কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান যেভাবে নিয়ন্ত্রণে নেন ‘ঋণের জামিনদার’ জাহাঙ্গীর আলম

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৩ মে ২০২৩, ১৮:১৩ | প্রকাশিত : ০৩ মে ২০২৩, ১৭:৫৯

গাজীপুরে নিউ টাউন সিটি ওয়্যার নামের যে কোরিয়ান কোম্পানির শতকোটি টাকা ঋণ খেলাপে জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে, সেই পোশাক কারখানাটি চার বছরের বেশি সময় ধরে নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন সাবেক এই মেয়র।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর গার্মেন্টসটির পুরো কৃর্তত্ব নিজের হাতে নেন জাহাঙ্গীর। একপর্যায়ে তিনি গার্মেন্টসটির পরিচালক পদেও বসেন।

আসন্ন গাজীপুর সিটি নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মেয়র পদে লড়তে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন আগের দফায় বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর। তবে ঋণখেলাপি হওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়।

মূলত এরপরই আলোচনায় উঠে আসে কোরিয়ার একটি কোম্পানির মালিকানাধীন নিউ টাউন নিটওয়্যার কোম্পানি নামের গার্মেন্টসটি। একসময় এখানকার ঝুট ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করা জাহাঙ্গীর প্রথম দফায় মেয়র হওয়ার পরপরই সেটি নিয়ন্ত্রণে নেন।

২০২১ সালে গার্মেন্টসটিতে চার মাসের বেতন বকেয়া হলে শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হয়। এরপর জাহাঙ্গীর শ্রমিকদের বাসায় ডেকে এক মাসের বেতন দিয়ে চার মাসের বেতন ‘বুঝে পেয়েছি’ লেখা একটি ফরমে সই নিয়ে আইডি কার্ড রেখে বিদায় করে দেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি ও মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দলের সদস্যপদ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগ। এরপর ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে বন্ধ করে দেওয়া হয় গার্মেন্টসটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কাগজে কলমে অনেকের নাম থাকলেও কার্যত জাহাঙ্গীরের ইশারায় চলছিল প্রতিষ্ঠানটি। ব্যাংকের ঋণ পেতে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বন্ধ করে কষা হয় শ্রমিক অসন্তোষের ছক।

একপর্যায়ে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের নামে অগ্রণী ব্যাংক থেকে প্রতিষ্ঠানটির নামে নেওয়া হয় ১০০ কোটি টাকা ঋণ। সেই ঋণের টাকা জাহাঙ্গীরের কব্জায় চলে যায় বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

গাজীপুরের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নিউ টাউন সিটি ওয়্যার নামের কোম্পানিটি অগ্রণী ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকার যে ঋণ নিয়েছিল, সেখানে গ্যারান্টার বা জামিনদার জাহাঙ্গীর আলম।

নির্বাচন উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) সেই ঋণের তথ্য দেয়। সেখানে খেলাপি ঋণ দেখানো হয়। এরপর সেই তথ্যের ভিত্তিতে মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।

গত বছর গার্মেন্টসটি বন্ধ হওয়ার পর গার্মেন্টসটির পরিচালক পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে গার্মেন্টসটি পুনরায় চালুর বিষয়ে সহযোগিতা চান।

এসময় তাদের বর্ননায় উঠে আসে অগ্রণী ব্যাংক থেকে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধের নামে ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে জাহাঙ্গীরের লুটপাটের চিত্র। একই সঙ্গে ফাঁস হয় জাহাঙ্গীরের দাপটের কাছে এনটিকেসি গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষের অসহায়ত্ব।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গাজীপুর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ‘প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জাহাঙ্গীর প্রসঙ্গে আলী বাবা চল্লিশ চোরের কাহিনী বলেছিলেন। ২৬ বছর আগে সুনাম নিয়ে যাত্রা করা এই গার্মেন্টসটির এমন করুণ পরিনতির পেছনে জাহাঙ্গীরের দায় রয়েছে বলে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের কথাবার্তায় স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে।’

এদিকে ৪-৫ মাসের বকেয়া বেতন না পেয়ে নীরবে অন্য কারখানায় গিয়ে কাজ নেওয়া কয়েকজন শ্রমিক বলেন, ‘কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার পরও জাহাঙ্গীরের লোকজনের ভয়ে শ্রমিকরা পাওনা আদায়ে আন্দোলনে নামতে পারেনি। টাকা চাইতে গেলে জাহাঙ্গীরের লোকজন নাজেহাল করত। মারধর করত, ভয় দেখাত।’

তবে এসব বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আর এ বিষয়ে ইমেইল পাঠিয়েও কোরিয়ান ওই গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষের সাড়া মেলেনি। এমনকি গার্মেন্টসটির ল্যান্ডফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি।

এলাকাবাসী, আশপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও সাবেক কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে বিশাল ভবনে যাত্রা শুরু হয় এনটিকেসির।

শুরু থেকেই সুনামে থাকা এই প্রতিষ্ঠানের ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন জাহাঙ্গীর। পরে প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যার সুযোগ নিয়ে শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে আবার তাদের বেতন ঠকিয়ে ২০১৮ সালে সেটি নিজের কব্জায় নেন জাহাঙ্গীর। ২০২১ সালে আংশিক এবং গত বছরের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় পোশাক কারখানাটি।

আগে ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, কিন্তু এখন আশপাশের কারখানায় চাকরিরত একাধিক শ্রমিক বলেন, কারাখানায় শ্রমিক অসন্তোষের সময় জাহাঙ্গীর আলম এসে নিয়ন্ত্রণ করেন। পরে তার বাসায় ডেকে নামমাত্র টাকা দিয়ে শ্রমিকদের সব বেতন পরিশোধ হয়েছে লেখা কাগজে সই নেওয়া হয়।

রওশন আরা নামে এক শ্রমিক জানান, তিনি এনটিকেসির সুইং সেকশনে কাজ করতেন। তার মতো আরও অনেক শ্রমিকের বেতন বকেয়া রয়েছে। কিন্তু গার্মেন্টেসের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলম আছেন, তাই তারা ভয়ে কিছু বলেন না। কারণ জাহাঙ্গীর আলমের লোকজন মারধর করবে, বিপদ হবে।

তিনি বলেন, ‘এ কারখানায় জাহাঙ্গীর আলম প্রথমে ঝুটের ব্যবসা করতেন। পরে তিনি মালিকের সঙ্গে মিলে তাদের বঞ্চিত করেন।’

গার্মেন্টসটির সাবেক এক কর্মকর্তা ঢাকা টাইমসকে বলেন, শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলে জাহাঙ্গীর এই কোম্পানি চালানোর দায়িত্ব নেন।

আশপাশের একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এনটিকেসিতে শ্রমিক অসন্তোষ চলার সময় জাহাঙ্গীর আলম ওই প্রতিষ্ঠানের একজন পরিচালক বলে তারা শুনেছেন।

(ঢাকাটাইমস/০৩মে/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :