মেয়রের কাছে প্রত্যাশা

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ০৪ নভেম্বর ২০২০, ১২:০৮

বিশেষ অবস্থানে যারা থাকেন, তাদের কাছেই থাকে মানুষের প্রত্যাশা। মেয়ররা এই শ্রেণিভুক্ত। এদিকে মেয়রদের তো বলাই হয় নগরপিতা। শুধু এই হিসেবে নয়, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ্র কাছে প্রত্যাশা আরও অনেক বেশি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, রাজনীতিতে তার উৎস। যা অনেক উপরে। ঝরনার উৎস যেমন পাহাড়ের চূড়ায়। সকলেই জানেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন হিমালয় উচ্চতার। সফল বিপ্লবী ফিদেল কাস্ট্রো যথার্থই বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখেনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ ও রক্তের ধারাবাহিকতায় বরিশালের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ্। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার সাংগঠনিক দক্ষতা।

বিসিসি মেয়র সাদিকের উৎস অতি উপরে হওয়ার কারণে তার কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। বরিশালের বাস্তবতায় আইফেল টাওয়ারের মতো। এই প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছে নানান শ্রেণি, নানান ধাপ। তার কাছে প্রত্যাশা করে না বরিশালে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। অন্তত আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। এই প্রত্যাশীদের কাতারে আমিও আছি। মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ্র কাছে আমার প্রত্যাশা সৃষ্টি হওয়ার প্রধান কারণ হলো, বরিশাল প্রসঙ্গে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর স্মৃতিচারণ। যা পিআইবির প্রকাশনা ‘অগ্রজের সঙ্গে একদিন’ গ্রন্থে মুদ্রিত হয়েছে, প্রকাশকাল জানুয়ারি, ২০১৭।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক ও লেখক, অমর একুশের গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখক ও সাংবাদিকতা জীবন শুরু বরিশাল দিয়ে। স্মৃতিচারণে তিনি বলেছেন, ‘বরিশালে আমার শৈশব কেটেছে। ওখান থেকে মেট্রিক পাস করেছি। বরিশাল তখন অত্যন্ত সমৃদ্ধ শহর ছিল। এখন বড় বড় অট্টালিকা হয়েছে। কিন্তু কালচারের মান অনেক নেমে গেছে। বরিশালে এখন অনেক দৈনিক কাগজ। তখন দুটি কাগজ ছিল। বরিশাল হিতৈষী এবং নকিব। দুটি অত্যন্ত উন্নতমানের কাগজ।’ স্মৃতিচারণে তিনি বলেছেন, ‘কবি কাজী নজরুল ইসলাম বরিশালের পত্রিকায় কবিতা লিখতেন।’ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার স্মৃতিচারণে আরও বলেছেন, ‘সেদিক থেকে আমি নিজকে খুব ধন্য মনে করি যে, বরিশালে ওই সময় আমি ছিলাম।’

আর এই অধম আমি এখন বরিশালে আছি। মাস কয়েক ধরে বরিশালের স্থায়ীবাসী হওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু সোনালি দিনের সেই দিনের তুলনায়, এমনকি ১৯৭৮ সালের বিবেচনায়ও সেই বরিশাল খুঁজে পাই না। হয়তো আর পাবোই না। তবু আশা করতে চাই। আশা ভবিষ্যতের। বর্তমানে আমার আহাজারি, ‘হায় বরিশাল!’

কেবল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী নন, বরিশাল দিয়ে অনেকেই লেখক-সাংবাদিক হয়েছেন। আমি নিজে কিছু হয়েছি কি না, তা নিয়ে নানান কথা হতে পারে। অথবা এ বিষয়টি খুবই তুচ্ছ। তবে যা হয়েছি তাও এই বরিশাল দিয়েই শুরু। বরিশাল কলেজের দেয়াল পত্রিকা তমাল, কলেজ ম্যাগাজিন, খেয়ালীর প্রকাশনা এবং জেলা পরিষদের প্রকাশনা পাক্ষিক বাকেরগঞ্জ পরিক্রমা দিয়ে আমার হাতেখড়ি পর্ব। আর এর সবটাই হয়েছে বরিশাল কলেজের বাংলার শিক্ষক অধ্যাপক মোজাম্মেল হক স্যারের হাত ধরে। এদিক থেকে আমিও সৌভাগ্যবান। যে ভূমিতে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতো মহীরুহ জন্মেছে সেই জমিকে আমার মতো অতিসাধারণ দূর্বাঘাসও গজাবার সুযোগ পেয়েছে।

এর বিপরীত দশা চলছে এখন। গত প্রায় ২৫ বছরের বরিশালের চিত্র কী? সারা দেশকে ছাড়িয়ে সাংবাদিকতায় ভয়ানক এক বৈরী অবস্থা চলছে বরিশালে। এর মধ্যে যারা লেখক-সাংবাদিক তৈরি হয়েছেন, তারা আসলে পুকুরের ইলিশ জন্মানোর মতো বিস্ময়। মাঝেমধ্যে ভাবি, এরা তৈরি হলো কীভাবে! কিন্তু যাদের নিয়ে গর্ব করা যায় তাদের চেয়ে অনেক বেশি জন্মেছে আগাছা। এরা সংখ্যায় অনেক। আগাছার যে প্রবণতা। এরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বরিশাল। অনেকেই আছেন যারা, রাস্তার ভিক্ষুক এড়িয়ে চলেন, কয়েক বছর ধরে প্রায় সকলেই সাংবাদিক এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন বলে শুনেছি। কিছু দেখেছিও। কোনো অনুষ্ঠানেই প্রেসকর্নার জাতীয় কিছু চোখে পড়ছে না বেশ কয়েক বছর ধরে। এ নাকি উপদ্রব এড়িয়ে চলার প্রয়াস।

অনেকেই বলছেন, সাংবাদিকতার নামে একশ্রেণির উল্লুকের উপদ্রব চরমে পৌঁছেছে। নিষ্ঠুর এ বক্তব্যের সঙ্গে জোরালোভাবে দ্বিমত করার সুযোগ খুবই কম। আর এই করুণ দশার সূচনা কিন্তু বেশি দিন আগের ঘটনা নয়। সূত্রপাত ১৯৯১ সালে, বরিশাল রেঞ্জের প্রথম ডিআইজি জিয়াউদ্দিন আহমেদের হাত ধরে। গুণধর এই পুলিশ কর্মকর্তার ছিল প্রচণ্ড ‘নারী দোষ’। এই দোষকে পুঁজি করেই বরিশালের সাংবাদিকতার চরম সর্বনাশের সূচনা করা হয়েছে। পত্রিকার মালিক পরিচয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল এক বিষবৃক্ষ। এর দেখাদেখি মাঠে নেমেছেন আরও অনেকে। এরা অবশ্য ভেড়ান্ডা বৃক্ষও হতে পারেননি। কিন্তু যা হয়েছে তাতেই সর্বনাশের জন্য যথেষ্ট। এদের ছত্রছায়া ধরে তৈরি হয়েছে একটি শ্রেণি। যারা নিজেদেরকে বড় গলায় সাংবাদিক হিসেবে দাবি করেন। কিন্তু মানুষ তাদেরকে আখ্যায়িত করে ভিন্ন নামে।

বরিশালে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এই যে করোনার মতো আতঙ্কের মহামারি দশা বিরাজমান, তা কারও অজানা নয়। আমিও জানি। কিন্তু জানা যায়নি, এই ধারা থেকে উত্তরণের জন্য কারও কোনো প্রয়াসের কথা। এর কারণ এই নয় যে, জানার কোনো চেষ্টা কেউ করেননি। তবু জানা যায়নি। যাবেও না। অন্ধকার কক্ষে কালো বিড়াল অথবা খড়ের গাদায় হয়তো সুচ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু যা নেই, তা কি পাওয়া যায়? যায় না!

এখানেই প্রত্যাশা বিসিসি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ্র কাছে। যিনি রাজনীতিতে এসেছেন পাহাড়ের চূড়া থেকে ঝরনা নেমে আসার মতো। তার কাছে প্রত্যাশা, বরিশাল প্রসঙ্গে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর স্মৃতিচারণের বিষয়টা একটু পড়ুন। কয়েক পৃষ্ঠা মাত্র। আমার ধারণা, নগরভবনকেন্দ্রিক মাফিয়াদেরকে ‘হেদায়েত’ করার সাহস যিনি রাখেন, তিনি বরিশালের বিপন্ন ধারার সাংবাদিকতা সঠিক পথে নেওয়ার সাধারণ উদ্যোগও নিতে পারবেন। এ আশা করতেই পারি। আর এটি তাকে করতেই হবে। তা না হলে নষ্টদের যন্ত্রণায় তিনিও হয়তো একসময় আক্রান্ত হবেন।

অবশ্য তাকে আক্রান্ত করার জন্য ৭৫-এর থিংকট্যাংক তো লেগে আছেই। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমিও অবাক হই না। কিন্তু বিস্মিত হয়েছি, মেয়রবিরোধী ৭৫-এর থিংকট্যাংকের ক্রীড়নক হিসেবে নগ্নভাবে সক্রিয় এক ‘ভাম’ সাংবাদিকের তৎপরতায়। বরিশালের সাংবাদিকতায় বিষবৃক্ষ জন্ম নেওয়ার ক্ষেত্রে এই ‘ভাম’ সাংবাদিকেরও নেপথ্য ভূমিকা ছিল। পেশায় তিনি কালো কাপড়ে চলেন। অনেকে বলেন, ভিতরটাও তার কালো! বরিশালের সাংবাদিকতায় ভয়ানক এক উল্লুককে জোরালো অবস্থান করে দেওয়ার বিনিময়ে এই ‘ভাম’ সাংবাদিক সে সময় প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের নিয়ে পিকনিকে যাওয়ার টাকা পেয়েছিলেন। দৃশ্যত এখন ‘সাংবাদিকতার মহীরুহ’ হিসেবে পরিচিত এই একই লোক, কিসের বিনিময়ে ৭৫-এর থিংকট্যাংকের ক্রীড়নক হয়ে মেয়র সাদিকের বিরুদ্ধে কাজ করছেন, তা আমার জানা নেই। তবে তাকে প্রায় বছর দুই আগে থেকেই আমার সন্দেহ হচ্ছিল। সাদিক আবদুল্লাহ্ মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ১৫ আগস্টের শোকসভায় এই ‘ভাম’ সাংবাদিকের বক্তব্য শুনে আমি বেশ হোঁচট খেয়েছিলাম। বরিশাল প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত সেই শোক সভায় আমি শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলাম।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :