কর্মীকে মেরে হাসপাতালে পাঠালেন জাবি ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতারা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) মীর মশাররফ হোসেন হলে মঙ্গলবার রাতে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির অনুসারীদের 'গেস্টরুম' চলাকালে চড় মেরে এক শিক্ষার্থীর কান ফাটিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হাসান মাহমুদ ফরিদ পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি।
এসময় ওই হলের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন এবং 'সাংবাদিকরা খবর পেয়ে যেতে পারে' বলে ভুক্তভোগীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যেতে বাধা দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, ভুক্তভোগী সজীবের কানে মারতে গেলে সে হাত দিয়ে ঢেকে দেয়ায় তার হাত সরিয়ে ফের কানেই আঘাত করে অভিযুক্ত ফরিদ। অসুস্থতা বোধ করলে ভুক্তভোগী মাটিতে শুয়ে পড়ে এবং ডাক্তারের কাছে যেতে চাইলে তারা বাধা প্রদান করে। এসময় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মোস্তাফিজ লাথি মারার চেষ্টা করে এবং 'নাটক করতেছে' বলে উল্লেখ করে। এসময় ভুক্তভোগী কেঁদে কেঁদে অনুরোধ করে, ভাই, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আর রাজনীতি করব না। বাসায় চলে যাব। এরপরে গেস্টরুমে উপস্থিত শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরান (ইতিহাস-৪৪) বলেন, ‘ও নাটক করতেছে। ওরে তোল। আজকে এই গেস্টরুম থেকে ওর লাশ বের হবে’- বলে জানা গেছে। সজীবকে ধরে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য বের হলে ইমরান তাদের বাধা দিয়ে বলেন, ‘আগে দেখ ও নাটক করতেছে কিনা। ২০-৩০ মিনিট অবজার্ভ কর। তারপরে মেডিকেলে নিয়ে যা। আর এখন মেডিকেলে নিয়ে গেলে নিউজ হবে। তখন আমরা বিষয়টা হ্যান্ডেল করতে পারব না।’
অবস্থা খারাপ হওয়ায় ভুক্তভোগী নিজ উদ্যোগে বন্ধুদের এবং ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সাহায্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে যায়। সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে তৎক্ষণাৎ এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।
এ ব্যাপারে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার মামুন জানান, রাত সাড়ে ১২টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ইমার্জেন্সি বিভাগে এসেছিল। কানে সমস্যা থাকায় ইমার্জেন্সি ডাক্তার তাকে তিন তলায় ওটিতে (অপারেশন থিয়েটার) পাঠিয়েছিল। সেখানে ইএনটির (নাক-কান-গলা) ডাক্তার তাকে দেখেছেন। পরবর্তীতে সেখানে ট্রিটমেন্ট নিয়ে তিনি হাসপাতাল থেকে চলে গেছেন।
নাক-কান-গলা বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক শুভ জানিয়েছেন, আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর ট্রিটমেন্ট করেছি। ভুক্তভোগী আমাকে যে হিস্ট্রি দিয়েছে সেটি হল, সে কোন বড়ভাই দ্বারা ফিজিক্যাল এসল্টের শিকার হয়েছে। এসল্টের ফলে তার ডান কানে ব্লান্ট ট্রমার সৃষ্টি হয়েছে। সে দাবি করেছে তাকে থাপ্পড় দেয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর কানসহ গালের মাংসপেশিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, তার অনেক ব্যথা হচ্ছিল। পরীক্ষা করে দেখা গেছে কানের পর্দা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাকে চিকিৎসা প্রদান করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পরেনি। পরবর্তীতে যদি তার অবস্থা খারাপ হয়, প্রয়োজন হলে তাকে ভর্তি করানো লাগতে পারে।
কানের পর্দা ফেটেছে কি না সেসম্পর্কে তিনি জানান, এটা আসলে ক্লিয়ার না। সেভাবে পর্দা ফাটেনি, তবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটাও ফাটার মতই, আরেকটু জোরে প্রহার করলে তার কানের পর্দা ফেটে যেত।
তিনি আরও জানান, ভুক্তভোগীর কানে কোনপ্রকার খোঁচাখুঁচি করা যাবে না। ওই কান সর্বদা রেস্টে রাখতে হবে। তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ ঠিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কমপক্ষে দেড় থেকে তিন মাস পর্যন্ত এসব মেনে চলতে হবে।
অভিযুক্ত ইমরান গেস্টরুমের ব্যাপারে বলেন, রোজার আগে এটি আমাদের রুটিন গেস্টরুম ছিল। নির্দিষ্ট করা ছিল না, আজকে আমাদের হয়েছে কাল হয়তোবা অন্যদের হবে। রোজায় সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য এ গেস্টরুম।
অভিযোগের ব্যাপারে বলেন, ভুক্তভোগীর সারাদিন ক্লাস-এসাইনমেন্ট থাকার ফলে গেস্টরুমে এসে শারীরিক দুর্বলতাজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি জাবি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি, আমি যদি আটকায় রাখি ও তাহলে কিভাবে মেডিকেলে গেল? এগুলা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বলা হচ্ছে।
অপর অভিযুক্ত ফরিদ (পরিবেশ বিজ্ঞান ৪৪) এ ব্যাপারটি প্রাথমিকভাবে অস্বীকার করে বলেন, এরকম কিছু আজকের গেস্টরুমে ঘটেনি। কেউ আহত হয়নি। এ তথ্য আমি জানি না।
তবে পরবর্তীতে তিনি সজীবের অসুস্থ হয়ে পড়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, অসুস্থ হয়ে পড়ছে তাতে আমি কি করব? আমি কিছুই জানি না, দশ-বারোজন সাক্ষী দিলেই হবে নাকি? ওদের বক্তব্য ওরা দিছে, আমার কথা আমি বলছি।
শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, আমি জানতে পেরেছি রমজান মাসে কি সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা থাকবে সেটা নিয়ে হলের সকলে বসেছিল। এর মধ্যে সে অসুস্থ হয়ে পরে। আমাকে তারা এটা জানিয়েছে।
হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে তার কানের গুরুতর জখম এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের সামঞ্জস্যতার কথা জানালে তিনি বলেন, তদন্ত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
এ বিষয়ে মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক এম ওবায়দুর রহমান বলেন, আমি ইতোমধ্যেই ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলেছি। সে এখনো আমাদের কাছে লিখিতভাবে কিছু দেয়নি। সন্ধ্যায় আমরা হল প্রশাসন মিটিং ডেকেছি। এরপর আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।
(ঢাকাটাইমস/২২মার্চ/এলএ)

মন্তব্য করুন