‘বিপজ্জনক’ হয়ে উঠছে ঢাকার বায়ু
ঢাকা শহরের পিছু ছাড়ছে না উচ্চ মাত্রার বায়ুদূষণ। পিছু ছাড়ছে না দুশ্চিন্তাও। ২৫ শতাংশ হার্ট অ্যাটাকের কারণ দূষিত বায়ু বলে উঠে এসেছে গবেষণায়। সবমিলিয়ে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে উচ্চ আদালতকেও। তবু দূষণ কমেনি ঢাকার বায়ুর। গতকালও বিশ্বের দূষিত বায়ুর তালিকায় ঢাকা ছিল শীর্ষে। আর গত ২৬ জানুয়ারি সব রেকর্ড ভেঙে বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছায় ঢাকার বায়ুমান। এ অবস্থায় ঢাকার দূষিত বায়ু নিয়ে উদ্বেগের অন্ত নেই। যদিও ২০২০ সালে বায়ুদূষণ রোধে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। তবে তার ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়ন হয়নি। সম্প্রতি বায়ুদূষণের ফলে দিল্লিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হয়। ঢাকা যেন সেই পথে না যায়, এ কারণেই নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকারও।
সুইজারল্যান্ডের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষক সংস্থা একিউএয়ারের তথ্য বলছে, জানুয়ারি মাসে একদিনের জন্যও ঢাকার বায়ুর অস্বাস্থ্যকর অবস্থার উন্নতি হয়নি। বায়ুমান ছিল চরম অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে। এমনকি গতকালও ঢাকার বায়ু ছিল বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত। গত জানুয়ারি মাসেও একাধিকবার ঢাকার বায়ুদূষণের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষে অবস্থান করছিল। এই দূষিত বায়ুতে বিষাক্ত প্লাস্টিকের কণা পেয়েছেন গবেষকরা, যাকে অত্যন্ত দুশ্চিন্তার মনে করছেন স্বাস্থ্যবিদরা।
একিউএয়ারের তথ্য বলছে, গত ৫ জানুয়ারি ঢাকার বায়ুমান ১৫৭ একিউআই সূচকে পৌঁছালেও ১৮ থেকে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা ৬ দিন এই মান ছিল ২০০-এর কাছাকাছি। এর মধ্যে ২২ জানুয়ারি সর্বোচ্চ ২৭৯-তে পৌঁছায়। এরপর ২৪ জানুয়ারি বৃষ্টি শুরু হলে ঢাকার একিউআই-ও কিছুটা কমে আসে। তারপরও এই বায়ুমাণ ১৭০-এর নিচে নামেনি। অর্থাৎ বৃষ্টি সত্ত্বেও ঢাকার বায়ুমান একদিনের জন্যও স্বাস্থ্যকর অবস্থায় ফিরে আসেনি।
উল্লেখ্য, বায়ুমানের ক্ষেত্রে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্ক তথা একিউআইয়ের মান ৫০ পর্যন্ত হলে তাকে স্বাস্থ্যকর বায়ু বলা হয়। ৫১ থেকে ১০০ পর্যন্ত থাকলে তা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের ধরা হয় যদিও ব্যক্তি বিশেষে তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত মাত্রাকে বলা হয় অরেঞ্জ লেভেল যা সাধারণ মানুষের জন্য খুব একটা ক্ষতিকর না হলেও কারো কারো স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। ১৫০ থেকে ২০০ পর্যন্ত থাকলে তা অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর এই মান ২০০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত চরম অস্বাস্থ্যকর। আর একিউআই ৩০০ এর বেশি হলে সেটিকে বিপর্যয়কর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঢাকার বায়ুর মান জানুয়ারি মাসে কোনোদিনই ১৫০-এর নিচে নামেনি। অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর বায়ু পায়নি রাজধানী শহরের বাসিন্দারা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং বায়ুমান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘মূলত তিনটি কারণে জানুয়ারি মাসে ঢাকার বায়ুমান খুব খারাপ অবস্থায় ছিল। প্রথমত, গত ডিসেম্বরে মেট্রোরেলের উদ্বোধনের কারণে নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল। ফলে গত ৭ বছরের মধ্যে ডিসেম্বরে বায়ুমান সবচেয়ে ভালো ছিল। খোঁড়াখুঁড়ির কাজও ওই সময় বন্ধ ছিল। জানুয়ারির শুরুতে এগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়। ফলে ১০০টি জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছে। দ্বিতীয়ত, শুষ্ক মৌসুম শুরু হলে বায়ুদূষণ বাড়ে। জানুয়ারির শুরু থেকে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়। এতে প্রতিবেশী দেশ থেকে দূষিত বাতাস এসেছে। পাশাপাশি খোঁড়াখুঁড়ির কারণে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেটাও নেওয়া হয়নি। তৃতীয় কারণ হচ্ছে, জানুয়ারিতে বাতাসের গতিবেগ ছিল ১২ কিলোমিটার। ফলে দূষিত বায়ু নিম্নস্তর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে নগরবাসীকে মাসজুড়েই দূষিত বায়ু গ্রহণ করতে হয়েছে।’
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান) জিয়াউল হক বলেন, পরিস্থিতি উদ্বেগজনক জায়গায় পৌঁছার কারণে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এই কমিটির বৈঠক হয়েছে। বায়ুদূষণ রোধে মোবাইল কোর্টের অভিযান চালানো হয়েছে। আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আদালতের অসন্তোষ, ৯ দফা বাস্তবায়নের নির্দেশ
বায়ুদূষণ রোধে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন না করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। বলেছেন, ‘দূষণের মাধ্যমে মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে। বায়ুদূষণের হাত থেকে মানুষকে বাঁচান।’ গতকাল বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে এ মন্তব্য করেন।
আদালত বলেন, উচ্চ আদালত বায়ুদূষণ রোধে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তার ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়ন হয়নি। অবৈধ ইটভাটাও বন্ধ করা হয়নি। দূষণের মাধ্যমে মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে। অনেকে বিদেশে থাকেন, তাদের ছেলেমেয়েরাও বিদেশে থাকে। ঢাকার বায়ুদূষণে তাদের কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমরা তো এ দেশেই থাকি। এ দেশেই থাকতে হবে। বায়ুদূষণের হাত থেকে মানুষকে বাঁচান। আদালত পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা যদি বাস্তবায়ন না করা হয়, পানি ছিটানো না হয় তাহলে আমরা প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তলব করে ব্যাখ্যা চাইব। পরে আদালত দুই সপ্তাহের মধ্যে বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়ন করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, পুলিশের আইজি, রাজউককে এই আদেশ বাস্তবায়ন করে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি এই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আমাতুল করীম। এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানাতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
ঢাকার বায়ু দূষণ রোধে উচ্চ আদালতের যে ৯ দফা নির্দেশনা রয়েছে তা বাস্তবায়নের নির্দেশনা চেয়ে গত ৩০ জানুয়ারি হাইকোর্টে আবেদন করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। এর আগে ২০২০ সালে বায়ু দূষণ রোধে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত।
ওই নয় দফা নির্দেশনায় বলা হয়- ঢাকা শহরের মধ্যে বালি বা মাটি বহনকারী ট্রাকগুলোকে ঢেকে পরিবহন করতে হবে। যেসব জায়গায় নির্মাণকাজ চলছে সেসব জায়গার কন্ট্রাক্টররা তা ঢেকে রাখবেন। ঢাকার সড়কগুলোতে পানি ছিটানোর নির্দেশ ছিল, এখনো পানি ছিটানো হচ্ছে না, সব সড়কে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সড়কের মেগা প্রজেক্টের নির্মাণ কাজ এবং কার্পেটিংসহ যেসব কাজ চলছে, সেসব কাজ যেন আইন কানুন এবং চুক্তির টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন মেনে করা হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যেসব গাড়ি কালো ধোঁয়া ছাড়ে সেগুলো জব্দ করতে হবে। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ির ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ করতে হবে এবং যেসব গাড়ি পুরাতন হয়ে গেছে সেগুলো চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। যেসব ইটভাটা লাইসেন্সবিহীন চলছে, এর মধ্যে যেগুলো এখনো বন্ধ করা হয়নি, সেগুলো বন্ধ করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া টায়ার পোড়ানো এবং ব্যাটারি রিসাইক্লিং বন্ধ করতে হবে। মার্কেট এবং দোকানের বর্জ্য প্যাকেট করে রাখতে হবে। এরপর মার্কেট ও দোকান বন্ধ হলে সিটি কর্পোরেশনকে ওই বর্জ্য অপসারণ করতে হবে।
এর আগে, গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এডিপির এক সভায় পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিশেষ অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন।
নতুন বিপদ
এত দিন বাতাসে অতি ভারী ধাতুর উপস্থিতি শঙ্কা বাড়িয়েছিল। তবে এবার ঢাকার বাতাসে বিষাক্ত অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা বা মাইক্রো প্লাস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ঢাকাবাসীর নিশ্বাসের সঙ্গে ওই কণা শরীরে প্রবেশ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয় এবং টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম।
দূষিত বায়ু ও প্লাস্টিক কণা কী ধরনের ক্ষতি করছে- সে বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘দূষিত বায়ু বা প্লাস্টিক কণা নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করলে প্রথমে ফুসফুস এবং পরে রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে ক্যানসার থেকে শুরু করে স্নায়ুজনিত নানা রোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং শ্বাসজনিত অনেক সমস্যা তৈরি করতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, হার্ট অ্যাটাকের ২৫ শতাংশ হচ্ছে দূষিত বায়ুর কারণে। শুধু তাই নয়, ঢাকার মানুষের রোগব্যধিও বাড়ছে এটার ফলে।’
(ঢাকাটাইমস/০৬ফেব্রুয়ারি/আরআর/আরকেএইচ)