বাসের বক্সে তরুণীর লাশ: ছয় বছর পর রহস্য উন্মোচন

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:৫৮ | প্রকাশিত : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৬:৫৮

ছয় বছর আগে রাজধানীর গাবতলীতে চট্টগ্রাম থেকে আসা একটি বাসের বক্সের ভেতর রাখা ট্রাঙ্কে এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধারের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো ইনভেটিগেশন (পিবিআই)। এ ঘটনায় একমাত্র আসামি ও নিহতের স্বামী রেজাউল করিম স্বপনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

শনিবার দুপুরে পিবিআইয়ের সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআইয়ের উপ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার।

সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইয়ের ডিআইজি বলেন, আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে ঢাকার গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহনের একটি বাস আসে। ওই বাসের ট্রাঙ্কে এক অজ্ঞাতনামা তরুণীর লাশ পাওয়া যায়। ২০১৫ সালের ৩ মে সকাল নয়টার দিকে চট্টগ্রাম এ.কে খান মোড়ে ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে টিকেট কেটে একজন ব্যক্তি একটি ট্রাঙ্ক তুলে দেন বাসের বক্সে। বাসের হেলপারকে বলে সামনের ভাটিয়ারী কাউন্টার থেকে ওই টিকিটের যাত্রী উঠবে। কিন্তু পরবর্তী কাউন্টারে থেকে ওই যাত্রী না ওঠায় বাসটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা করে বিকাল পৌনে ছয়টার দিকে গাবতলীতে পৌঁছায়।

বনজ কুমার মজুমদার বলেন, শেষ গন্তব্যে সকল যাত্রী যে যার মতো তাদের জিনিসপত্র নিয়ে নেমে যান। পরবর্তীতে হেলপার দেখেন একটি ট্রাঙ্ক বাসের বক্সে মালিকবিহীন অবস্থা পড়ে আছে। তখন বাসের চালক ও হেলপার মিলে ট্রাঙ্কটি নামিয়ে দেখেন এটি খুব ভারী। তাদের সন্দেহ হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে দারুসসালাম থানায় খবর দেয়। তখন থানা পুলিশ হাজির হয়ে ট্রাঙ্কটি খুলে একজন অজ্ঞাতনামা তরুণীর লাশ দেখতে পান। পরে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়না তদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠান। লাশের পরিচিতি শনাক্ত না হওয়ায় অজ্ঞাত পরিচয় লাশ হিসেবে দাফন করা হয়। নিহতের কোনো স্বজন না থাকায় ২০১৫ সালের ৩ মে দারুসসালাম থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জাহানুর আলী বাদী হয়ে দারুস সালাম থানায় একটি মামলা করেন। ধারা ৩০২/২০১/৩৪ পেনাল কোড দাখিল করেন। মামলাটি থানায় রেকর্ড হওয়ার পর থেকে শুরুতে প্রায় তিন মাস থানা পুলিশ তদন্ত করে। থানা পুলিশের পরে সিআইডি দীর্ঘ চার বছর তদন্ত করে। কিন্তু লাশের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় এবং হত্যা রহস্য উন্মোচিত না হওয়ায় আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে সিআইডি। সিআইডির দেয়া চূড়ান্ত রিপোর্ট গ্রহণ না করে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দেন।

পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারের নির্দেশে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) ওই মামলাটির তদন্তভারের দায়িত্ব নেন। পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রো উত্তরের ইউনিট ইনচার্জ ও বিশেষ পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলমের তত্ত্বাবধানে তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক আশরাফুজ্জামান নিহতকে শনাক্ত করার জন্য প্রচলিত সকল পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। এরপর ডিআইজির বিশেষ নির্দেশনায় তদন্তকারী কর্মকর্তাকে স্ব-শরীরে চট্টগ্রাম মেট্রো এবং জেলা এলাকার সকল থানায় বিগত ২০১৫ সালে রেকর্ড করা নিখোঁজ জিডিসমূহ অনুসন্ধান করে তথ্য নিয়ে আসার জন্য পাঠানো হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা এক সপ্তাহ নিরলস পরিশ্রম করে ওই সময়ে কাছাকাছি প্রায় দশ বারোটি নিখোঁজ জিডির তথ্য উদঘাটন করে। ওই জিডিগুলোর মধ্যে ২০১৫ সালের ১০ জুন রেকর্ড করা জিডির নম্বর-৫৯৯ মূলে দেখা যায়, খুলনা জেলার দৌলতপুর থানার দেওয়ানা উত্তরপাড়া গ্রামের ইলিয়াস শেখের মেয়ে শম্পা বেগম ওইদিন চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানা এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী শম্পা বেগমের ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান ২০১৫ সালের ১০ জুন পাহাড়তলী থানায় ওই জিডিটি করেন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জিডির সূত্র ধরে তদন্তকারী কর্মকর্তা জিডি রুজুকারী ভুক্তভোগীর ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান এবং শম্পার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য ইলিয়াস শেখের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন তিনি জানতে পারেন, বিগত ২০১৩ সালে অবসরপ্রাপ্ত নৌ বাহিনী সদস্য রেজাউল করিম স্বপন খুলনা তিতুমীর নৌঘাঁটিতে কর্মরত থাকাকালীন শম্পা বেগম হাসপাতালে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট এর কাজ করতেন। হাসপাতালে শম্পার বাবা ইলিয়াস শেখের স্ত্রীর চিকিৎসাকালীন তার মেয়ে শম্পা বেগমের সাথে আসামি রেজাউলের পরিচয় হয়। এই পরিচয়ের সূত্রে প্রথমে প্রেম এবং পরে শম্পাকে তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে স্বপন বদলি হয়ে চট্টগ্রামে চলে আসে। এরপর শম্পাও কিছুদিন পরে চট্টগ্রামে চলে আসে। চট্টগ্রামে শম্পার এক ফুফুর বাসায় কিছুদিন থাকে। এরপর ফয়েজ লেক এলাকায় একটি হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করে। পরবর্তীতে পাহাড়তলী থানার উত্তর গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আনোয়ার হোসেনের টিনশেড বাড়ির একটি বাসায় সাবলেট নিয়ে বসবাস শুরু করে।

বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত একত্রে বসবাস করে। এখানে উল্লেখ্য যে তারা স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলেও বিবাহ করেনি। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে এসব বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য দেখা দিলে আসামি রেজাউল করিম স্বপন শম্পাকে গত ২০১৫ সালের ২ মার্চ গভীর রাতে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে লাশ গোপন করার জন্য একটি ট্রাঙ্কে ভর্তি করে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহনের একটি বাসে তুলে দেয়। সুচতুরভাবে শম্পার বাবাকে জানায়, তার মেয়েকে খুলনার বাসে তুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে শম্পা তার বাবার বাড়িতে না পৌঁছলে তারা বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ভিকটিমের ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান পাহাড়তলী থানায় একটি নিখোঁজ জিডিটি করেন। শম্পার বাবা পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ২৭ মার্চ আসামি রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে নৌবাহিনী চট্টগ্রাম অফিসে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। ভিত্তিতে জানা যায়, ওই আসামি রেজাউল করিম স্বপনকে তার বাহিনী তদন্তে বিভিন্ন অপরাধ সংশ্লিষ্টতার কারণে ২০১৯ সালে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইয়ের ডিআইজি বলেন, ওই মামলাটি হওয়ার পরে দারুসসালাম থানা পুলিশ প্রায় তিন মাস তদন্ত করে। এরপর পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে সিআইডি প্রায় চার বছর তদন্ত করে লাশ সনাক্ত করতে না পারায় আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট সত্য দাখিল করেন। তখন আদালত মামলাটি লোমহর্ষক ও চাঞ্চল্যকর হওয়ায় রহস্য উদঘাটনের স্বার্থে তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন। তখন পিবিআই ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মামলাটির তদন্তভার নিয়ে পিবিআইর একটি চৌকসদল নিরলসভাবে পরিশ্রম করে ভুক্তভোগীর পরিচয় শনাক্ত ও মূল আসামী রেজাউল করিম স্বপনকে গতকাল শুক্রবার ভোরে কুমিল্লা জেলার ইপিজেড এলাকায় ভাড়া বাসা হতে গ্রেপ্তার করে। ওই আসামি ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে ধারায় স্বীকারোক্তমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

ঢাকাটাইমস/২৫সেপ্টেম্বর/এএ/ ইএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

অপরাধ ও দুর্নীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :