খরচ কাটছাঁট করে টিকে থাকার লড়াই

এম এস নাঈম, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২২, ০৯:৫২ | প্রকাশিত : ১৮ আগস্ট ২০২২, ০৭:৪৮

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে মানুষের যাপিত জীবনের হিসাব মেলানো এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না আয়। ফলে এতদিনকার অনেক অভ্যাস-রুচিতে দিতে হচ্ছে বাঁধ। কাটছাঁট করতে হচ্ছে নানা খাতে। এখন যে তার টিকে থাকার লড়াই।

এই লড়াই শুধু নিম্ন আয়ের মানুষের নয়, মধ্যবিত্তেরও। আয়-ব্যয়ের সমন্বয়ে হিমশিম খাওয়া মানুষ ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে টিকে থাকার জন্য খরচ বাঁচানোর নতুন কৌশল খুঁজছেন, বেছে নিচ্ছেন বিকল্প।

রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত কয়েকজন চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী ও বাইকচালকের সঙ্গে কথা বলে এমনই জীবনচিত্র উঠে এসেছে।

প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়ে আছে আগে থেকেই। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর হু হু করে বাড়তে থাকে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম।

পণ্যমূল্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়ার কথা স্বীকার করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও। তিনি এর পেছনে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভকে দায়ী করেন। মন্ত্রী জানান, পণ্যমূল্য যে পরিমাণ বাড়ার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি বাড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। পণ্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। দাম নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

কিন্তু সে উদ্যোগ কত দিনে ফল দেবে! যাদের সঙ্গে আলাপ হলো, বিলাসিতা নামের বিষয়টি বিদায় জানিয়ে অনেকেই এখন জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ খরচ বাঁচাতে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যাওয়া-আসা এবং বাজার খরচে মিতব্যয়ী হয়েছেন।

এই সূত্রে বাজারে খোঁজ নেয় ঢাকাটাইমস। কাঁচামরিচ ও সবজির দাম তো বেশ কিছুদিন আগেই চড়ে আছে। চালের বাজারের অস্থিরতা চলছেই। দিন বিশেক আগে যে পেঁয়াজ ছিল ৫০ টাকা কেজি, তা এখন ৬৫ টাকা। কাঁচামরিচ কিছুটা কমার পরও কেজি ২৩০ টাকা।

চালের বাজারে মোটা ও সরু চালে ৫০ কেজির বস্তায় বেড়েছে ২১০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি কেজি চালে পাইকারিতেই বাড়তি ৪-৫ টাকা। মধ্যবিত্তের মিনিকেটে পাইকারিতে কেজিপ্রতি ৫ থেকে ৬ টাকা বেড়ে মানভেদে ৭৮ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়ে নাজিরশাইল ৮০ থেকে ৮৮, ভালো আটাশ চাল ৪-৫ টাকা বেড়ে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মাছ-সবজির বাজারেও একই চিত্র।

মীরহাজিরবাগ এলাকার বাসিন্দা ঊর্মি রহমান রিকশার ভাড়া বাঁচিয়ে তা বাজার খরচের সঙ্গে সমন্বয় করছেন। এমনকি বাজার-সদায়ের পর ব্যাগ যদি বহনযোগ্য হয় তাহলে তা হাতে নিয়ে হেঁটে বাসায় ফেরেন বলে জানান তিনি। বলেন, ‘আগে ১০০ টাকার সবজি কিনলেও খরচ কমাতে এখন ৭০ টাকার সবজি কিনছি।’ উর্মি রহমান বলেন, ‘অফিসে একটু দ্রুত ও আরামে যাওয়ার জন্য যে বাহন ব্যবহার করতাম, তা এখন আর পারছি না। আমাকে এখানেও ছাড় দিতে হচ্ছে। এসব থেকে আমাকে সরে আসতে হচ্ছে।’

রাজধানীর বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা নাজমুল ইসলামের অফিস মহাখালী ডিওএইচএসে। তিনি বলেন, ‘আগে আমি রিকশা করে বনশ্রীর মেইন রোডে আসতাম। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশা কিংবা রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে অফিসে যেতাম। এখন মেইন রোড পর্যন্ত হেঁটে আসি। সেখান থেকে বাসে মহাখালী রেলগেইট নেমে হেঁটে অফিসে যাই।’

নিজেকে এখন অসহায় লাগে নাজমুল ইসলামের। বলেন, ‘সবজিওয়ালা সবজির দাম বাড়িয়ে দিতে পারছে, বাসওয়ালা ভাড়া বাড়িয়ে দিতে পারছে কিন্তু আমি চাইলেও আমার বেতন বাড়াতে পারছি না। প্রতিনিয়ত জীবনের ওপর নতুন খরচ এবং নতুন নতুন ব্যয়ের ভার যুক্ত হচ্ছে।’

‘আমার অফিস যে যাতায়াত খরচ আমাকে দেয়, তার চেয়ে আমার খরচ অনেক বেশি। ফলে আমাকে মূল বেতনের সঙ্গে যাতায়াত খরচ সমন্বয় করতে হচ্ছে। বাচ্চার স্কুলে যাতায়াত খরচ, স্ত্রীর জন্য খরচ আমার মূল বেতন থেকে যাচ্ছে। সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সামগ্রিকভাবে জীবনের ওপর প্রভাব পড়েছে।’ যোগ করেন নাজমুল।

চাকরিজীবী নাবিলা রহমান থাকেন যাত্রাবাড়ী এলাকায়। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় তার নির্ধারিত বেতনে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না তিনি। বলেন, ‘একজন চাকরিজীবী হিসেবে আমার আয় বাড়েনি এক টাকাও। উপরন্তু নিত্যপণ্যসহ আর সব ধরনের সেবায় নতুন নতুন খরচ যুক্ত হচ্ছে।’

নাবিলা রহমান যাত্রাবাড়ী থেকে গুলশানের নিকেতনে এসে অফিস করেন। বাসা থেকে প্রথমে রিকশা, তারপর বাস এবং তারপর আবার রিকশা। মাঝে মাঝে সিএনজি অটোরিকশা বা রাইড শেয়ারিংয়ে যাতায়াত করতেন। বলেন, ‘এগুলো সবই ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সার্ভিসগুলো ব্যবহার একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছি। সবচেয়ে কম খরচের বাসেও ভাড়া বেড়ে এখন ৫০-৭০ টাকা। অসহায় বোধ করছি।’

আগে যেটুকু পথ রিকশা করে যেতেন সেটুকু এখন হেঁটে যান উত্তরার বাসিন্দা রাশিদুল ইসলাম। অফিস শেষে ক্লান্তি নিয়ে হাঁটতে ভালো না লাগলেও কিছু করার নেই। রাশিদুল বলেন, ‘দুরের পথগুলো সম্ভব হলে পাবলিক বাসে যাই। অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে বাস স্টপেজ পর্যন্ত হেঁটে যাই। বাস থেকে নেমে হেঁটে বাসায় ফিরি।’

এত দিনকার যাপিত জীবনে এটি বড় পরিবর্তন বলে জানান রাশিদুল। বলেন, জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই চলছে।

বাংলামটর এলাকায় ফখরুল ইসলাম নামে একজন বাইক চালক বলেন, ‘আগে যেখানে ৪০০ টাকায় তেলে আমি এক সপ্তাহ বাইক চালাতে পারতাম এখন সেখানে তেল লাগছে ৬০০ টাকার। সপ্তাহে ২০০ টাকা হিসাবে মাসে ৮০০-১০০০ টাকা জ্বালানি খরচ বেড়ে গেছে।’

ফখরুল বলেন, ‘শুধু যে যাতায়াতের ওপর প্রভাব পড়েছে তা কিন্তু নয়, অন্যান্য খরচের খাতগুলোতেও এর প্রভাব অনেক। ফলে স্বাভাবিক জীবনযাপন বজায় রাখা কষ্টকর হয়ে উঠেছে।’

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় এখন প্রয়োজন ছাড়া নিজের বাহনটি বের করেন না মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘যে গন্তব্যে পায়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব সেখানে হেঁটে গিয়ে কাজ সেরে আসি।’

জীবন নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘টিউশনি করে ভার্সিটির খরচ জোগাতাম। ভার্সিটিতে যাতায়াত করতে আগে মোটরবাইক ব্যবহার করলেও এখন বাইসাইকেল ব্যবহার করছি। খরচাকে সাধ্যের মধ্যে রাখতেই এই চেষ্টা।’

সামনের দিনগুলো নিয়ে চিন্তিত জুনাইদ আহমেদ। শাহবাগে তার সঙ্গে আলাপকালে এই যুবক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমার বেতন না বাড়লেও অন্যান্য খরচ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। ফলে আমাকে সমন্বয় করতে হচ্ছে সময়ের সাথে, কোয়ালিটির সাথে, চাহিদার সাথে। আমি ভয়ে আছি এটা কোন পর্যন্ত গিয়ে শেষ হবে, কিংবা আদৌ শেষ হবে কি না!’

ডলার আর জ্বালানি তেলের দামের অস্থিরতার প্রভাব মানুষের জীবনে পড়ছে বলে মনে করেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। ডলারের দাম পূর্বাবস্থায় ফিরে না এলে দ্রব্যমূল্য কমার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে জানান তিনি।

গোলাম রহমান বলেন, ‘আগে টাকার মান বাড়াতে ডলারের দামের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। একই সঙ্গে উদ্যোগ নিতে হবে মানুষের রোজগার বাড়ানোর, যাতে দ্রব্যমূল্য বেশি হলেও মানুষ কিনতে পারে।’

এদিকে সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বুধবার সাংবাদিকদের জানান, পণ্যমূল্য যে পরিমাণ বাড়ার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি বাড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। পণ্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। দাম নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা টিসিবির মাধ্যমে প্রতি মাসে এক কোটি পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য দেওয়া হবে। অচিরেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে ভোজ্যতেলের নতুন দাম ঠিক করা হবে।

(ঢাকাটাইমস/১৮আগস্ট/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :