকাজুড়ে আইন-শৃঙ্খলার টহল আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে ক্রাইমজোন এলাকাগুলো ডিউটিরত টহল গাড়ি বারবার টহল দিচ্ছে। যেকোনো ঘটনায় আমরা দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

গত এক মাসে তিন থেকে চারটি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে বলে ঢাকাটাইমসকে জানান আদাবর থানার উপ-পরিদর্শক মোহাম্মদ আলম। তিনি বলেন, ‘যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আমাদের টহল অব্যাহত রয়েছে।’

মোহাম্মদপুর, আদাবরের পাশাপাশি রাজধানীর গাবতলী, মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা, কল্যাণপুর, সায়েদাবাদ, সদরঘাট, কামরাঙ্গীর চর, হাজারীবাগ এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে।

গাবতলী এলাকার বাসিন্দা শিহাব হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বাস টার্মিনাল, মাজার রোডের কোনায় প্রায়ই ছিনতাই হয়। কে, কারা করে কেউ জানে না। এখন এমন কিছু পোলাপান এলাকায় দেখা যায়, যাদের আগে দেখি নাই।’

মিরপুর-১ নম্বর এলাকার বাসিন্দা রাজু আহমেদ বলেন, ‘সন্ধ্যার পর এখন ফুটওভার ব্রিজে ওঠা ভয়ের। ছোট গলিতে যেতেও ভয় লাগে। পুলিশের টহল আরও বাড়ানো দরকার।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুর বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকা, বাবুবাজার ব্রিজের আশপাশের এলাকা, গাবতলী বেড়িবাঁধ, বাড্ডা এলাকায় ছিনতাকারীরা ব্যাটারিচালিত রিকশায় ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ বুঝে ছিনতাই করে ওই রিকশা করেই পালিয়ে যায়। আর তাদের আড্ডা হয়ে উঠেছে এসব এলাকার রিকশার গ্যারেজ।

এদিকে হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, ইসলামবাগ, পোস্তাসহ আশপাশের এলাকায় ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোন বিক্রির হাঁট বসে বেড়িবাঁধের সেকশন এলাকায়। বেড়িবাঁধ সড়কের দুই পাশে প্রতিদিন বিকালে বসে এই হাঁট। আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোন বিক্রি হয় এসব অস্থায়ী দোকানে। ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোন জানা সত্ত্বেও এসব মোবাইলের খদ্দের কম নয়।

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সেকশন এলাকার একজন চায়ের দোকানি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ছিনতাইকারীরা এদের কাছে মোবাইল বিক্রি করে। এদের একটা সিন্ডিকেট আছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তারা এখানে বসে মোবাইল বিক্রি করে। অনেক সময় দামি দামি মোবাইল ফোনও দেখা যায়। কম দামে পায়, তাই অনেকেই এখান থেকে মোবাইল কিনতে আসে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে লালবাগ থানার ওসি কে এম আশরাফ উদ্দিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার চারজনকে ছিনতাই করা মোবাইল ফোন বিক্রির দায়ে আটক করে আদালতে চালান করা হয়েছে। এছাড়া গত এক বছরে লালবাগ থানা এলাকায় কোনো ছিনতাইয়ের ঘটনা নেই।’

কামরাঙ্গীরচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, বেড়িবাঁধ সড়কটি তাদের আওতাভুক্ত নয়। বেড়িবাঁধের একটি অংশ হাজারীবাগ, আরেকটি অংশ লালবাগ থানার অন্তর্ভুক্ত বলে তিনি জানান।

ওসি বলেন, ‘ছিনতায়ের কোনো অভিযোগ আসেনি আমাদের কাছে, অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। মোবাইল হারানোর অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি, উদ্ধারও করছি।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কামরাঙ্গীচর এলাকার ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ছিনতাইসহ যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আমরা সজাগ রয়েছি। পুলিশি নজরদারি বৃদ্ধি করতে পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছি।

ছিনতাই করা মোবাইল বিক্রি সঙ্গে জড়িত কামরাঙ্গীরচর থানা এলাকার বাসিন্দা নয় বরং তারা লালবাগ এলাকার বাসিন্দা বলে দাবি করেছেন এই জনপ্রতিনিধি।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ওয়ালিদ হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান শক্তভাবেই চলছে। মাদকাসক্তরা নানা অপকর্ম করে থাকে। এছাড়া ছিনতাই দমনে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি এবং নিচ্ছি।’

ভুক্তভোগীদের দাবি, ছিনতাইয়ের ঘটনায় থানায় অভিযোগ করতে গেলে মামলা করতে হয়। মামলার ঝামেলায় জড়াতে চান না অনেকে। তাই তারা মোবাইল ফোন, টাকা বা ব্যাগ হারিয়ে গেছে উল্লেখ করে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।

ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা না করে যারা জিডি করছেন তাদের উদ্দেশে ডিসি ওয়ালিদ হোসেন বলেন, ছিনতাই প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ঝামেলার কথা চিন্তা করে আমরা সবাই এগিয়ে না এলে তো এদের আইনের আওতায় আনা একটু কঠিন হয়। আমি সবাইকে অনুরোধ করব, মামলা অবশ্যই করবেন। তাহলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া আমাদের পক্ষে সহজ হবে।’

(ঢাকাটাইমস/০২সেপ্টেম্বর/কারই/কেএম)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
সুনামগঞ্জ সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহত
মিটফোর্ড হত্যার বিচার দ্রুততম সময়ে হবে: আইন উপদেষ্টা
সিলেট বিভাগের ১৯ আসনে প্রার্থী ঘোষণা খেলাফত মজলিসের
সমুদ্র অভিযানে সাহসিকতার জন্য আইএমওর প্রশংসাপত্র পেল কোস্ট গার্ড
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা