বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার স্মৃতি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
| আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২২, ১২:৪৫ | প্রকাশিত : ১৫ আগস্ট ২০২২, ১২:৩৮

১৯৬৬ সালের পর আমি প্রথম বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য শুনেছি যখন উনি ছয় দফাঽর সমর্থনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশ কিংবা মিটিং করেছেন, ঠিক সেই সময়েই। তিনি গিয়েছিলেন সিলেটে। সিলেটে সেই রেজিস্ট্রিÍরেজিস্ট্রি বলতে যেখানে আইনের কিছু বিষয় থাকে। সেই রেজিস্ট্রার মাঠে তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই প্রথম তাঁর বাগ্মিতার সাথে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হলো। আমরা মাঠ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। ঐ সময়ে বঙ্গবন্ধু চাইতেন না যে, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা, বিশেষ করে ছাত্ররা এতে অংশগ্রহণ করুক। এখন যে রকম পাড়ায় পাড়ায় মন্ত্রিরা গেলে স্কুল-কলেজ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়, বঙ্গবন্ধু তা একেবারেই পছন্দ করতেন না। ছাত্ররা গেলে তিনি খুবই বিরক্ত হতেন। তাঁর কথা ছিল যে, এ বয়সে ছেলে-মেয়েরা স্কুল-কলেজে থাকবে, পড়ালেখা করবে। আর যারা ছাত্র রাজনীতি করে তারা কিছুটা বয়স হলে তারপর আসতে পারে। এজন্য একটু ভয়ে ভয়ে আমরা একটু দূরেই ছিলাম এবং আমাদের বলেই দেয়া হয়েছিল যে, আমরা যেন একেবারে সামনে না যাই। তাই আমরা দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি তখন এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছি। তখন আমার মনে হয়েছিল, অসাধারণ একটি বক্তৃতা শুনলাম। সেখানে তিনি হাস্য-রসেরও কিছু জোগান দিয়েছিলেন। কিছুটা কৌতুক, সরস কথাবার্তা কিন্তু মূল বক্তব্যটা খুবই প্রায়োগিক ছিল। তাঁর একটি কথা এখনও আমার কানে বাজে। তিনি বলেছিলেনÍ‘সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে, আঙ্গুল ত্যাড়া করতে হয়ঽ। এই কথায় আমরা খুবই আনন্দ পেয়েছিলাম সেদিন। আমার মনে আছে, জোরে জোরে হাততালিও দিয়েছিলাম। তারপর বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য শুনেছি কয়েকটি। কিন্তু আমার কানে লেগে থাকা এবং আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ শোনা ভাষণ হলো ৭ই মার্চের ভাষণ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসেই সেই ভাষণ শুনেছিলাম। বিদেশি এক রেডিওর সাংবাদিক এসেছিল। তিনি একজন দো-ভাষী খুঁজছিলেন। তার সঙ্গেই আমি গেলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সাংবাদিকদের যেহেতু আলাদা একটা বসার জায়গা ছিলো, আমাকে তাই সেখানে নিয়েই তিনি বসালেন। বলতে গেলে অনেকটা সামনেই ছিলাম। সেখান থেকেই আমি শুনেছিলাম বঙ্গবন্ধুর সেই কাব্যিক ভাষণ। সেই সাংবাদিক একটা রেডিও বোধহয় মঞ্চে রেখে এসেছিলেন রেকর্ড করার জন্য। খাতা ছিল আমার কাছে। তিনি আমাকে বললেন, তুমি শুধু অনুবাদটা করো আমার জন্য। দুই মিনিট পর বললেন, ‘তুমি শুধু ‘কি ওয়ার্ডঽ লিখে রাখোঽ। আমি শুধু ওই ‘কি ওয়ার্ডগুলোঽ লিখে রেখেছি। প্রত্যেকটি কথা মন দিয়ে শুনেছি। কিন্তু আমার শুধু মনে হচ্ছিলো এমন একটি ভাষণ আমি সারা পৃথিবীতে শুনিনি। আসলে ওই সময়টায় একটা জাদু ছিল বাতাসে। আমরা যা চাচ্ছিলাম তাই তিনি বলেছিলেন। শুধু তাই নয়, আমরা যা আশা করছিলাম আর প্রতিফলন ছিল সেই ভাষণে। এবং আমরা পরে বুঝেছি, কেন তিনি সেদিন একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা করেননি। এতো বড় দায়িত্ব নিয়ে এতো বড় বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন। যা হোক, তারপর আবার যখন স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে, ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে এলেন। ওইদিনও আমি ঢাকাতেই ছিলাম। কিন্তু একটু দেরি করে যাওয়ার ফলে পুরো বক্তৃতাটি শুনতে পারি নি। তবে যেটুকু শুনেছিলাম, তাতে মনে হয়েছে, ভাষণটি ৭ই মার্চের ভাষণ এর ধারে কাছে আসতে পারে। এটি মূলত তাঁর একটি দিক নির্দেশনামূলক বক্তৃতা ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। আর উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা তো আলাদা জিনিস। তারপর বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর দালানের উপর। আবার, ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যখন আলোচনা চলছে তখন আমরা শেরাটন হোটেলের আশেপাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। কারণ তিনি মূলত এই রাস্তা ধরেই তাঁকে চলাফেরা করতে দেখতামÍ৭২, ৭৩ কিংবা ৭০ সালের আগেও দেখতাম। বঙ্গবন্ধু যখন জননেতা ছিলেন, যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো পদে বহাল ছিলেন না তখন তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়াটা সহজ ছিল। তাঁর ৩২ নম্বর বাসার সামনে গেলে এবং ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করলে তাঁকে দেখা যেতো। কারণ তিনি বাসায় থাকলে বারান্দায় আসতেন অথবা যখন তিনি বের হতেন তখন মানুষের মাথায় হাত দিতেন। এক কথায় ভয়ানকভাবে মানুষকে ভালোবাসতেন। তাঁর চেহারার মধ্যেই একটি অন্য রকমের আকর্ষণ ছিলÍগম্ভীর একজন গলার মানুষ এবং যাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল খুবই প্রখর। মানুষের জন্য তাঁর অসীম ভালোবাসা ছিলো। অনেকের নাম মনে রাখতেন। আমার খুব কষ্ট লাগে যে, আমার সমবয়সী অনেকের নাম বঙ্গবন্ধু জানতেন। কিন্তু আমি তো কখনো সামনে যাইনি তাই হয়তো আমার নাম তিনি জানতেন না। সেই অর্থে বঙ্গবন্ধুর সাথে সামনে থেকে কথাবার্তা বলার সুযোগ আমার হয়নি। অনেকের সঙ্গেই তাঁর সামনে গিয়েছি, তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে কিন্তু আমার সঙ্গে হয়নি। এখন ঐ বন্ধুরা যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের স্মৃতিকথা লেখেন তখন আমার খুবই মন খারাপ হয়। মনে মনে আক্ষেপ করে বলি, বঙ্গবন্ধুর একটা ইন্টারভিউ তো নিতে পারতাম!

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :