আরও একবার জানুন কারা ছিলেন ‘খুনি মোশতাক’ মন্ত্রিসভায়, সুবিধাভোগীই বা কারা?

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২২, ০৯:১৭ | প্রকাশিত : ২৫ আগস্ট ২০২২, ১৬:৩৮

আপনি কি জানেন, বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল কে? জাতির পিতার রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে রাষ্ট্রপতি হয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। যিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। তখনো ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ।

শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে সপরিবারে হত্যার পর ওই দিনই রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ৮৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন মোশতাক।

কাদের নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন এই ‘খুনি’ মোশতাক? কারা ছিলেন তার মন্ত্রিসভায়? সুবিধাভোগী হয়েছিলেন কারা? কারা ছিলেন সরকার বা প্রশাসনের উচ্চ পদে?

ইতিহাসবিদদের মতে, সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হলো- মোশতাক মন্ত্রিসভায় যারা পদ পেয়েছিলেন, দুজন বাদে অন্য সবাই ছিলেন বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্য। খন্দকার মোশতাক ১২ জন মন্ত্রী ও ১১ জন প্রতিমন্ত্রী নিয়ে তার মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ২৩ সদস্যের এই মন্ত্রিসভার ২১ জনই ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাকশালের ক্যাবিনেট সদস্য। তাদের দপ্তরও খুব একটা পরিবর্তন করা হয়নি। প্রায় সবাইকে আগের দপ্তরেই বহাল রাখা হয়।

বাকশালের বাইরে খন্দকার মোশতাক কেবল শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় যুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ।

মোশতাক ক্ষমতা গ্রহণের সময় প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি পদকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়। উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ পান মোহাম্মদ উল্লাহ।

মোশতাককে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ পড়ান এইচ টি ইমাম, যিনি সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। তবে বিভিন্ন সময় এইচ টি ইমাম বিভিন্ন টক শো ও বক্তব্যে এই তথ্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এইচ টি ইমামের মতে, তাকে বাসা থেকে তুলে আনা হয়েছিল। তিনি শুধু বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আর শপথবাক্য পাঠ করান বিচারপতি আবু সাঈদ।

এইচ টি ইমাম বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদের (১৯৭১-১৯৭৫) ক্যাবিনেট সচিব ছিলেন। পরে ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ক্যাবিনেট সচিব থাকা এইচ টি ইমামের পরবর্তীতে (পদাবনতি পদে) সচিব হিসেবে ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত পরিকল্পনা সচিবের পদে নিযুক্ত ছিলেন।

মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী 'এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য, স্বাধীনতার প্রথম দশক’ বইয়ে লিখেছেন, ‘ক্ষমতায় এসেই এই সরকার তাড়াহুড়ো করে সামরিক বাহিনীতে পরিবর্তন আনে। জেনারেল ওসমানীকে (এম এ জি ওসমানী) একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির সামরিক উপদেষ্টা করা হলো। উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হলো। আর পূর্বতন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে অব্যাহতি দিয়ে তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলো রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগের জন্য।’

‘মেজর রশিদ, ফারুক এবং তাদেরই সহযোগীদের হাবভাব ও চালচলন দেখে মনে হতো, দেশ এবং সেনাবাহিনী তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। মেজর ফারুক বঙ্গভবনের একটি কালো মার্সিডিজ গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াত। খন্দকার মোশতাক এদেরকে তার নিজের নিরাপত্তার জন্য বঙ্গভবনেই থাকতে উৎসাহিত করতেন।’ লিখেছেন মইনুল হোসেন চৌধুরী।

কারা ছিলেন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী

এম ইউসুফ আলী পরিকল্পনামন্ত্রী; ফণীভূষণ মজুমদার স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী; সোহরাব হোসেন পূর্ত ও গৃহনির্মাণ মন্ত্রী; আব্দুল মান্নান স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী; মনোরঞ্জন ধর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী; আব্দুল মোমিন কৃষি ও খাদ্যমন্ত্রী; আসাদুজ্জামান খান বন্দর ও জাহাজ চলাচল মন্ত্রী; ড. আজিজুর রহমান মল্লিক অর্থমন্ত্রী; ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পান।

প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বিমান ও পর্যটন; দেওয়ান ফরিদ গাজী বাণিজ্য ও খনিজ সম্পদ; তাহেরউদ্দিন ঠাকুর তথ্য বেতার ও শ্রম; অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী শিল্প; নুরুল ইসলাম মঞ্জুর রেল ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়; কে এম ওবায়দুর রহমান ডাক ও তার; মসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়া পাট মন্ত্রণালয়; ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতর; রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বন, মৎস্য ও পশুপালন; সৈয়দ আলতাফ হোসেন সড়ক যোগাযোগ; মোমেন উদ্দিন আহমেদ বন্যা পানি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।

ওই সময় আর্মি চিফ অব স্টাফ জেনারেল সফিউল্লাহ, এয়ারফোর্স চিফ এ কে খন্দকার, নেভি চিফ অ্যাডমিরাল খান, ফরেন সেক্রেটারি ফখরুদ্দীন এবং পুলিশপ্রধান (আইজিপি) ছিলেন নুরুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানী হন মন্ত্রীর সমমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা। মাহবুব আলম চাষী হন মুখ্য সচিব। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন আবদুল মালেক উকিল। তিনি পরবর্তীতে মোশতাকের অধীনে জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে শপথ নেন।

শপথবাক্য পাঠ করানো বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ছেলে আবুল হাসান চৌধুরী ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

মোশতাকের কৃষিমন্ত্রী আব্দুল মোমেন ’৯৬ সালে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করে হেরে যান। পরবর্তীতে বাবরকে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হন মোশতাক সরকারের বাণিজ্য ও খনিজ সম্পদমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী। তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এমপি ছিলেন। তার ছেলে গাজী মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ ওরফে দেওয়ান মিলাদ গাজী বর্তমানে হবিগঞ্জ-১ আসনের (নবীগঞ্জ-বাহুবল) সংসদ সদস্য।

মোশতাক মন্ত্রিসভার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান ১৯৭২ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৭৩ সালের মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তিনি সর্বশেষ টাংগাইল-৬ আসন থেকে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন তিনি।

সাবেক রাষ্ট্রদূত অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আনোয়ার উল আলম তার 'রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা' বইয়ে লিখেছেন, ‘মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে যারা অস্বীকার করেন, তাদের বন্দী করেন মোশতাক।’

মন্ত্রিত্ব না নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন যারা

সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও ফণী মজুমদার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানের প্রস্তাব নাকচ করেন। তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। পরে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ফণী মজুমদার ছাড়া অন্য চারজনকে কারাগারের অভ্যন্তরে গুলি করে হত্যা করা হয়।

(ঢাকাটাইমস/২৫আগস্ট/আরআর/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজনীতি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :