মহামান্যের সমাবর্তন ভাষণ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের দিনগুলি

ড. ফরিদ আহমেদ
| আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০২২, ১১:৩০ | প্রকাশিত : ২৫ নভেম্বর ২০২২, ১০:২৫

ইচ্ছে ছিল এবারকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের দিনে বিভাগ/হল/বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো। আমাদের কপালে সমাবর্তন জোটেনি, কারণ স্বৈরাচারী এরশাদ ছিলেন আচার্য। উনার কাছ থেকে আমরা যেমন সনদ নিতে চাইনি, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিতে চায়নি। সেই সাহসী হিমালয়ের মতো সুউচ্চ নৈতিকতার অধিকারী শিক্ষকের অভাব আজ সমাজকে ভাবিয়ে তুলেছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও আচার্যের সমাবর্তন ভাষণে সেটাই ফুটে উঠেছে।

এবার সতর্ক বার্তা ছিল অজানা প্রান্তের অজানা কণ্ঠ থেকে- আগামী এক মাস যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না যাই! সুতরাং, ঘরে বসে স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপচারিতায়। ১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৯১ সালে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হওয়া পর্যন্ত আমার সময়গুলো কেটেছে কবি জসীমউদ্দীন হলে। চারতলায় আমার রুম ছিল। একান্ত আমার একটি সিট যা আমার মেধার স্বীকৃতি।

রুমমেট হিসেবে যাদের পেয়েছিলাম তাদের মধ্য থেকে করোনায় হারিয়েছি স্কুল জীবনের বন্ধু আহসানুল ইসলাম ডিককে। ডিক ফিন্যান্সের ছাত্র ছিল। খুবই পরোপকারী বন্ধু। নিজের ক্ষতি করে বন্ধুর উপকার করা ছিল ডিকের স্বভাব। স্বৈরাচারী এরশাদের নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ তাকে কিছু দিনের জন্য হল ছাড়তে বাধ্য করেছিল। বিষয়- হলে সিট দখল নিয়ে নতুন বাংলা ছাত্রসমাজের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিল ডিক। নতুন বাংলা ছাত্রসমাজের নেতারা তাদের মতো করে হল চালাতে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রলীগ/সমাজকে তখন প্রতিপক্ষ হিসেবে নিয়ে নিপীড়ন করতো। মারধর ছাড়া ফ্লোরে থুথু ফেলে সেটা চেটে খেতে বাধ্য করতো! সেই বীভৎস নিপীড়ণের স্বীকার ছাত্রনেতারা দেশের মন্ত্রী-উপদেষ্টা হয়েছেন।

আমার আরেক রুমমেট ছিলেন স ম আলাউদ্দিন। খুবই হাসিখুশি একজন মানুষ। ইতিহাসের এই ছাত্র সচিবালয় ঘেরাও করতে চলে যেতেন। এরশাদবিরোধী এমন কোনো আন্দোলন নেই, যে আন্দোলনে আলাউদ্দিন ভাই থাকেননি। গণতন্ত্রের আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান এই সেদিন সমাবর্তন উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি স্বীকার করলেন। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মহামান্য বেশ কিছু কথা বলেছেন যা জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। ১৯৯০ সালের ১১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এরশাদের আদেশ অমান্য করে যে আন্দোলন শুরু করেছিল সেকথা আমি আগের লেখায় বলেছি।

মুক্তির সংগ্রামে, স্বাধীনতার সংগ্রামে শহীদ হয়েছেন শিক্ষকরা। সেই জাতির বিবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এরশাদের জরুরি আইন অমান্য করে ৬ ডিসেম্বর রাজপথে নামে এবং একযোগে সকলে পদত্যাগ করেন। গণতন্ত্রের প্রতি এই শ্রদ্ধা দেখিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। আজ মহামান্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে আক্ষেপ করে বলছেন, শিক্ষকদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার কথা।

মহামান্য বিনয়ের সঙ্গে আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে পারি কি? আপনি কি ভেবেছেন স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে কেন এমন হলো? গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী ২০০৭ সালে কি ঝুঁকি নিয়েছিলেন, কিভাবে তারা জেল খেটেছেন, কিভাবে তাদেরকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেগুলো কি আমরা মনে রেখেছি? পাঠকদের কাছে বিনয়ের সঙ্গে মন জানতে চায়, আমাদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্রের সুফল ভোগ কারা করছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির কোনায় ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ডাক্তার মিলনকে হত্যা করা হয়েছিল খুবই ঠান্ডা মাথায়। সবচেয়ে মেধাবী সেই ডাক্তাররা কি কখনো প্রথম গ্রেড পায়? সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-কর্মচারী-কর্মকর্তাগুলো তান্ডবে ছিল দিশেহারা। প্রাণভয়ে সকলে ছুটেছিল। কোথা থেকে গুলি আসছিল কেউ বুঝতে পারছিলাম না। সেদিন যারা রুখে দিয়েছিল তারা কিভাবে অবহেলিত তা কি আমাদের অজানা!

আমাদের সকল সুযোগ সুবিধা পান যারা তাদের সম্পর্কে আজ না-ই বললাম। কিন্তু শিক্ষকদের জীবন কিভাবে কাটছে সেটাও যেন আমরা দেখি। সমাজ দেখেও না দেখার ভান করে- ট্যাক্স, ভ্যাট সবই কিন্তু শিক্ষকরা দেন। আর কারা ট্যাক্স ফাঁকি দেয়, বিদেশে অর্থপাচার করে সেটাও আজ অজানা নয়। কিন্তু শিক্ষকদের কষ্টকে বিবেচনায় না রেখে রসালোভাবে বলা হয় ‘ভর্তি পরীক্ষার টাকা ভাগ বাটোয়ারা’ করে খায় শিক্ষকরা।

সবচেয়ে মেধাবী যে ছাত্রটি শিক্ষক হয়েছেন তাকে ধুলো মাখিয়ে কাদের সন্তানেরা রাজবেশে চলে যান, সমাজ কি তা জানে না? অপেক্ষা করতে করতে যখন আর কোনো উপায় বা সম্ভাবনা দেখেন না, তখন তারা যাচ্ছেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা সান্ধ্যকালীন ক্লাসে। এভাবে শিক্ষকদেরকে তাদের আদর্শের পথ থেকে নিয়ে গেল যে বাজার অর্থনীতি তার দায় কি কেবল শিক্ষকদের? সেটা অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।

১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ডাক্তার মিলন শহীদি মৃত্যুবরণ করেন। এই বিষয়ে এক লেখক লিখেছেন ‘তার মৃত্যুতে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন দাবানলে রূপ নেয়। ডাক্তাররা শুরু করেন অবিরাম কর্মবিরতি। গণপদত্যাগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। জরুরি অবস্থা জারি করে স্বৈর সরকার। কিন্তু সেই জরুরি অবস্থা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসে ছাত্রছাত্রীদের মিছিল। নয় বছরের রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেয়ে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে ঢাকার রাস্তায় বেরিয়ে আসেন নাগরিকরা। সারাদেশে বিভিন্ন জায়গায় নিরাপত্তারক্ষীদের সাথে সংঘর্ষে প্রাণ দেন আরও অনেকে। এভাবেই মিলনের মৃত্যুর ভেতর দিয়ে এরশাদের পতনের শেষ অধ্যায় রচিত হয়। ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এরশাদ (জহিরুল হক মজুমদার)।

আজ আমাদের সবচেয়ে জরুরি কাজ, কেন শহীদ ডাক্তার মিলনের সতীর্থরা মনোনয়ন পেয়ে কাদের কাছে নির্বাচনে হেরে যায় তা অনুসন্ধান করা! পেশাজীবীরা কি এমনিতেই তাদের শপথ ভুলে সরল সঠিক পথ থেকে সরে গেছেন, নাকি নির্লিপ্ত সমাজ জনপ্রিয়তা দিয়ে তাদেরকে বিতাড়ন করেছে?

আজ আমরা সেই আগেরই মতো বড়ো বড়ো জনসভা দেখছি। সে বিষয়ে গতকাল (২৪ নভেম্বর) মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘রাজপথে শক্তি দেখিয়ে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচন হবে না (প্রথম আলো)।

তার বক্তব্য থেকে এ কথা বলা যায়- আমরা সঠিক পথ থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গেছি। আমাদের এখন থামতে হবে এবং সেই কাজটি বিশ্ববিদ্যালয় তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে জাতি আশা করে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়েছিল সেই গভীর নর্দমা থেকে জাতিকে সঠিক পথ দেখাতে যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাতিঘর হিসেবে কাজ করেছিল- আজ আবার সেই মহান দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিতে হবে সেই আহবান মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষণে আছে।

আজ হুমকির রাজনীতিতে জনগণ ভীত! আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষক সমাজকে আলোর পথ দেখাতে হবে। শহীদ মিলনের স্মৃতিস্তম্ভে কেবল এক তোড়া ফুল কিংবা একটি আলোচনা সভা নয়- জাতীয় সমস্যার আরও গভীরে গিয়ে জাতিকে পথ দেখাতে হবে।

মহামান্য শিক্ষকদের নৈতিক অবক্ষয়ের কথা বলেছেন যাতে আমরা জেগে উঠি- দেশের সুনাগরিক হিসেবে যে মহান দায়িত্ব শিক্ষকরা পেয়েছেন সেটা যেন পালন করি। মহামান্য আপনার আবেদনে আমরা সাড়া দেব। তবে যুগের পর যুগ যেভাবে শিক্ষকদেরকে অবহেলা করা হয়েছে তারও অবসানে আপনার সমর্থন চাই। শিক্ষকরা যাতে সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারে সেই দাবিটি কি আমি আপনার কাছে বিনীতভাবে সীমিত পরিসরে করতে পারি?

মহামান্যর আরেকটি আক্ষেপ- শিক্ষক নিয়োগে যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয় মেধাকে মূল্যায়ন করে। আমার জানা মতে, আপনার কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে কিভাবে মেধাকে অবমূল্যায়ন করে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। মহামান্য আপনি জানেন কোন কোন শিক্ষক বা উপাচার্য/প্রো-উপাচার্য দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা তো জনগণের নেই- কেবল আপনার আছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে আপনি অবিলম্বে তাদেরকে অপসারনের ব্যবস্থা নেবেন কি?

শিক্ষকদের বিবেক জাগরণের পাশাপাশি জাতি আপনার কাছে উপাচার্য অপসারণের মতো কঠোর পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছে- সরকার যেভাবে বাধ্যতামূলক অবসর দিচ্ছে ঠিক একই ভাবে। দুর্নীতিবাজ উপাচার্যদের সরিয়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে কালিমামুক্ত করতে আপনার কাছে আমাদের মতো সাধারণ শিক্ষকদের আকুল আবেদন আদৌ পৌঁছাবে কি?

মহামান্য ক্ষমা করবেন; আমাদের অপারগতার জন্য- ক্ষমা করবেন আমার অবোধ প্রশ্নগুলোর জন্য- কারণ আমি তো এখনো ছাত্র- শিক্ষক হতে পারিনি!

লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :