'মুজিব: একটি জাতির রূপকার' ও আজকের প্রজন্ম

ফকির ইলিয়াস
 | প্রকাশিত : ০২ মে ২০২৪, ১৩:০৯

'মুজিব: একটি জাতির রূপকার' আজকের প্রজন্মের জন্য খুবই ইতিহাসভিত্তিক একটি ডকুফিল্ম- যা জানাবে একটি জাতির স্বাধীনতা ও এর রূপকারের সংগ্রামের কথা। এই ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্রটি দেখার জন্য খুবই উদগ্রীব ছিলাম। বাংলাদেশে মুক্তি পাওয়ার পরপরই বিদেশে তা আসতে শুরু করে। নিউইয়র্কেও তা আসে যথাসময়েই। কিন্তু রহস্যজনক কথা ছিল, এর প্রচার হয়নি মোটেও বিদেশের বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলোতে। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রে যে বাংলা মুভিগুলো আসে, তা প্রচার করা হয় জোরেশোরে ওই সংস্থা দ্বারাই- যারা মুভিটির বাজারজাত করেন এখানে। কিন্তু জাতির পিতাকে নিয়ে এই মুভিটি, কে বা কারা উত্তর আমেরিকায় বাজারজাত করেছিলেন- তা জানা যায়নি !

একটি উড়োজাহাজ বাংলার আকাশ স্পর্শ করছে! জাতির পিতা প্লেন থেকে বাংলার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি আবেগ আপ্লুত। ঢাকাজুড়ে লাখ লাখ মানুষ। তারা জাতির পিতাকে বরণ করার জন্য উদগ্রীব! এভাবেই শুরু হয়েছে মুভিটি। এর পরেই দর্শককে ফিরিয়ে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু মুজিবের ব্যক্তিগত জীবন, ছাত্রাবস্থা ও রাজনৈতিক ভাবনা ও দর্শনের কাছে। বেগম ফজিলাতুননেসা রেনু'র সাথে তাঁর বিয়ের শুরুর কাল ও পরে দাম্পত্যজীবন- এই মুভিতে দেখানো হয়েছে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটেই। উচ্চশিক্ষার জন্য মুজিবের কলকাতায় গমন এবং এর আগে হোসেন শহীদ সোহারাওয়ার্দীর সাথে তাঁর দেখা হওয়ার বিষয়টিই শেখ মুজিবের রাজনৈতিক পথচলার নীতি নির্ধারণ করে দেয়।

'রায়ট' বা হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার মুল চেতনাপ্রবাহক ছিলেন জিন্নাহ। মুসলমানদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্র চাই- এই দাবি উসকে দেন জিন্নাহ ও তার সহযোগীরা। 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান' বলে দ্বিজাতিতত্বের যে সাম্প্রাদিক বীজ জিন্নাহ'রা বপণ করেছিলেন- মুজিব মূলত ছিলেন সেই বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলার কাণ্ডারি। সেই উদ্দেশ্যে তিনি সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীদের সাহায্য চেয়েছেন সবসময়ই।

বৃটিশ শাসন থেকে তৎকালীন পাকিস্তানের স্বাধীনতালাভের কৃতিত্বটি এককভাবে দাবি করতে থাকেন কায়েদে আজম জিন্নাহ ও তার অনুসারী পশ্চিম পাকাস্তানিরা। এরপরেই শুরু হয় তাদের দখলদারিত্ব ও চোখ রাঙানোর মানসিকতা। ১৯৫২ সালে জিন্নাহ যখন বলেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা- মুলত বাঙালি জাতি কথার বুলেটবিদ্ধ হয় সেদিনই। এরপরেই ঢাকা গর্জে ওঠে। শুরু হয় আন্দোলন। শেখ মুজিবুর রহমান, সেই আন্দোলনের সম্মুখভাগে থেকে নেতৃত্ব দেন।

মুভিটি দেখলে এটাই স্পষ্ট বুঝা যায় যে, পাকিস্তানি গহ্বর থেকে বাঙালি জাতি কীভাবে মুক্তি পাবে, কীভাবে পেতে পারে- তা নিয়ে খুবই চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন শেখ মুজিব। যা সেই সময়ের অন্য নেতা, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী- কারো মাঝেই লক্ষ করা যায়নি সেভাবে। এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, সোহরাওয়ার্দী ছিলেন শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুরু। তিনি সোহরাওয়ার্দীকে বারবারই লিডার অভিধায় সম্মানিত করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব বেশ ভেঙেই পড়েছিলেন। এই মুভিতে তিনি পরোক্ষভাবে এটাও বলেছেন যে, সোহরাওয়ার্দীকে পশ্চিমা শাসকরা এক প্রকারের খুনই করেছে!

একটা প্রতিকূল সংগ্রামের মধ্য দিয়েই মুজিব নিজের পরিচয় রাজনৈতিক মাঠে তুলে ধরতে সমর্থ হন। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠাতব্য পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন উপলক্ষ্যে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাভূত করার জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে এই যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালের ৪-ঠা ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। এই যুক্তফ্রন্টের নেতা ছিলেন- মওলানা ভাসানী, একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার একটি নির্বাচনি ইশতেহার প্রকাশ করে। ওই ইশতেহারের মধ্যে প্রধান দাবি ছিল- লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা, ভাষা শহিদদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহিদ মিনার নির্মাণ করা ইত্যাদি। ১৯৫৪ সালের মার্চের আট থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। এর মধ্যে ১৪৩টি পেয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, আবুল কাশেম ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক গঠিত যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব জয়লাভ করে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হয়। তারা শুধু ৯টি আসন লাভ করে। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ ‘মুসলিম’ শব্দটি বর্জন করে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য যে সংগ্রামের পথ দেখিয়েছিলেন তা ছিল আলাপ আলোচনা। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে পদক্ষেপ নেন। কিন্তু তার এই পদক্ষেপ ব্যাপক রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্ম দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের মতো পশ্চিম পাকিস্তানেও এক ইউনিট ধারণা প্রচলনে তার চেষ্টা পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের কারণে নস্যাৎ হয়ে যায় এরপর ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী করেন। আগস্ট, ১৯৫৯ হতে ইলেক্টিভ বডি ডিসকোয়ালিফিকেশান অর্ডার অনুসারে তাকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে রাষ্ট্রবিরোধী কাজের অপরাধ দেখিয়ে তাকে জানুয়ারি ৩০, ১৯৬২-তে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং করাচি সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ করা হয়। আগস্ট ১৯, ১৯৬২ সালে তিনি মুক্তি পান। অক্টোবর, ১৯৬২-তে তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট (এন. ডি. এফ.) গঠন করেন। পাকিস্তানিদের রাজনীতিতে সামরিক জান্তাদের পদচারণা যেন ডেকেই আনা হয়েছিল। আর তা করেছিলেন পাকিস্তানি রাজনীতিকরা। তারা সোহরাওয়ার্দীকে টার্গেট করেই বাঙালি জাতিকে সব ধরনের কোণঠাসা করার মতলবে নামে।

সোহরাওরার্দী স্বাস্থ্যগত কারণে ১৯৬৩ সালে দেশের বাইরে যান এবং লেবাননের রাজধানী বৈরুতে অবস্থানকালে ৫ই ডিসেম্বর ১৯৬৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পরেই ঘুরে দাঁড়াতে হয় শেখ মুজিবকে। শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের শুরুতেই শেখ মুজিব ডাক দেন, বাংলার স্বাধীকারের। অবস্থা বেগতিক দেখেই শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ায় পাকিস্তানি জান্তারা। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিল। ১৯৬৮ সালের প্রথম ভাগে দায়ের করা এই মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, শেখ মুজিব ও অন্যরা ভারতের সাথে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল "রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য মামলা"। তবে এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবেই বেশি পরিচিত, কারণ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল যে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় কথিত ষড়যন্ত্রটি শুরু হয়েছিল।

শেখ মুজিবকে বারবারই জেলে যেতে হচ্ছিল এসব কারণে। পাকিস্তানিরা বুঝতে পারছিল, শেখ মুজিবের দ্রোহ ও দেশপ্রেমের কাছে তাদের হার মানতে হতে পারে! এভাবেই ছয় দফা দাবির প্রবক্তা হয়ে উঠেন শেখ মুজিব। কী ছিল সেই দাবিতে- তা আরেকবার পড়ে দেখা যাক।

১. পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাধীন সংসদীয় পদ্ধতির সরকার। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠান।

২. কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মাত্র দুটি বিষয় থাকবে- প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অন্য সব বিষয়ে অঙ্গরাজ্যগুলোর পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।

৩. সারা দেশে হয় অবাধে বিনিয়োগযোগ্য দুই ধরনের মুদ্রা, না হয় বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে একই ধরনের মুদ্রা প্রচলন করা।

৪. সব ধরনের কর ধার্য করার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। আঞ্চলিক সরকারের আদায় করা রাজস্বের একটা নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে।

৫. অঙ্গরাজ্যগুলো নিজেদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মালিক হবে। এর নির্ধারিত অংশ তারা কেন্দ্রকে দেবে।

৬. অঙ্গরাজ্যগুলোকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য আধা সামরিক বাহিনী গঠন করার ক্ষমতা দেওয়া।

এই ছয় দফা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিকসহ সব অধিকারের কথা তুলে ধরে এটাই জানিয়ে দেয় যে- এই প্রদেশ স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আইয়ুব খান সরকার ৬ দফাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মসূচি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। এতে প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতার কথা বলা না হলেও এই ছয় দফা কর্মসূচি বাঙালিদের স্বাধীনতার মন্ত্রে গভীরভাবে উজ্জীবিত করে। এটি ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।

ঠিক এমনি এক সময়ে তাঁকে 'বঙ্গবন্ধু' খেতাবে ভূষিত করা হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবের সম্মানে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক সভার আয়োজন করে। লাখো জনতার এই সম্মেলনে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়। উপাধি ঘোষণা দিয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ। এ সভায় রাখা বক্তৃতায় শেখ মুজিব ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফা দাবির পক্ষে তার পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। ছয় দফা ও এগারো দফা দাবি বাঙালি জাতির রক্ষাকবচে পরিণত হয় ক্রমশ। এমন ক্রান্তিকালের সূচনা ঘটিয়ে আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দেন আরেক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে। এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বাঙালি জাতিকে যেকোনোভাবে দাবায়ে রাখার সকল প্রস্তুতি নিয়েছে পশ্চিমা জেনারেলরা। উনসত্তরে গণঅভ্যুত্থানের রক্ত ঝরে আবারও এই ভূখণ্ডে।

১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এরপরেই শুরু হয় ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা। ঢাকায় আসেন ইয়াহিয়া খান। আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। কিন্তু তারা দুজনেই কোনো না কোনোভাবে পাকিস্তানিদের পক্ষে কথা বলেন। তারা জানাতে চান, বাঙালিদের শাসন পাকিস্তানিরা মেনে নেবে না! প্রশ্নটি সেই সময়েই মোটাদাগে আসে, তাহলে বাঙালি জাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও কীভাবে পাকিস্তানিদের শাসন মেনে নিয়েছিল!

ইয়াহিয়া-ভুট্টো রাতের আঁধারে পালিয়ে যান পাকিস্তানে। অন্যদিকে পাকিস্তানি জেনারেলরা হামলে পড়ে বাঙালি জাতির উপর। ৭ই মার্চ সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। মূলত সেইদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম, প্রকাশ্যে। ২৫ মার্চের কালোরাত নামে বাংলায়। শেখ মুজিবকে হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। গঠিত হয় অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার। তাঁদের নেতৃত্বেই শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।

মুভিটি এভাবেই এগোতে থাকে। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়েন ঢাকায়। ঠিক সেই সময়েই বাংলার মানুষ অনুভব করতে থাকে একজন মুজিবকে- যিনি বাঙালি জাতির পিতা।

পাকিস্তানের কারাগারের পাশে শেখ মুজিবের জন্য কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছিল। সেই দৃশ্যও দেখানো হয় এই মুভির অধ্যায়ে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী যে অসীম প্রজ্ঞা ও সাহস নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন- তা দর্শককে অবিভূত করেছে বার বার।

১০ই জানুয়ারি ১৯৭২, লন্ডন হয়ে ঢাকার বুকে এসে নামেন বঙ্গবন্ধু।

এই মাটি ছুঁয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

শুরু হয় বাংলাদেশ গড়ার কাজ। বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেন- এই বাংলায় তাঁর কোনো শত্রু নেই। ১৯৭৪ সালে সাজানো দুর্ভিক্ষ নেমে আসে বাংলাদেশে। আমি এখনও মনে করি, বিশ্বের সাহায্য পেলে এই দুর্ভিক্ষ ঠেকানো যেত। এর দোষারূপের বোঝা বহন করতে হয় সদ্য স্বাধীন দেশের স্থপতি শেখ মুজিবকে।

১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্ট পর্যন্ত মাত্র সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্র শাসনের সুযোগ পেয়েছিলেন ৫৫ বছর বয়সি এই রাষ্ট্র নায়ক। তাঁকে বিদেশি বন্ধুরা বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন, তাঁকে হত্যা করা হতে পারে! তিনি তা আমলে নেননি। আমি এখনও ভেবে অবাক হই, একজন রাষ্ট্রপ্রধান কীভাবে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের একটি অরক্ষিত বাড়িতে থাকতেন খুব সাধারণ পুলিশি পাহারায়!

বঙ্গবন্ধু সীমিত সময়ের জন্য বাকশালের ডাক দিয়েছিলেন। যে চার নেতা তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাঁর অবর্তমানে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন- তাঁরা অবিচল ছিলেন শেষ পর্যন্ত। খন্দকার মোশতাককে একটি খল চরিত্রে দেখানো হয়েছে এই মুভিতে শুরু থেকেই। নেমে আসে সেই কালো রাত ১৫ই আগস্ট! জাতির পিতাকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে একটি খুনি চক্র, সপরিবারে! একটি স্ট্যানগান হতে মেজর হুদা এগিয়ে আসছে বঙ্গবন্ধুর দিকে! বঙ্গবন্ধু গর্জে ওঠে বলেন- 'এই তুই হুদা না! আমি তোকে চিনি! তোর বাপে কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগ করে না! কেঁপে উঠে হুদার হাত! পেছন থেকে নূর চৌধুরী নামের আরেক খুনি এগিয়ে এসে গুলি চালায়!

৩রা নভেম্বর জেলের ভেতরে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে খুনীরা সেই কুখ্যাত চক্রান্তকারী খন্দকার মোশতাকের আদেশে।

এভাবেই ১৫ই আগস্টের খুনিরা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি চক্রান্তে জিয়াউর রহমানও নেপথ্যে ছিলন- তা জানতে শুরু করে বাংলার মানুষ! সিনেমাটিতে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরিফিন শুভ। খন্দকার মোশতাক আহমদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু। কিশোর শেখ মুজিব চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিব্য জ্যোতি।

এ ছাড়া রেণু (শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) চরিত্রে অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা, শেখ হাসিনা চরিত্রে নুসরাত ফারিয়া, শেখ রেহানা চরিত্রে সাবিলা নূর, সোহারাওয়ার্দী চরিত্রে তৌকির আহমেদ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ, তাজউদ্দীন আহমদ চরিত্রে রিয়াজ, এ কে ফজলুল হক চরিত্রে শহীদুল আলম সাচ্চু, টিক্কা খান চরিত্রে জায়েদ খানসহ অনেকেই অভিনয় করেছেন।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন খায়রুল আলম সবুজ (লুৎফর রহমান), দিলারা জামান (সায়েরা খাতুন), সায়েম সামাদ (সৈয়দ নজরুল ইসলাম), প্রার্থনা ফারদিন দীঘি (ছোটো রেনু), গাজী রাকায়েত (আবদুল হামিদ), সিয়াম আহমেদ (শওকত মিয়া), মিশা সওদাগর (জেনারেল আইয়ুব খান) ও এলিনা (বেগম খালেদা জিয়া)। সিনেমাটিতে ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন শ্রীজা ভট্টাচার্য, রাজেন মোদি, দেবাশীষ নাহা, সোমনাথ, কৃষ্ণকলি গাঙ্গুলি, আবির সুফি, অরুণাংশু রায় প্রমুখ।

জাতির পিতার এই বায়োপিকের নির্মাতা, মি. শ্যাম বেনেগাল তাঁর পুরো মেধা খাটিয়েছেন এর পেছনে। বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ ও ভারতের ৪০ শতাংশ ব্যয়ে ২০১৯ সালে সিনেমাটির কাজ শুরু হয়। ২০২১ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে মুম্বাইয়ের দাদা সাহেব ফালকে স্টুডিওতে চলচ্চিত্রটির প্রথম ধাপের শুটিং শুরু হয়ে ১৮ই ডিসেম্বর বাংলাদেশে শেষ হয়। ২০২২-এর ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে চলচ্চিত্রটির প্রথম পোস্টার, ৩রা মে দ্বিতীয় পোস্টার ও ১৯শে মে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটির ট্রেইলার রিলিজ করা হয়। বঙ্গবন্ধু মুজিবের নেপথ্যের প্রধান শক্তি ছিলে তাঁর স্ত্রী রেণু। বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব, পেছনে দাঁড়িয়ে জাতির পিতার নীতি-নির্ধারণে সাহস ও প্রত্যয় জুগিয়েছেন। এটা স্পষ্ট বুঝা যায় বায়োপিকটির পরতে পরতে।

একজন মুজিব, যিনি গ্রাম থেকে উঠে আসা- তিনি তাঁর মা-বাবার কাছ থেকে কী রাজনৈতিক উপদেশ পেয়েছিলেন, তা জানার জন্যেই মুভিটি দেখতে হবে আজকের প্রজন্মকে। এই বায়োপিকের একটি অন্যতম চরিত্র 'লাল মওলানা' ভাসানী। মুভিতে দেখে (এবং অন্যান্য পঠন-পাঠন শেষে) আমার ভাসানীকে একজন কনফিউজড পলিটিশিয়ান বলেই মনে হয়েছে সব সময়। এই তো সেই ভাসানী, যিনি জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার পর খুনিচক্রকে প্রকাশ্যে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন! তা তো আমার নিজেরই দেখা, পড়া! মুজিব, ভাসানীর চরিত্র জানতেন। কিন্তু তারপরেও তিনি ভাসানীকে অসম্মান কিংবা খটো করেননি। এটাই ছিল আকাশের মতো তাঁর উদারচিত্তের পরিচয়। আমি আশা করবো, এই প্রজন্ম মুজিবের মাঝে তাদের প্রজ্ঞা ও মনন খুঁজে পাবে। প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালির উচিত, শেখ মুজিবের এই বায়োপিকটি দেখা। তবেই তারা জানতে বুঝতে পারবেন, একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য একজন নেতা কী পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে পেরেছিলেন। গভীর সংকটে কতটা ধীর থাকতে পারতেন তিনি। এই বায়োপিক, বড়োসড়ো প্রচারের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হোক। আরও বিশাল ক্যানভাসে ছড়িয়ে পড়ুক মানুষে মানুষে।

ফকির ইলিয়াস: কলাম লেখক, কবি ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :