নৈতিক স্খলন

খাস কামরার ‘আপত্তিকর’ভিডিও প্রকাশ না পেলে কিংবা 'রিসোর্ট কাণ্ড' উদ্ঘাটিত না হলে কিংবা 'সদ্য টেলিফোন রেকর্ড' সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল না হলে আমরা আমজনতা বুঝতেই পারতাম না যে তথাকথিত সভ্যতা-ভব্যতার দাবিদার, ইংরেজি-আরবিতে অনর্গল ফোরন কাটনেওয়ালা, প্রভাবশালীরা কিংবা প্রভাব বিস্তারকারীরা রাতের আঁধারে কোথায় নেমে যান বা যেতে পারেন কিংবা তাদের লেবাজে, কথায় বা কাজে কতটা তফাত বা এ দেশের ভদ্দরনোক কারা!
যেসব মেকি 'পাবলিক ফিগার' ফেসবুকে ব্লু-ব্যান্ড ধারণ করে কথায়, চলনে-বলনে, সম্পদের গরমে মানুষকে অনুপ্রাণিত বা বোকা বানাতে চেষ্টা করেন এবং তারাই আবার কীভাবে লেংটু হয়ে যান কিংবা তাদের তামাশা নাটকের শেষ অধ্যায় যে কতটা কলঙ্কিত বা হাস্যকর হয়, তা সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের পর আর ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না!
যদিও এসব বেহায়ারা অবৈধ মালামালসহ ধরা পড়েও দাঁত কেলিয়ে হাসেন কিংবা রাতের আঁধারে পালাতে গিয়ে বা কথিত বালাসহ ধরা খেয়েও 'ভি চিহ্ন' দেখিয়ে নিজেদের বীরত্ব দেখাতে ভোলেন না! অবশেষে জনগণ জেগে ওঠেন, সতর্ক হন! তখন একশ্রেণির জনতা এসব বেশরম, ধান্ধাবাজদের কুকর্মের ছবি-ভিডিও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে ভাইরাল করে একেবারেই বিবস্ত্র করে ফেলেন! একেই বলে চোরের দশ দিন, আর গেরস্তের এক দিন। আর এসব ভাইরাল খেলার মঞ্চ তৈরির জন্য জাকারবার্গ ধন্যবাদ পেতেই পারেন!
এখানে প্রশ্ন হলো, নৈতিক স্খলন কি এসব কামালাপ, প্রেমালাপ বা কুরুচিকর ধান্ধা, ভঙ্গি বা বাক্যবাণেই সীমাবদ্ধ?
না, মোটেই না। হাজারো খলকর্মের মধ্যে জনসম্মুখে প্রকাশিত এসব কুকর্ম যৎসামান্যই! আর পর্দার আড়ালেই রয়ে যায় সাড়ে পনেরো আনা! যাই হোক, জাহেরি-বাতেনি ষোলো আনা অপকর্মের জন্যই নৈতিক স্খলন ঘটে মানুষের! তা যতই হোক পর্দার আড়ালে কিংবা অন্ধকারে। বৃক্ষের আগা ভেঙে দিলে যেমন তার ঊর্ধ্ববৃদ্ধি সম্ভব নয়, তেমনি যেকোনো অপকর্মই মানুষের বড়ত্বকে বিনষ্ট করে, বাধাগ্রস্ত করে। অর্থাৎ মানুষ প্রকাশ্য-গোপনে যেভাবেই ন্যায়বিচার, সততা, নৈতিক সদগুণের বিপরীত কোনো কিছু করে, তখনই নৈতিক স্খলন ঘটে মানুষটির!
এই নৈতিক স্খলন বা অপকর্ম এমনই মোহ যা বড়শিতে ঘেরা টোপের মতো মানুষকে আচ্ছাদন করে রাখে, যাকে লালসা বলা যায়। এই টোপ গিলে ফেললেন তো আটকে গেলেন চিরতরে! সামনে শুধু রঙিন চশমা আর মরিচিকা! খালি দৌড়াবেন! এই দৌড়ে মানুষ ক্ষমতা বা সুবিধার জন্য একদিকে যেমন তোয়াজ করে, পা চাটে, আবার অন্যদিকে তোয়াজ করুক বা পা চাটাতে চাইবে! এই কানামাছি খেলায় সুখের দেখা পাওয়া একেবারেই অসম্ভব! কারণ পৃথিবীর কোনো অপকর্মই মানুষকে সুখ দিতে পারে না! একে সুখের নামান্তরে অসুস্থতা ও অস্থিরতা বলতে পারেন! অথচ নির্বোধ মানুষ একেই মর্যাদা ও বড়ত্ব মনে করে!
সুতরাং বলতে পারি যে, নৈতিক স্খলন মানুষ হিসেবে একজন মানুষের সমৃদ্ধির পথ অবরোধ করে! আপনি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি কিংবা সাধারণ মানুষ- যেই হোন না কেন, মানুষ তো! আর নৈতিকতার মানদণ্ডের নিচে যখনই নামলেন তখনই আপনি পশু! তা রাতের আঁধারে হলেও! মনে রাখবেন, পাপ আর আগুন কখনো চাপা থাকে না!
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই হলো, সে নিজে চোর-বদমাশ হলেও তার নেতা, গুরু বা অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের চরিত্রটি ফুলের মতো বা দুধের মতো সাদা চায়! যদি এতে বিন্দুমাত্র কালিমা লাগে, তখনই সে গুরুর পিছনে উল্টো স্লোগান দিতে থাকবে! অর্থাৎ মুহূর্তেই ৩৬০ ডিগ্রি টার্ন! সুতরাং সাধু সাবধান! মনে রাখবেন, নৈতিক স্খলনে আপনার পতন ও পচন অবধারিত; আজ নয়তো কাল।
আজকের এই অধঃপতিত সমাজে বাস করেই বিশ্বাস করি, যেদিন মানুষ শালীন, ভদ্র, নম্র, দয়ালু ও রুচিশীল হতে শিখেছিল, সেদিন থেকেই সভ্যতার সোপান রচনা শুরু! যেসব জাতি আজ সভ্যতার দাবিদার, তারা নিকট অতীতেই অসভ্য, বেহায়া, স্বার্থপর, পাপাচারী ও প্রতারক ছিল!
তাই আশা নিয়েই বলছি, আসুন, আমরা পরিবার কিংবা স্কুল থেকেই সন্তানদের নৈতিকতা শিক্ষা দান শুরু করি; এবং আজই! সবার আগে নিজেকে বদলাতে হবে। নতুবা আপনার সন্তানই আপনার কান্নার কারণ হবে একদিন! এ তো গেল ব্যক্তিজীবন! নৈতিকতার চর্চা ও প্রসার না ঘটলে জাতীয় জীবনেরও সব অর্জন, সব উন্নয়ন ধুলোর আস্তরে ঢেকে যাবে একদিন! আপনি কি চাইবেন, এই সুন্দর পৃথিবী ধীরে ধীরে নষ্টের হাতে চলে যাক?
লেখক: ক্লিন অ্যান্ড গ্রিন ফাউন্ডেশন ও গরিব ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠাতা।

মন্তব্য করুন