রাজশাহীর গণসমাবেশস্থলে যেভাবে রাত কাটালেন বিএনপির নেতাকর্মীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী থেকে
| আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:০৭ | প্রকাশিত : ০২ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:০২
রাজশাহীর শাহমখদুম (র.) কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে রান্নাবান্না করছেb নেতাকর্মীরা

রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা মাঠে বিএনপির ডাকা বিভাগীয় গণসমাবেশস্থলে নেতাকর্মীদের প্রবেশে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত অনুমতি দেয়নি স্থানীয় প্রশাসন। যার ফলে শহরের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে তাঁবু টানিয়ে রাতযাপন করেছেন বিভিন্ন জেলা থেকে আসা দলীয় নেতাকর্মীরা।

বৃহস্পতিবার থেকে রাজশাহী বিভাগে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিবহন ধর্মঘট ডাকায় মঙ্গলবার থেকেই বিভিন্ন জেলা থেকে নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে আসতে থাকেন। আসার পথে পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের বাধার সম্মুখীন হয়েছেন বলে জানিয়েছেন অনেক নেতাকর্মী।

এদিকে, কেন্দ্রীয় স্থানীয় ও আট জেলার নেতাদের ব্যানার ফেস্টুন পোস্টারে ছেয়ে গেছে নগরী। খণ্ডখণ্ড মিছিলে মুখর রাজশাহী। গভীর রাতেও নগরীতে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত ছিল পুরো নগরী।

কয়েকদিন থেকে চলছে মাইকিং। পথে পথে পুলিশী বাধা উপেক্ষা করেও হাজার হাজার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ আসছে গণসমাবেশে। আগত নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ঠাঁই হচ্ছে মাদ্রাসা মাঠের পাশেই ঈদগাহ মাঠে। শীতে কেউ তাঁবুর ভিতর কেউ খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন করছেন। জাসাসের নেতাকর্মীরা সারারাত গান গেয়ে সমাবেশে আসা জনতাকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন। দল থেকে ব্যবস্থা করা হয় বিনামূল্য পানি।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত কয়েক লাখ নেতাকর্মী বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে রাজশাহী এসে পৌঁছান। এ সংখ্যা বাড়ছেই। তারা রাজশাহীতে আবাসিক হোটেল ও কমিউনিটি সেন্টারে থাকার সুযোগ না পেয়ে খোলা জায়গায় রাতযাপন করছেন। এছাড়া যারা যেভাবে পারছেন নিজেদের মতো করে অবস্থান নিয়ে থাকছেন।

বৃহস্পতিবার রাত একটায় রাজশাহী নগরীর ঈদগাঁ মাঠে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে নির্ধারিত সময়ের আগেই বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নেতাকর্মীরা ঈদগাহ মাঠের মধ্যে প্লাস্টিক দিয়ে তাঁবু টাঙ্গিয়ে তার মধ্যে অবস্থান করেন। মাঠের মধ্যে চলে নেতাকর্মীদের খাওয়া দাওয়া। শীতের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে কেউ ঘুমিয়ে কেউ গল্প করে সময় কাটান।

সমাবেশের তিনদিন আগেই এসেছেন জয়পুরহাটের সদর থানা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক রুবিয়া। তিনি বলেন, ‘রাজশাহী বিভাগে তিন দিনের পরিবহন ডাকা হয়েছে, এজন্য সমাবেশ সফল করার জন্য তিনদিন আগেই নগরীতে চলে এসেছি। আসার সময় পরিকল্পিতভাবে ট্রেনের মধ্যে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বেগম খালে জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং আমার নিজের ভোট যাতে প্রয়োগ করতে পারি এ সকল দাবি নিয়ে সমাবেশে এসেছি। এই সরকারের প্রতন চাই, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই। জনগণ আমাদের পাশে রয়েছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই এই সরকারকে টেনেহেচড়ে ক্ষমতা থেকে নামাব এবং বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করব।’

সমাবেশের পাঁচ দিন আগে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর থেকে এসেছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী পলাশ শেখ। তিনি বলেন, ‘সমাবেশের আগে তিন দিনের ধর্মঘট ডাকা হয়েছে, এজন্য ধর্মঘটের আগে সমাবেশস্থলে এসে উপস্থিত হয়েছি।’

তিনি জানান, সিরাজগঞ্জ থেকে আগত নেতাকর্মীরা রাস্তার পাশে খোলা আকাশের নিচে ও গাছের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। এখানে রান্নার কাজ ও খাওয়া দাওয়া চলছে। খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানকে দেশে আনার দাবি ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সমাবেশে উপস্থিত হয়েছেন তারা।

আটটি শর্তে রাজশাহীতে বিএনপিকে গণসমাবেশের অনুমতি দিয়েছে পুলিশ। প্রতিটি বিভাগীয় গণসমাবেশের আগেই ডাকা হচ্ছে গণপরিবহন ধর্মঘট। তাই আগে থেকেই নেতাকর্মীরা আসছেন রাজশাহীতে।

নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে ও সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পথে পথে পুলিশি বাধার কারণে অন্তত ১০ থেকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত পায়ে হেঁটে নেতাকর্মীরা রাজশাহী আসছেন। একে তো পরিবহন ধর্মঘট, তার ওপর নিজস্ব ও ভাড়া করা পরিবহনে বুধবার রাতে ও বৃহস্পতিবার রাজশাহী আসার পথে পুলিশি বাধার কারণে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে রাজশাহী পৌঁছান নেতাকর্মীরা। এতে তারা মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়েন।

বেগম বদরুন্নেসা কলেজ ছাত্রদলের সাবেক ভিপি ও পাবনার সাথিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি খায়রুন নাহার খানম মিরু বলেন, বুধবার রাতে আমার নিজ এলাকা থেকে বাসে করে ছয় শতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে রাজশাহী আসছিলাম। পথে কাটাখালী আসার আগেই পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয়। শেষ পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে রাজশাহী পৌঁছি।

রাজশাহীতে গণসমাবেশের উদ্দেশ্যে বুধবার রাতে বগুড়া থেকে বাসে রওনা দিয়েছিলেন অন্তত ৫০০ নেতাকর্মী। কিন্তু পথেই তারা রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার কামারপাড়া এলাকায় পুলিশি বাধার মুখ পড়েন। এ ব্যাপারে বগুড়া শহর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম মর্শেদুল মিঠন বলেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে বগুড়া থেকে রাজশাহী আসছিলেন। পথে কামারপাড়া এলাকায় পৌঁছলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় একটি গাড়ির কাঁচ ভাঙচুর করা হয়। এক নেতা মাথায় রক্তাক্ত জখম হন। একপর্যায়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। পরে সেখান থেকে ৩০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে সকাল সাড়ে ৬টায় তারা রাজশাহী নগরীতে এসে পৌঁছান।

একইভাবে বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে নেতাকর্মীরা রাজশাহী আসার পথে বিভিন্ন স্থানে পুলিশি বাধার সম্মুখীন হন। পরে তারা পায়ে হেঁটে রাজশাহী পৌঁছান। বিভিন্ন দূরবর্তী এলাকা থেকে বহু কষ্টে নেতাকর্মীরা রাজশাহী পৌঁছার পর পদ্মা নদীর ধারে ও নগরীর অন্য ফাঁকা জায়গায় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটান।

মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেলিম বাদশা বলেন, ‘বেশ কিছু গাড়ির কাগজপত্র ছিল না। এ ধরনের গাড়িতে করে লোকজন আসছিল। এসব গাড়ি নিয়ে নাশকতা ঘটানোর আশঙ্কা রয়েছে।’

এজন্য গাড়ি ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। এছাড়া রাজশাহী মহানগর ও মোহনপুর থানার সীমানায় ব্যাপক যানজট দেখা দিয়েছিল। তবে কেউ আহত হননি বা ভাঙচুরের কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে জানান ওসি।

মাদরাসা মাঠ সংলগ্ন শাহমখদুম ঈদগাহ মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী কেউ খোলা আকাশের নিচে, কেউ গাছতলায় কিংবা কাপড়ের তাঁবু বানিয়ে মাঠে খড়ের ওপর জটলা করে শুয়ে রয়েছেন। তাদের শৌচকার্যের জন্য অদূরেই বাঁধের ওপারে নদীর বালুর ওপর তৈরি করা হয়েছে সীমিত পরিসরে অস্থায়ী শৌচাগার।

রাতে আবু বক্কর নামের এক ব্যক্তি নওগাঁ থেকে রাজশাহী এসে পৌঁছান। পরনে কাফনের কাপড় পরা ওই ব্যক্তি বলেন, গণসমাবেশ স্থলে দাবি আদায় করেই তবে ঘরে ফিরবেন তিনি। তাই প্রস্তুত হয়েই এসেছেন।

বগুড়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ঘুরে ঘুরে খোলা আকাশের নিচে থাকা কর্মীদের খোঁজখবর নেন। তিনি বলেন, আজকের (বৃহস্পতিবার) মধ্যেই তাদের জেলা থেকে ট্রাকে করে শত শত মানুষ চলে আসবেন। পথে পথে পুলিশি বাধা রয়েছে। তারপরও নেতাকর্মীরা ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে চলে আসছেন।

রাজশাহী মহানগর যুবদলের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম রবি দূর থেকে আসা কর্মীদের তদারকি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন। কোনো সমস্যা হলে সমাধানের চেষ্টা করছেন।

সিরাজগঞ্জ জেলার নুরুন্নবীকে দেখা গেল মুড়িভর্তি বড় পলিথিন হাতে নিয়ে কর্মীদের ডেকে বেড়াচ্ছেন। অনেকেই তার কাছে এসে চিড়া ও মুড়ি খেয়ে যাচ্ছেন। তিনি জানান, খাবার হিসেবে চিড়া, মুড়ি ও পানি মজুদ রয়েছে। অনেকেই চাল, ডাল, সবজি, তেল একসাথে বেঁধে নিয়ে এসেছেন। মাঠের বিভিন্ন স্থানে জটলার পাশে অস্থায়ী চুলায় রান্না বসানো হয়েছে। মাঠে বসে কেউ রান্না করছেন খিচুড়ি, কেউবা সবজি ভাত।

এই তিন দিন কী খাবেন জানতে চাইলে সমাবেশে আসা বৃদ্ধ মোতালেব বলেন, পেলে খাব না পেলে খাব না। পরিবারের কী হবে এই তিন দিন, এমন প্রশ্নে তার উত্তর আল্লাহ দেখবেন। এমন অনেক নেতাকর্মীর তিন দিনের আবাস এখন কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ ও আশপাশের এলাকা।

এদিকে রাজশাহী নগরীর নিরাপত্তায় এরই মধ্যে প্রতিটি প্রবেশমুখে পুলিশি পাহারা বাড়ানো হয়েছে। মাদরাসা মাঠ সমাবেশ কেন্দ্রের পাশেও পুলিশ সদস্যদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তবে বিএনপির এই গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে সীমাহীন দুর্ভোগ ও কষ্টের সবকিছু ছাপিয়ে দলটির নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন।

(ঢাকাটাইমস/০২ডিসেম্বর/এফএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজনীতি এর সর্বশেষ

আওয়ামী লীগ নিজেদের নৌকা নিজেরাই ডুবিয়েছে: মঈন খান

দেশের মানুষকে আর বোকা বানানো যাবে না: সালাম

নির্বাচনের পর বিরোধী দলগুলোর ওপর নানা কায়দায় নির্যাতন চালাচ্ছে আ.লীগ: মির্জা ফখরুল

বিএনপিসহ গণতন্ত্রকামী জনগণকে সরকার বন্দি করে রেখেছে: রিজভী 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারায় বিএনপি: ওবায়দুল কাদের

ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক

এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হতে আ.লীগের ‘মানা’

মুজিবনগর সরকারের ৪০০ টাকা বেতনের কর্মচারী ছিলেন জিয়াউর রহমান: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

বিএনপি নেতা হাবিব কারাগারে

উপজেলা নির্বাচন সরকারের আরেকটা ‘ভাঁওতাবাজি': আমীর খসরু

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :