জাহাঙ্গীরনগরে অতীত হওয়ার পথে অতিথি পাখি

যৌথ প্রতিবেদন
| আপডেট : ২৮ মে ২০২৩, ১৫:১৯ | প্রকাশিত : ২৮ মে ২০২৩, ১৪:৪৫

হেমন্তের পরে আসে শীত। আর তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে নতুন অতিথি। শীতপ্রধান বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসে অতিথি পাখিরা। নিরাপদ বাসস্থানের খোঁজে আসা এই পাখিদের কলতানে মুখরিত হয় ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যের সঙ্গে পাখিদের কোলাহলমুখর প্রকৃতির এ মুগ্ধ রূপ পর্যবেক্ষণ করতে বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসে নিসর্গপ্রেমী মানুষের দল।

তবে গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির। বিভিন্ন কারণে জাবিতে উদ্বেগজনকভাবে কমছে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা। এর কারণ হিসেবে অপরিকল্পিত নগরায়ন, সময়মতো লেক সংস্কার না করা, কনসার্ট ও আতশবাজির শব্দ, গাছ কাটা, লেক লিজ দেওয়া, বহিরাগতদের উৎপাতসহ নানা অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন পাখি গবেষকরা।

এ ব্যাপারে কথা হয় পাখি গবেষক ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসানের সঙ্গে। তিনি জানান, ২০২০ সালে অতিথি পাখি আসে ৮ হাজার ১২০-এর মতো, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর কারণ, করোনার কারণে তখন ক্যাম্পাস বন্ধ ছিল এবং কোনো কোলাহল ছিল না। আবার গত বছর পাখির পরিমাণ কম ছিল।

ড. কামরুল হাসান বলেন, ‘সাধারণত আমাদের ক্যাম্পাসে চৌরঙ্গীর পাশের লেক, পুরাতন রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের সামনের লেক, বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশের বড় লেক আর ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের পাশের লেকে পাখিদের দেখা যায়। তারা এমন জায়গায় বসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে যেখানে কোলাহল কম থাকে।’

‘তবে ট্রান্সপোর্ট ও চৌরঙ্গীতে মানুষের বেশি আনাগোনা থাকায় পাখিগুলো একদম কর্নারে চলে যায়। আবার কোনো সময় তারা উড়ে চলে যায় ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের পাশের লেকে। এক সময় বোটানিক্যাল গার্ডেনের লেকটায় অনেক পাখি বসতো। গত ২-৩ বছর ধরে এই লেকটি সংস্কার করা হচ্ছে না বলে সেখানেও তেমন পাখি আসে না। পুরো লেকটি এখন কচুরিপানা দিয়ে ভরে গেছে।’

অতিথি পাখি কম আসার কারণ হিসেবে জাবির এস্টেট শাখার প্রধান আব্দুর রহমান বাবুল বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন, ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের উৎপাত, কাঁটাতারের বেড়ার ভিতরে প্রবেশ, গাড়ির হর্ন, কনসার্ট ও আতশবাজির শব্দ, কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি কারণে পাখি বেশিদিন থাকতে পারছে না এবং আসছেও কম।’

‘করোনার সময় ক্যাম্পাসে মানুষজন কম ও পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকায় অনেক পাখি এসেছিল। পাখিবান্ধব পরিবেশ গড়তে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সচেতনতামূলক ব্যানার, পোস্টার, বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে।’

পাখির বিচরণ, আবাসস্থলের নিশ্চয়তা, সংরক্ষণ ও লেক সংস্কারের বিষয়ে প্রশাসনের ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুর রহমান বলেন, ‘ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ বাজেটে অতিথি পাখি ও লেক নিয়ে আলাদা কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয় না। ক্যাম্পাস উন্নয়ন খাতের মধ্যেই এই খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়।’

জাবির এস্টেট শাখার প্রধান জানান, প্রতি বছর বর্ষাকালে পলি মাটি, আবর্জনা ও অন্যান্য কারণে লেকগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ২০১২-১৩ সালে উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেনের সময়ে কাবিখার অন্তর্ভুক্ত একটি বরাদ্দ থেকে লেক সংস্কারের জন্য প্রায় ২ দশমিক ৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়।

‘তখন লেক সংস্কার করা হলেও পরে টাকার অভাবে আর সংস্কার করা হয়নি। পরবর্তীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে জাবি প্রশাসনিক অফিস থেকে অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হলেও তা আর পাওয়া যায়নি’—যোগ করেন তিনি।

জাবির এস্টেট শাখার প্রধান আরও বলেন, ‘প্রতি বছর অক্টোবর মাসে লেকগুলো পরিষ্কার করতে হয়। এজন্য বাহির থেকে ঘণ্টা বা দিন হিসেবে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নেওয়া হয়। গত বছর অর্থের অভাবে লেকগুলো সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার করা হয়নি।’

তিনি আরও জানান, ক্যাম্পাসে নিয়োগকৃত মালি বা পরিচ্ছন্নকর্মীরা লেক পরিষ্কার ও সংস্করণ কাজ করেন না।

ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটা লেক অর্থের বিনিময়ে লিজ দেওয়া হয়েছে যেটা উন্মুক্তভাবে পাখি বিচরণ, খাদ্য সংগ্রহ ইত্যাদিতে বাধা সৃষ্টি করেছে।

এ বিষয়ে আব্দুর রহমান বাবুল জানান, যে লেকগুলোতে পাখি বিচরণ করে না সেগুলোই লিজ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ক্যাম্পাসের পাখি গবেষকদের পরামর্শ ও অনুমতি নেওয়া হয়েছে।

তবে ক্যাম্পাসের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান বলেন, ‘লেক লিজের ব্যাপারে আমাদের কিছু জানায়নি বা পরামর্শও নেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে তারাই ঠিক করে দেয় কোন লেকটি লিজ দেওয়া হবে, কোনটি দেওয়া হবে না।’

‘দুঃখের বিষয় হলো, গত ১৫-২০ বছর ধরে এই কমিটিতে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের কাউকে রাখা হয়নি। লিজকৃত লেকগুলোতে পাখি বিচরণে বাধা দিচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করছে। এতে ক্যাম্পাসে অতিথি পাখি হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। কিছু লেক লিজ নিয়ে থাকলে দেখা যায় মাছের খাবারের কারণে অনেক বেশি পরিষ্কার করে ফেলে তখন পাখিদের প্রাকৃতিক খাবার আর থাকে না।’

অন্যদিকে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান সুদীপ্ত শাহীন বলেন, ‘লিজ দেওয়ার ফলে যারা লিজ নেয় তারা ব্যবসার সুবিধার্থে পানিতে অনেক বিষ, কীটনাশক, কেমিক্যাল মিশিয়ে থাকে। যা পানিতে থাকা পাখি বা কীট পতঙ্গের জন্য ক্ষতিকারক। তবে আমরা এখানে কোনো পাখি মারা যাওয়া দেখিনি, লেক ছেড়ে চলে যাওয়া দেখেছি। লেক লিজ দেওয়া পাখিদের বিচরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।’

বহিরাগত সমস্যা নিয়ে জাবির নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান বলেন, ‘অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি এই পাঁচ মাস ক্যাম্পাসে প্রচুর বহিরাগত আসে। আজকাল আরেক অরাজকতা দেখা গেছে, অনেকেই পুরো ফ্যামিলি নিয়ে এসে গেট টুগেদার করছে জাহাঙ্গীরনগরে, যাদের সঙ্গে ক্যাম্পাসের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এগুলো আমরা বন্ধ করার চেষ্টা করছি। আবার নিরাপত্তার স্বার্থে বহিরাগতদের প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হলে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী, কর্মকর্তাদের সহায়তায় তারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে।’

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নের মাস্টারপ্লান ঘোষণা হয়েছে। বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করার জন্য গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে।

এই ব্যাপারে অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান বলেন, ‘প্রতিবছর পরিযায়ী পাখিগুলো নেপাল বা হিমালয় অঞ্চল ও দেশীয় বিভিন্ন হাওর থেকে জাবি ক্যাম্পাসে এসে থাকে। হাঁস জাতীয় পাখিগুলো লেকের পাশের গাছগুলোতে বাসা করে থাকে এবং জুন-জুলাইয়ের দিকে গাছে ডিম দেয় ও বাচ্চা ফুটিয়ে বংশবিস্তার করে।’

‘উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অনেক জায়গায় গাছ কাটা পড়ছে যা পাখিদের বাসস্থান ও বংশবিস্তারে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর লেকের পাশের গাছগুলো বাচ্চা দেওয়ার মতো ততটা উপযোগী নয়। এই জায়গাগুলো ছাড়া বাকি যেই জায়গাগুলো রয়েছে সেগুলো যদি রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়, আরো বেশি পরিমাণে গাছ লাগানো যায় তাহলে সবুজের পরিমাণ বাড়বে। তখন ক্যাম্পাস পাখিদের থাকার উপযোগী হবে।’

জাবির ১৯৮৩-৮৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং বর্তমান কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বিশ্বে জলবায়ুগত পরিবর্তন হয়েছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার কারণে সাইবেরিয়ার তাপমাত্রা আগের থেকে বেড়েছে। পাখি কম আসার এটি একটি কারণ হতে পারে।’

‘তাছাড়া আগের তুলনায় ক্যাম্পাসে গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। উচ্চ হর্নে পাখিরা ভয় পায়। বহিরাগতদের অনেকে পাখির দিকে ঢিল ছুড়ে। ফলে এখন ট্রান্সপোর্টের পাশের লেকগুলোতে পাখি বসেই না। আবার বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের অনুষ্ঠানে উচ্চৈঃস্বরে গান, আতশবাজির কারণে রাতে পাখিদের থাকার পরিবেশ থাকে না।’

পরিসংখ্যান বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মো. খান মাহমুদ মঈম হাসান বলেন, ‘আগে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চের শুরু পর্যন্ত অতিথি পাখিরা অবস্থান করত। বর্তমানে নভেম্বরের শুরুতে আসে এবং ডিসেম্বর শেষ না হতেই চলে যায়। আগের তুলনায় অতিথি পাখি এখন ৪০ শতাংশ কমে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘কনস্ট্রাকশন সাইটের শব্দ, আবহাওয়ার পরিবর্তন, জলাশয়ের পরিবেশ নষ্ট, বহিরাগত ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের উৎপাত ও পাখি শিকার, গাড়ির উচ্চ হর্ন, আতশবাজি, মাইকিং, কনসার্টের শব্দ, প্রশাসনের ভূমিকা পালনে অবহেলা ইত্যাদির জন্য পাখি চলে যাচ্ছে।’

সৌন্দর্যের জন্য খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অন্যতম অংশ অতিথি পাখি। উদ্বেগজনকভাবে এসব পাখি কমে যাওয়ার কারণগুলো অনুসন্ধান করে দ্রুত ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেওয়ার দাবি পাখি গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও পরিবেশবিদদের।

[প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন ফারিয়া আফরিন; মো. আরিফুল ইসলাম চঞ্চল; সিলভিয়া আক্তার; নাঈম হাসান ও গোলাম আযম। তারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮তম আবর্তনের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী]

সংবাদটি শেয়ার করুন

শিক্ষা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিক্ষা এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :