অভিযানেও থামছে না পেট্রোল পাম্পের কারসাজি

দেশজুড়ে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অব্যাহত অভিযানের পরও থামছে না পেট্রোল পাম্প ও ফিলিং স্টেশনের কারচুপি-কারসাজি। জরিমানা বা সিলগালা করার মতো দণ্ড প্রদানসহ ধারাবাহিক অভিযানও পেট্রোল পাম্পগুলোর অনিয়মের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। চলমান অভিযানের মধ্যেও প্রতিনিয়তই ঠকছেন ক্রেতারা। গত তিন দিন ধরে রাজধানীতে অন্তত ৩০টি পেট্রোলপাম্পে অভিযান চালানো হয়েছে। এসময় নয়টি পেট্রল পাম্পকে মোট সাড়ে আট লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সিলগালা করা হয় একটি মেশিন।
সর্বশেষ পরিমাণে তেল কম দেওয়ার অভিযোগে বৃহস্পতিবার রাজধানীর কল্যাণপুরের সোহরাব ফিলিং স্টেশনকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর।
বৃহস্পতিবার ওই অভিযোগের শুনানিতে বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় সোহরাব ফিলিং স্টেশনকে এ জরিমানা করা হয়েছে। একইসঙ্গে ওই টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয় অভিযোগকারী শেখ ইশতিয়াককে।
এদিকে ধারাবাহিক অভিযানের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবারও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চলেছে। জরিমানাও করা হয়েছে কয়েকটি পেট্রোল পাম্পকে। অভিযানে একের পর এক পাম্পে মিলছে নানান অনিয়ম। গাড়ি ও মোটরসাইকেলসহ পেট্রোল-অকটেন ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, পেট্রোল পাম্পগুলো এখন ক্রেতা ঠকানোর যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।বিএসটিআই ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, এসব অভিযোগে বেশকিছু পেট্রোল পাম্পকে জরিমানা ও সিলগালা করেও তেল কম দেয়ার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ কারণে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
এসব অনিয়ম ঠেকাতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের এই প্রতিষ্ঠান দুটির কর্মকর্তারা বলছেন, পেট্রোল পাম্পের এই জালিয়াতি থামাতে তারা কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানের ফিলিং স্টেশনে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ওজনে কম দেয়ার অপরাধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক শাস্তি দেয়া হচ্ছে। আদায় করা হচ্ছে জরিমানা। পাশাপাশি পাম্প মালিকদের সতর্ক করা হচ্ছে। এরপরও ওজনে কম দেয়ার প্রবণতা থামানো যাচ্ছে না।
পেট্রোল পাম্পগুলোতে তেল কম দেওয়ার অভিযোগ বেশ পুরোনো। দিনের পর দিন এমনটা চললেও প্রতিকার মিলছিল না। সম্প্রতি কল্যাণপুরে তেল কম দেওয়ায় এক যুবকের প্রতিবাদের মুখে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হলে নড়েচড়ে বসে বিএসটিআই ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এরপর গত মঙ্গলবার থেকে শুরু করে দেশজুড়ে পেট্রোলপাম্পে ধারাবাহিক অভিযান চলে।পেট্রোল পাম্পে হানা দিলেই মিলছে অনিয়ম
ধারাবাহিক অভিযানের তৃতীয় দিন বৃহস্পতিবার রাজধানীর কল্যাণপুরে তালুকদার ফিলিং স্টেশনে অভিযান চালায় বিএসটিআই। এ সময় কারসাজি ধরা পড়লে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ফিলিং স্টেশনটিতে এর আগেও অভিযান চালিয়ে অনিয়ম পেয়ে জরিমানা করেছিলো বিএসটিআই। ওই জরিমানা করার পরেও এখানকার অনিয়ম বন্ধ হয়নি।
অভিযানকালে ফিলিং স্টেশনটির আটটি ইউনিট পরীক্ষা করা হয়, যার মধ্যে ছয়টি ইউনিটে ৪০-৬০ মিলি লিটার তেল কম দেয়ার বিষয়টি নজরে আসে বিএসটিআই ভ্রাম্যমাণ দলটির। এরপর দ্বিতীয় বারের মতো ওই পেট্রোল পাম্পকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এসময় পেট্রোল পাম্পের লোকজন বিএসটিআই কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।
ফিলিং স্টেশনটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক কামাল হোসেন মাসুম তেল কম দেয়ার বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দেন- যাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে অভিযানকারী দলের প্রধান বিএসটিআইর উপপরিচালক রিয়াজুল হক বলেন, ‘ফিলিং স্টেশনের চারটি ইউনিটে ১০ লিটারের মধ্যে ৩০ মিলি লিটারের (মি.লি.) অতিরিক্ত তেল কম দেয়া অনিয়ম।’
তিনি বলেন, ‘পেট্রোল পাম্পগুলো ১০ লিটারে ৩০ মি.লি. পর্যন্ত কম এবং ১২০ মি.লি. পর্যন্ত বেশি দিতে পারবে।’
এরপর বিএসটিআইর ভ্রাম্যমাণ দলটি রাজধানীর আসাদ গেট এলাকার ‘সোনার বাংলা’ এবং শ্যামলী এলাকার শাহী ফিলিং স্টেশনে অভিযান চালায়।
এর আগে টানা অভিযানের দ্বিতীয় দিন গত বুধবার বিএসটিআইয়ের ভ্রাম্যমাণ দল অভিযান চালায় রাজধানীর বাড্ডা, মালিবাগ ও তেজগাঁওয়ের চারটি ফিলিং স্টেশনে। এর মধ্যে দুটি পাম্পকে ৫০ হাজার করে এক লাখ জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে তেজগাঁও সিটি ফিলিং স্টেশনকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও একটি মেশিন সিলগালা করা হয়।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া বিএসটিআইর উপপরিচালক রিয়াজুল হক ঢাকা টাইমসকে জানান, জরিমানা করা পাম্প দুটিতে ১০ লিটারপ্রতি ৫০ এমএল করে কম তেল দেয়।
অভিযানের প্রথম দিন মঙ্গলবার কল্যাণপুরে অভিযান চালায় বিএসটিআইয়ের টিম। তেল কম পাওয়া প্রতিবাদী যুবক ইশতিয়াক হোসেন যে পাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন সেই সোহরাব ফিলিং স্টেশনসহ তিনটি পাম্পকে ছয় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
ওই অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাসিব জানান, রহমান ফিলিং স্টেশনে ডিজেলের একটি নজেলে তেল কম পাওয়ায় এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। বিএসটিআই থেকে পুনরায় মিটার ক্যালিব্রেশন ছাড়া এসব নজেল দিয়ে তেল বিক্রি বন্ধ থাকবে বলেও জানান নির্বাহী হাকিম হাসিব। তিনি বলেন, ‘যেসব নজেলে কম পেয়েছি, জরিমানার পাশাপাশি আমরা এগুলো লক করে দিয়েছি। বিএসটিআই থেকে নতুন করে ক্যালিব্রেশন ছাড়া তারা এসব নজেল থেকে তেল বিক্রি করতে পারবে না।’
এদিকে বুধবার দুপুরে সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার বড় বাজার ও সয়া ধানগড়া মহল্লায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সিরাজগঞ্জের সহকারী পরিচালক মাহমুদ হাসান রনির নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। ওজনে কারচুপির দায়ে ‘সিরাজগঞ্জ পেট্রোলিয়াম এজেন্সি’ পেট্রোল পাম্পকে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
গত ১ আগস্ট ‘সঠিক পরিমাণে তেল চাই’ দাবিতে সকাল থেকে হাতে লেখা প্লাক্যার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করেন ভুক্তভোগী ইশতিয়াক হোসেন নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা।
ইশতিয়াক জানান, ৫০০ টাকার তেল কিনতে ডিপোতে এলে, তাকে পরিমাণে অনেক কম দেয়া হয়। প্রতিবাদে সোচ্চার হন তিনি।
এর আগে গত ২১ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরীর সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় চোরাই তেলে পরিচালিত ‘ইমাম শরীফ ফিলিং স্টেশন’ বন্ধ করে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। বিস্ফোরক পরিদপ্তর চট্টগ্রামের সহকারী পরিদর্শক মেহেদী ইসলাম খান বলেন, নিয়ম-বহির্ভূতভাবে জ্বালানি তেল বিক্রির অপরাধে সল্টগোলা এলাকার ইমাম শরীফ পেট্রোল পাম্পের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অভিযানে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পতেঙ্গা সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) জিসান বিন মাজেদ, বিএসটিআই ও যমুনা অয়েল কোম্পানির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেলেন সেই ইশতিয়াক
রাজধানীর কল্যাণপুরে সোহরাব ফিলিং স্টেশনে তেল কম দেয়ার প্রতিবাদকারী ইশতিয়াক ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। ইশতিয়াকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত পেট্রোলপাম্পটিকে জরিমানা করা হলে, সেখান থেকে তাকে ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ানবাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে ফিলিং স্টেশন কর্তৃপক্ষ ও অভিযোগকারী ইশতিয়াককে শুনানির জন্য ডাকা হয়। শুনানি শেষে তেল কম দেয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। কারচুপির দায়ে সোহরাব ফিলিং স্টেশনকে একলাখ টাকা জরিমানা করা হয়। আইন অনুযায়ী, জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থ অর্থাৎ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পান অভিযোগকারী ইশতিয়াক। পরে তার হাতে ২৫ হাজার টাকা তুলে দেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান।
ন্যায় বিচার পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন ইশতিয়াক। একইসঙ্গে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
এ সময় অভিযুক্ত সোহরাব ফিলিং স্টেশনের ব্যবস্থাপক বেলায়েত হোসেন ভবিষ্যতে আর এমন ঘটনা ঘটবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে দেশের পাম্পগুলোতে মোট অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে হয়েছে ৪০টি। ৩২টিতেই জরিমানা করা হয়েছে। আগস্ট মাসে ৪১টি পাম্পে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে ২২টি পাম্পকে জরিমানা করা হয়।
ঢাকাটাইমস/০৫আগস্ট/জেএ/এফএ

মন্তব্য করুন