যথার্থ মানুষ সফল মানুষ আলোকিত মানুষ

রেজাউল মাসুদ
 | প্রকাশিত : ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:০৪

ছুটিতে আমি তখন গ্রামের বাড়ীতে। কোরবানীর ঈদের এক বিকালে আমলীতলা বাজারে আসতে বলে ভাই আমায়। বাজারে গিয়ে দেখি গ্রামের মানুষে যেন পুরো এলাকা ভরে গেছে। আশপাশের গ্রামের অনেক মানুষজনও এসেছে। মিটিং এ নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। সবার প্রাণের দাবী একটাই, বাজারে একটা মসজিদ করে দিতে হবে। আমলীতলা বাজারে কমিউনিটি ক্লিনিক, স্কুল, মাদ্রাসা, ঈদগাহ মাঠ থাকলেও কোন মসজিদ ছিলনা। কোনরকম ছাপড়া একটা ঘরে ওয়াক্ত নামাযের জন্য ইবাদত খানা ছিল।

ভাইটি আমায় বলে "তুমি এখানকার মক্তবে পড়েছো, আমাদের গ্রাম এবং পাশবর্তি মামার গ্রামে দুটো মসজিদ করে দিয়েছো তুমি।পুরো গ্রামের কেন্দ্রীয় কবরস্হান এখানে যেখানে তোমার বাবা আমার বাবা মাসহ গ্রামের বহু মানুষ চিরনিদ্রায় শায়িত, এখানে একটা সুন্দর মসজিদ নির্মান করা খুব বেশী দরকার। গ্রামের আলোবাতাসে বড় হয়ে তুমি আজ ভাল একটা অবস্হানে, তোমার পজিশন স্টাটাস দিয়ে গ্রামবাসীর জন্য এ বাজারে একটা মসজিদ নির্মান করে দাও।"

আমার ভাইয়ের এ কথায় যেন পুরো গ্রাম একহয়ে সমস্বরে আনন্দে চিৎকার করে উঠে। ভাইটির দরদমাখা দাযিত্বশীল কথাগুলো আমার মনে ভীষনভাবে রেখাপাত করে। মসজিদ নির্মানে ভীষন ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠি আমি। চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমি তখন। জেলার সাতকানিয়ার এমপি আবু রেজা মোঃ নদভী সাহেবের সাথে আমার বেশ সুসম্পর্ক। দরিদ্র অসহায় গ্রামের মানুষগুলোর প্রাণের দাবী তার কাছে পৌঁছে দিই। ।আমলীতলা বাজারে একুশ লাখ টাকা ব্যয়ে এমপি সাহেব তার স্পেশাল এসাইনমেন্ট নিয়ে দৃস্টিনন্দন মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মান করে দেন। সাথে মাদ্রাসা, ওজুখানা ওয়াসরুম, মেহরাব, কার্পেট এবং মাইকসহ বেশকিছু ফান্ডেরও ব্যবস্হা করে দেন তিনি।

আজাদ ভাইয়ের কথা বলছিলাম। আমার খালাত ভাই তিনি। স্কুলে আমার চার ক্লাশ সিনিয়র। আমি যখন সিক্সে ভর্তি হই তখন ক্লাশ টেন র ফার্স্ট বয় আজাদ ভাই। যেমন ব্রিলিয়ান্ট তেমন সুদর্শন আর বাকপটু। ভারুয়াখালী স্কুলের সকল শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্র আজাদ ভাই দারুন রেজাল্ট করে হৈচৈ তেরী করেন সেবছর। আমি ভাবতাম যদি তার মত হতে পারতাম। এইচ এসসি তে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকেও অনেক ভাল রেজাল্ট করে চুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংএ গ্রাজুয়েট করেন। মামা এবং আমার আম্মা আব্বার অনেক পছন্দের এ ভাগ্নের সবসময় উদাহরণ দিয়ে বলত তার মত ইঞ্জিনিয়ার হবি তুই। চুয়েটে ভর্তি পরীক্ষাও দিয়েছিলাম, আমার পড়া হযে উঠেনি সেখানটায়।

ঢাকা ভার্সিটি থেকে আমরা কয়েকজন বন্ধু একবার কক্সবাজার ভ্রমণে যাই। আজাদ ভাই তখন চুয়েট শেষ বর্ষের ছাত্র। ছাত্রলীগ চুয়েট সভাপতি হয়েও চট্টগ্রাম শহরের মেহেদীবাগে থাকেন। তখন থেকেই অনেক দায়িত্বশীল সে। মাসের জন্য কোন খরচ নিতনা, বরং ভাইবোনদের নিয়মিত পড়াশুনার খরচ যোগাত ছাত্র অবস্হা থেকেই। কক্সবাজার যাওয়ার পথে বন্ধুরাসহ আজাদ ভাইয়ের সাথে দেখা করি। সারাদিন ঘুরিয়ে বিভিন্ন জায়গা দেখান আমাদের। দুপুরের খাবার খেয়ে কক্সবাজার যাওয়ার পথে আমায় একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলে ভ্রমণে যাচ্চিস, কিছু টাকা দিলাম, খরচ করিস। তার দায়িত্বপূর্ণ ভালবাসা দেখে আমি কেঁদে ফেলছিলাম তখন। আমার বন্ধুরা তো আজাদ ভাইয়ের আন্তরিকতা আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে যান।

আমার খালা খালু মারা গেছেন অনেক আগেই। খালুর পরিবারে একা থাকায় আজাদ ভাইয়ের চাচা কিংবা ফুপু ছিলনা। ওয়ার্লড ভিশনে অনেকদিন চাকুরী করে এখন নিজেই বেশ ভাল ব্যবসা করেন। নামকরা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানও রয়েছে তার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ভাবী মহিলা বিষয়ক সরকারী কর্মকর্তা। দু মেয়েকে নিয়ে জামালপুর শহরে থাকেন। কোরবানীর ঈদ এলেই কয়েকদিনের জন্য সবাইকে নিয়ে গ্রামে চলে আসেন। দুতিন দিন ধরে অব্যবহ্রত ঘরদোর পরিস্কার ঘষামাজা করে বসবাস উপযোগী করেন। গ্রামীন পরিবেশে ভাবী বাচ্চারাও একাজে নির্মল আনন্দ উপভোগ করেন। বোনদের সবাইকে দাওয়াত করেন। আমাদের আসতে বলেন, গ্রামবাসীকে নিয়ে নির্মোহ আনন্দে মেতে উঠেন কয়েকদিনের জন্য। আমি কাছ থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখি অসহায় গ্রামের মানুষজনদের পাশে থাকার কি যে আকুতি তার। তিনি সবসময় বলেন এ গ্রাম আমাদের অনেক দিয়েছে, এখন তাকে ফেরত দিতে হবে। সাহায্য সহযোগিতা দান খয়রাত যাকাত ফিতরায় তিনি অতুলনীয়। বাবা মার জন্য নিয়ম করে দোয়া, কোরআন খতম, কবর জিয়ারত তিনি সবসময়ই চালু রাখেন। চাকুরীপ্রার্থীদের সহায়তা, পড়াশুনায় ভালদের পাশে থাকা, নিপিড়ীতদের কাছে টেনে আইনী সহযোগিতায়ও তিনি বেশ পারঙ্গম। সারাবছরই এ কাজসমুহ তিনি অনেক দায়িত্ব নিয়ে করে থাকেন।

আমাদের গ্রামের সাথে পাশ্ববর্তী গ্রামের তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে একবার ভয়াভহ সংঘাত সংঘর্ষ হয়।প্রতিপক্ষ আমাদের গ্রামের অনেকের নামে মিথ্যা মামলা দেয়। গ্রামবাসীর পক্ষে আজাদ ভাই ত্রাতা হিসাবে প্রকাশ্যে নামে তখন।মিথ্যা মামলা ঠেকাতে বিশাল ভুমিকা রাখেন তিনি। শত্রুপক্ষ, তাদের নামে মামলা হয়। গ্রেফতার হয় অনেকে। আজাদ ভাই ছুটে বেড়ায় পলিটিক্যাল নেতৃত্বের কাছে, ওসি, এসপির কাছে। নিরীহ মানুষগুলো স্বস্তি পায় আর ক্রিমিনালগুলো নি:শর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করায় তাদের মাফ করে দেয়া হয়। গ্রামবাসীর কাছে সবসময়ের জন্য হিরো হয়ে উঠেন আজাদ ভাই।

আটভাই বোনের সংসারে আজাদ ভাইয়ের দায়িত্বশীল ভুমিকা সবসময় সবার মুখে মুখে। ভাই বোন ভাগ্নে ভাতিজিসহ আত্মীয়স্বজনদের নিয়মিত খোজখবর রাখা, যোগাযোগ রেখে তাদের সবসময পাশে থাকার মনমানুসিকতা বিষয়টি সবার জন্য আদর্শ এক উদাহরণ হতে পারে। খালু অনেক আর্লী বয়সেই চোখের সমস্যায় পড়লে চিকিৎসার জন্য মাদ্রাজ নিয়ে যাওয়ার বিশাল ভুমিকা রাখেন তিনি। খালার স্ট্রোকজনিত সমস্যায় ঘরে থাকাকালীন সময়ে আজাদ ভাই তার মা র প্রতি আদর যত্ন দরদ ভালবাসা দিয়ে সবসময় আগলে রাখার বিষয়টি আমাদের সকল সন্তানদের জন্য দারুন অনুকরনীয় হতে পারে। সম্প্রতি তার এক ভাতিজি মারাত্মক অসুস্হ্যতায় পতিত হলে তার লিভার ট্র্যান্সপ্লান্টর কথা উঠলে তিনি সমস্বরে দায়িত্ব নিয়ে বলেন, "টাকা যা লাগবে সব ম্যানেজ করব আমরা, চিকিৎসায় ইন্ডিয়া নেয়ার ব্যবস্হা করেন ডাক্তার সাহেব।"

সম্প্রতি আমলীতলা বাজারস্হ আমাদের কয়েকগ্রামের কেন্দ্রীয় কবরস্হান আশ্রায়ন প্রকল্পের আওতায় পতিত হন। আবারও গ্রামবাসীর পক্ষে জোড়ালো অবস্হান নেয়, আজাদ ভাই জনমত তৈরী করে লোকজনকে একত্রিত করেন, ডিসি সাহেবকে তার সিদ্বান্ত পরিবর্তনকরনে লোকজন নিয়ে অফিসে পরে থাকেন , রিস্ক নিয়ে এসিল্যান্ড ইউএনও দের সাথে দ্বিমত ভিন্নমত করে গ্রামের পক্ষে জোড়াল বক্তব্য উপস্হাপন করেন তিনি। উপর্যপুরি টানা হস্তক্ষেপে প্রশাসনিক জটিলতা থেকে অবশেষে গ্রামবাসী রক্ষা পান।তাদের কবরস্হান খুড়ে আশ্রায়নের ঘর নির্মান রিভিউ করে স্হগিত করা হয়। সকলের মুখে আনন্দের হাসি।মহত্ত্ব, উদারতা, উদার-স্বভাবের জন্য শুধু আমাদের এলাকায় নয়, সহজেই সর্বত্রই প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন তিনি, মানুষজনও প্রাণভরে দোয়া করতে থাকেন আজাদ ভাই র জন্য।

আজাদ ভাই একটা অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যে বলেছিলেন:

“আমরা সবাই কম বেশি নিজেকে নিয়েই ভাবতে পছন্দ করি। নিজের সুযোগ সুবিধা, আরাম আয়েশ, ভালোমন্দ সবার আগে হিসেব করে নিই। তবে সেটা যদি জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় এবং অন্যর কথা না ভেবে শুধু নিজেরটাই বেশি বেশি ভাবতে থাকি তাহলে তা বেশি স্বার্থপরতায় রূপ নেয়। বেঁচে থাকার তাগিদে এবং কাজে সফলতার জন্য কিছু মাত্রায় স্বার্থপরতা ভালো। তবে বেশি মাত্রায় স্বার্থপরতা সবসময়ই অন্যের জন্য সরাসরি এবং নিজের জন্য পরোক্ষভাবে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।”

আজাদ ভাইদের মত এমন জনদরদী নি:স্বার্থ পরোপকারী মানুষ খুব বেশী দরকার ইদানিং।

লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :