গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ফিরে দেখা ১১ নভেম্বর ১৯৯০

ড. ফরিদ আহমেদ
| আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২২, ০৯:৫৮ | প্রকাশিত : ১১ নভেম্বর ২০২২, ০০:৫৮

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মুক্তির সংগ্রামে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ছিল বাঙালির একমাত্র আশার আলো। ইতিহাসবিদরা সেই সত্যকেই যুগে যুগে শুনিয়ে আসছেন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়তে পড়তে আমি যেন জীবন্ত হাজির হয়ে উঠি বঙ্গবন্ধুর পেছনে কিংবা সামনে কিংবা কখনো পাশে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ৭ মার্চ, ৬ দফা, ১১ দফা, ২১ দফা-ছাত্রলীগ এক শিহরণ জাগিয়ে তোলে বাঙালি হৃদয়ে।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল যেন এক স্বপ্নপুরী। যেখান পড়তে স্বপ্ন দেখে বাংলার তরুণ-তরুণীরা যুগে যুগে।সকলের মতো আমারও স্বপ্ন সত্যি হলো। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। আর কিছুদিনের মধ্যেই জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করলেন।

কিছুদিন চুপচাপ এরশাদ কী করেন তা সবার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দেখছিল। এরপর শুরু হলো আন্দোলন।সামরিক শাসনকে চ্যালেঞ্জ করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গঠন করা হলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আগুনঝরা ফেব্রুয়ারি ১৪ জাতির ইতিহাসে আরেকটি স্মরণীয় দিন হয়ে রইল। ধীরে ধীরে সামরিক সরকার মোড়ক থেকে বেরিয়ে জন্ম নিলো জাতীয় পার্টি এবং রাজনীতিবিদের ভাষায় রাবার স্ট্যাম্প সংসদ।

উর্দি ছেড়ে এরশাদ এলেন প্রেসিডেন্ট হয়ে প্রহসনের ভোটে। কিন্তু সেই সংসদ বেশিদিন টিকল না।১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর পার্লামেন্ট ভেঙে দিলেন এবং গৃহপালিত বিরোধীদল দিয়ে ৩ মার্চ ১৯৮৮ নতুন সংসদ বানালেন। আবার দানাবাঁধল আন্দোলন গণতন্ত্রের। কিন্তু কোথায় যেন আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যেত।এভাবে ১৯৮৮, ১৯৮৯ চলে গেল। কিন্তু ১৯৯০ সালে এসে আর জনগণ বসে রইল না। বসে রইল না সাধারণ ছাত্রসমাজ।

এরশাদ তখন নানা বাহানা খুঁজে ক্ষমতায় থাকতে চেষ্টা করছিল। তারই ধারায় ১৯৯০ সালে ক্ষমতায় থাকতে ১০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ ১৯৭৩-কে উপেক্ষা করে। কিন্তু বসে রইল না আইনজীবী, শিক্ষক-ছাত্ররা। এরশাদের আদেশ হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ হলো। এরই মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিলেন এক অসম সাহসী পদক্ষেপ। ১১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতীকী ক্লাস হবে। উত্তেজনায় আমাদের ঘুম নেই সারারাত। সকালেই চলে এলাম কলাভবনে। দেখলাম অনেকেই আসছেন। গোয়েন্দারাও আছে।

কিন্তু যেমন ঘোষণা তেমনি কাজ। দর্শনের প্রিয় অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাদ উদ্দিন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ফেরদৌস হাসান ক্লাস নিলেন। আমরা প্রতিটি ক্লাসে উপস্থিত থেকে আন্দোলনের ইতিহাসকে এগিয়ে নিলাম। আমার সঙ্গে সেদিন দর্শনের মাশরুর ভাই ছিলেন। সেদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মিজানুর রহমান ছিলেন ওই ক্লাসগুলোতে।

লোকমুখে শুনলাম তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ উপাচার্য মনিরুজ্জামান মিয়াকে নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্রোহীদের তালিকা পাঠাতে। কিন্তু কোথায় কার আদেশ-নির্দেশ। সারাদেশ তখন জেগে উঠেছে। ২৭ নভেম্বর এরশাদের গুন্ডারা টিএসসির কাছে গুলি করে হত্যা করে ডাক্তার মিলনকে। রিকশাতে একসঙ্গে আসছিলেন ডাক্তার জালাল মহিউদ্দিনও ডাক্তার মিলন। আমি তখন লাইব্রেরিতে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি গুলি আমার গায়ে লাগে। এরশাদের দিন ফুরিয়ে গেল ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০।পদত্যাগ করলেন গণঅভ্যুর্থানের মাঝে।

আজ সেই ১১ নভেম্বর। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ময়দানে বিকালে আসবেন। সাজ সাজ রব। কী বলবেন তিনি সবার মাঝে উৎকণ্ঠা। কারণ বিএনপি এরই মাঝে মাঠ গরম করতে চেষ্টা করছে। তাদের অভিযোগ, গণতন্ত্র নেই। অন্যদিকে আছে বিশ্ব মন্দা। জাতির সামনে একটি ক্রিটিকাল মোমেন্ট। যে গণতন্ত্রের জন্য আমরা এক সাগর রক্ত ঝরিয়েছি, সেই গণতন্ত্র আজ হুমকিতে। এখন সবার দায়িত্ব সজাগ থেকে শান্তির পথ খোঁজা।

শহীদ নূর হোসেন ১০ নভেম্বর ১৯৮৭ স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার মিছিলে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ নিজ গায়ে লিখে মিছিলে অংশ নেয়। সেই মিছিলে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় শহীদ নূর হোসেনকে। নূর হোসেনের মতো সমগ্র জাতির ত্যাগের বিনিময়ে যে গণতন্ত্র আমরা ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলাম, তার সুফল ভোগ করেছেন বেগম খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি। সেই বিএনপি ২০০১ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে এক বিভৎস চেহারায় অবতীর্ণ হয়।সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অবর্ণনীয় নিপীড়ন, নির্যাতন চালায়।

বিএনপির শাসন আমলেই ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যা করে মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী আইভি রহমানকে। আজও সেই হামলার ভয়াবহতা মনে করে অসংখ্য আওয়ামী লীগ কর্মী শিহরিত হন! জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করেই দমেনি এই মহল। তারা বারবার জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেছে। তাদের এই কর্মকাণ্ড সীমা ছাড়িয়ে জনতার উপর আঘাত হানে। ২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকাতে, ২০১৫ সালে সরকার উৎখাত করতে পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করে জনতার উপর। সেই নির্মমতাকে মোকাবেলা করতে জনগণের পাশে দাঁড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকরা।

১৯৯০ সালের ১১ নভেম্বর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তির সংগ্রামে যেভাবে ছাত্র-শিক্ষকরা অবদান রেখেছেন, সেই অবদানকে আমরা যেন সবাই স্মরণ রাখি- সেই প্রতাশ্যা থেকে আমার আজকের লেখা।

যে শিক্ষকরা ১৯৯০ সালে সামরিক লেবাসে থাকা সরকারকে বিতাড়নে অবদান রাখে, সেই শিক্ষকদের ২০১৫ সালের পে স্কেল দুই ধাপ নামিয়ে দেওয়া, আমলাদেরকে ৩০ লাখ টাকার গাড়ির সুবিধাসহ মাত্রাতিরিক্ত বিদেশভ্রমণ সুবিধা দেওয়া কি ন্যায় ও ন্যায্যতার শর্ত পূরণ করে? ওই সব অসমতা সামান্য হলেও যেমন সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি ও আজকের অর্থনৈতিক সংকটের মূলে অবদান রাখছে, সেটা যেন সরকার বিবেচনায় নেন।

পত্রিকায় দেখেছি, বিদেশভ্রমণ কমানো হয়েছে। কিন্তু বিদেশি বা দেশি কোম্পানির অর্থায়নে ভ্রমণ অব্যাহত আছে। আছে অবৈধ অর্থপাচার- যারা বিদেশ থেকে টাকা নিয়ে আসে সেই শ্রমিক আজ নিপীড়িত। আর যারা টাকা পাচার করে তারা সমাজে হয় ক্ষমতায় বাহাদুর কিংবা দাপটে!

কেবল বিদেশ ভ্রমণ কমানো নয়, গাড়ির সুবিধা কমানোর প্রয়োজন আছে বলে বিবেচনা করা যায়। কারণ, আজকের মূল সংকট জ্বালানি ও প্রাইভেটকার। সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি সমাজের অন্যান্য শ্রেণির মাঝে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে।‘ঋণ করে হলেও ঘি খাও’ নীতি আলিঙ্গন করে আমাদের অনেকেই গাড়ি কিনছে সামাজিক স্ট্যাটাস বজায় রাখতে।

গণতন্ত্র মানে কেবল একটি নির্বাচন নয়। গণতন্ত্র ও নির্বাচন যেটা বলে সেটা হলো সবাই সমান। সচিব কিংবা দলের প্রধান হলেও ভোট একটি। এই সমতাকে গণতন্ত্র বলে। আমাদের অনেক নীতি সেই সমতাকে অস্বীকার করছে। ফলে গণতন্ত্র হুমকিতে পড়ছে। আমরা ইট-পাথরের উন্নয়ন চাই না। মানুষের ঘুম কেড়ে নেওয়ার উন্নয়ন চাই না। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন- পদ্মা সেতু হওয়ার পরেও কেন বরিশাল-খুলনার মানুষ বিএনপির জনসভাতে গেল? সেই কারণ খুঁজতে হবে আমাদেরকে।

সমাজের যারা গণতন্ত্রের মুক্তিতে অবদান রেখেছেন, তাদেরকে উপেক্ষা করে যিনি পদে আছেন, তিনি যে আচরণ করছেন তা মানুষকে সংক্ষুব্ধ করছে কি? আমরা হাইব্রিড কাউয়ার কথা শুনি। কিন্তু সেই হাইব্রিড কাউয়ার বিষয়ে কোনো অর্থবহ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি? বরং অভিযোগ আছে, যারা ত্যাগ করেছেন তাদেরকে নির্যাতন করা হচ্ছে।

আজকের জনসভাতে নূর হোসেনের ত্যাগের কথা, বঙ্গবন্ধু যে নিপীড়িত মানুষের কথা বলেছেন তাদের কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি বলবেন? আমলা-পুলিশ নয়, জনগণ হোক রাজনীতির ভরসা। বন্ধ হোক বৈষম্য, নিপীড়ন, নির্যাতন। নির্মূল হোক দুর্নীতি। সে জন্য আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। জাতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের কাছে আশা করে, তারা যেন রাজনীতিবিদের হুঁশিয়ার করে।

গণতন্ত্র মানে ক্ষমতায় যাওয়া এবং তার সুফল একা একা ভোগ করা নয়। গণতন্ত্র মানে স্বাধীনতা। কথা বলবার স্বাধীনতা, নিজের অধিকার ভোগের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার পাবার অধিকার। ভোটের গণতন্ত্র, গণতন্ত্র নয়। মানবতার বিজয় ও মানুষের মর্যাদাকে সম্মান করে যে কাজ সেটাই গণতন্ত্র। সমাজসেবার পরিবর্তে রাজনীতি হয়ে গেছে বাণিজ্য। সেই বাণিজ্য বন্ধ হোক।

লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :