ড. ইউনূস ও বিতর্ক

মো. সাখাওয়াত হোসেন
 | প্রকাশিত : ১৩ মার্চ ২০২৩, ১৫:৩৯

শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের আচরণের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন ৪০ বিশ্বনেতা। এ বিষয়ে তাঁরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলাচিঠি দিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী রাজনীতি, কূটনীতি, ব্যবসা, শিল্পকলা ও শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রাখা ৪০ বিশ্বনেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এই খোলাচিঠি দিয়েছেন। চিঠিটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় পূর্ণ পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন হিসেবেও প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্লেষকগণ বিভিন্নভাবে মতামত তুলে ধরেছেন, যার মধ্যে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন অনেকেই। কেননা আমরা সচরাচর কোন বিষয়ে বিবৃতি বা খোলাচিঠির বিষয়ে অবগত হলে দেখা যায়, চিঠির সারমর্ম পত্রিকায় প্রকাশ করে স্বাক্ষরকৃতদের নাম প্রকাশ করা হয় তাও ভেতরের পৃষ্ঠার দিকে। কিন্তু ওয়াশিংটন পোষ্টে যেভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে পূর্ণ পাতা দখল করে খোলা চিঠির বিষয়ে বিশ্ব জনতাকে অবগত করার চেষ্টা করা হয়েছে সে ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, দাপ্তরিক রীতি ব্যবহার করা উচিত ছিল বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কিন্তু ব্যাপারটিকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে বিব্রত করার একটি অপচেষ্টাও এতে লক্ষ্য করা যায়। আবার অনেকেই এহেন যুদ্ধময় পরিস্থিতিতে ড. ইউনুসকে সামনে নিয়ে আসার ব্যাপারটিকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমরা বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে আপনাকে লিখছি, যাঁরা আপনার দেশের জনগণের সাহস ও উদ্ভাবনী দক্ষতার প্রশংসা করে।-- আপনার দেশের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থেকেই আমরা আপনাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের একজন, শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মহান অবদানকে সমর্থন ও স্বীকৃতি দিতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে আপনাকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখছি। ড. ইউনূসের ভালো থাকা, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে মানবিক উন্নয়নে তিনি যে অবদান রেখে চলছেন, তা অব্যাহত রাখতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে আমাদের গভীর উদ্বেগ রয়েছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়- মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ টেলিকম বা গ্রামীণফোন থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হননি। বরং তিনি যেসব সংগঠন গড়ে তুলেছেন, সেগুলোর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তিনি বারবার হয়রানি ও তদন্তের মধ্যে পড়ছে। এমনটা দেখতে পাওয়া বেদনাদায়ক। এখানে উল্লেখ্য যে, আদালতের নির্দেশে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো দুদকে তদন্তাধীন। এখানে সরকারের কি করার আছে-দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এ সংক্রান্তে সরকারের উপর দায় চাপানোর কিছু নেই। কারণ আইন রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্যই সমান গতিতে চলে। চিঠিতে আরও লেখা হয়, আমরা আশা করি, টেকসই অগ্রগতি নিশ্চিতে কীভাবে একটি প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজকে লালন করা যেতে পারে, সে বিষয়ে অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি মডেল হিসেবে বাংলাদেশ তার ভূমিকায় ফিরে আসবে। এ ক্ষেত্রে প্রথম একটি ভালো উদ্যোগ হওয়া উচিত, অধ্যাপক ইউনূসের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া। তাঁকে নিজ নিরাপত্তায় ব্যস্ত রাখার পরিবর্তে দেশ ও বিশ্বের জন্য আরও ভালো কিছু করতে তাঁর শক্তিকে কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেওয়া। আমরা ও বিশ্বের কোটি মানুষ আশা করি, আপনি আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবেন।

বিশ্ব নেতাদের এই উদ্বেগকে সাধুবাদ না জানানোর কোন উপায় নেই, কেননা তারা মনে করছেন ড. ইউনূস কোন না কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তথা সরকারের রোষানলের মধ্যে রয়েছেন। প্রকৃতঅর্থে কি রোষানলে সেটি দেখতে হবে? কারণ মামলাগুলো দুদকের মাধ্যমে তদন্তাধীন। পাশাপাশি এ ব্যাপারটিও চিন্তা করতে হবে আমাদের, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে এখনো যারা মদদ দিয়ে যাচ্ছেন বা বিভিন্নভাবে সহায়তা করে চলছেন তাদের বিরুদ্ধে তাদের মনোকষ্টের বালাই দেখা যাচ্ছে না। তাদের মনোকষ্ট হচ্ছে না, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পুরো বিশ্বকে সংকটের মধ্যে নিপতিত করেছে। দু:খের বিষয় হচ্ছে ড. ইউনূসের পক্ষে যারা বিবৃতি দিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকের দেশের রাষ্ট্রনেতারা এ যুদ্ধকে জিইয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য সহযোগিতার দ্বার অবারিত রেখেছেন। সে বিষয়ে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই, অথচ ড. ইউনুসের পক্ষে তারা বিবৃতি দিয়েছেন। শুধু বিবৃতিই নয়, ওয়াশিংটন পোস্টের মত পত্রিকায় পুরো পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। দল-মত নির্বিশেষে পুরো বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে চিন্তিত, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করার জন্য বিশ্ববাসীর নিকট আবেদন জানিয়েছে, সে বিষয়ে ৪০ জন বিশ্বনেতার প্রোঅ্যাকটিভ ভূমিকা নেই। সে কারণেই বাংলাদেশীরা মনে করে, ড. ইউনূসকে নিয়ে বিশ্ব নেতাদের বিবৃতি দূরভিসন্ধিমূলক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ করার চরিতার্থ।

কেননা আপনি যখন কথা বলবেন, আপনার অভিব্যক্তি প্রকাশ করবেন, সেটি কেবলমাত্র ব্যক্তিবিশেষের জন্য হলে মানুষ আপনাকে সাদরে গ্রহণ করবে না। হঠাৎ করে কি এমন সমস্যা হল, ড. ইউনূসকে নিয়ে বিবৃতি প্রদান করতে হবে। খোলা চোখে যদি আপনারা দেখেন, তাহলে বাংলাদেশের সংকটকালিন সময়ে ড. ইউনূসের ভূমিকাকে আপনাকে মূল্যায়ন করতে হবে। করোনা মহামারী অতিক্রম করল পুরো বিশ্ব, মহামারী পরবর্তী সময়ে সংকট মোকাবেলা করেছে বাংলাদেশ, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, সেখানে দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে ড. ইউনূসের ভূমিকাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? তিনি কোথাও কি প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছেন? এসব বিষয়গুলো কিন্তু মূল্যায়নে নিয়ে আসতে হবে। ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন, এটা নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশীদের জন্য গর্বের, গৌরবের। সত্যিকারঅর্থে নোবেল পাওয়ার পরবর্তী সময়ে অন্যান্য দেশের ব্যক্তিত্বরা দেশের কল্যাণার্থে যেভাবে কাজ করেন, তিনি কি আদৌ সে ধরনের অনুশীলন করছেন বাংলাদেশে? নির্বাচন ঘনিয়ে এলে তিনি বিশেষ একটি পক্ষ অবলম্বন করে বিবৃতি দিয়ে গণমাধ্যমে মতামত জানানোর চেষ্টা করেন। ১/১১ এর সময়ে তাঁর তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে, কিন্তু বাংলার মানুষ কি সেসব গ্রহণ করেছে? কখনোই গ্রহণ করেনি এবং ১/১১ এর সময়ে ড. ইউনূসের আহবানকে জনগণ প্রত্যাখান করেছে।

গ্রামীণ ব্যাংক আদতে কিভাবে কাজ করে, গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতারা কতটুকু উপকৃত হয়েছে কিংবা বঞ্চিত হয়েছে সে ব্যাপারে প্রকৃত অর্থ উদঘাটন করা জরুরী। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রদেয় ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়েছে, ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছে। সে বিষয়েও তথ্য বের করে নিয়ে আসা জরুরী, ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে গ্রহীতার সুবিধা অসুবিধা কতটুকু বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে এসব তথ্যও উদঘাটন করতে হবে। তাহলেই বোঝা যাবে, গ্রামীণ ব্যাংক প্রকৃতঅর্থে সাধারণ জনগণের উপকারে আসে, না অপকারে ব্যবহৃত হচ্ছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাক্কালে ড. ইউনূসের ভূমিকা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে এবং সরকার প্রধান মহান সংসদে পদ্মা সেতু ষড়যন্ত্রে যাদের নাম বলেছেন তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। কাজেই নতুন করে নির্বাচনকে সামনে রেখে ড. ইউনূসকে সামনে নিয়ে আসার হেতু বিশ্ব নেতারাই বলতে পারবেন। তবে বাংলাদেশের জনগণের কাছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিবেচনায় এ ব্যক্তিত্বের অর্থহীন গুরুত্ব রয়েছে এবং অতীতেও সেসব বাংলার জনগণ প্রমাণ করেছে।

বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের পক্ষ হতে বিশ্ব নেতৃত্বের প্রতি উদাত্ত আহবান থাকবে, বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলায় আপনারা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিবেন। কারও প্রতি অনুরাগের বশবর্তী হয়ে বিবেক বিসর্জন দিয়ে নিজেদের মর্যাদাকে খাটো করবেন না। আর যাদের পক্ষে আপনারা দাঁড়াবেন নিশ্চিত করে নিবেন, প্রকৃতঅর্থে ঘটনার আদ্যোপান্ত কি; সম্পূর্ণ ঘটনার বিষয়বস্তু জেনে বুঝেই মতামত প্রদান করা শ্রেয়। সরকার কারোর উপর বিনা কারণে অযাথিত হস্তক্ষেপ করে না, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিও অন্য সময়ের তুলনায় উন্নতির দিকে-বিষয়টি অনেক সংস্থা নিশ্চিত করেছে। ইত্যবসরে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসকে নিয়ে যতগুলো মামলা মোকদ্দমা হয়েছে আদালতের মাধ্যমে সেগুলো নিষ্পত্তির ব্যবস্থা হয়েছে, সেসব জায়গায় সরকার কোনভাবে হস্তক্ষেপ করেনি। আর তদন্তাধীন বিষয়ে বিদেশী বন্ধুদের এভাবে নাক গলানো রাষ্ট্রের আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণের শামিল এককথায় দৃষ্টতার শামিল। এভাবে একটি সরকারের ‍উপর দায় চাপিয়ে দেওয়ার অপসংস্কৃতি থেকে বিশ্ব নেতৃত্ব সরে আসবে বলেই আমরা বিশ্বাস রাখি। বৈশ্বিক সমতা রক্ষা করা, শান্তির পৃথিবী আনয়ন করার মর্মে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রত্যেককেই কাজ করতে হবে, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দেশপ্রেমিক সকল বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :