"জিএম কাদের এবং আয়নায় ভাইয়ের মুখ"

সোহেল সানি
 | প্রকাশিত : ০৮ জুন ২০২৩, ০৯:৩৮

সরকারে মন্ত্রী থাকলে এক দৃষ্টিভঙ্গি আর মন্ত্রী না থাকলে আরেক দৃষ্টিভঙ্গি - মাঝেমধ্যে সাবেক স্বৈরাচার এরশাদের ভ্রাতা জি এম কাদেরের বক্তৃতা বিবৃতি শুনে এটাই মনে হচ্ছে।

জিএম কাদেরের ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছে নিজগুণে নয়, অন্তত রাজনৈতিক আলোর সবটুকুই ভাইয়ের সূত্র ধরে। বক্তৃতা বিবৃতিদানের ক্ষেত্রে জিএম কাদের হয়তো এ বিষয়টি ভুলে যান। তাইতো অবলীলায় বলতে পারেন, দেশে একনায়কতন্ত্র চালু করতে গিয়েই যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তার দেশের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

জিএম কাদের একধাপ এগিয়ে তিনি আগাম বলে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র না দিলে কানাডাও দিবে না, এমনকি ব্রিটিশরা ঢুকতে দেবে না।

কিন্তু জিএম কাদেরের ওই অপরিপক্ক ধারণাপ্রসূত আগাম মন্তব্যের কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারা কুক বলে দিয়েছেন যে, "যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নীতি তাদের নিজস্ব নীতি। ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন বাংলাদেশকে কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিন্তা করছে না। অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ একটি ইউরোপীয়ান পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে। জিএম কাদের বিরোধী দলের উপনেতা এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের টানাপোড়েনের একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তাঁর বক্তব্য যদি হয় উস্কানীমূলক তবে সত্যিই তা দুঃখজনক। তিনি দুটি দেশের মধ্যে এরকম বৈরী সম্পর্কের মুখে যে বক্তৃতা করেছেন, তা দেশাত্মবোধের পরিচয় বহন করে না।

জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলের উপনেতা জিএম কাদের খোঁচা মেঠে সাধারণ মানুষের হুঁশ ফেরাতেও চেষ্টা করেছেন আরও কতগুলো কথা বলে। তিনি বলেছেন, "যখন দলের (আওয়ামী লীগ) নিয়ন্ত্রণ থাকে সরকারের ওপর, সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের ওপর, নির্বাচন কমিশনের ওপর, দুর্নীতিদমন কমিশন এবং রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানের ওপর, তখন সেটাকে আর বহুদলীয় গণতন্ত্র বলা যায় না। সেটা তখন হয়ে যায় বাকশাল। আপনাদের বাকশালীয় কথা যাদের মনে আছে, চিন্তা করে দেখেন তারা কী ছিল।"

গত ২৭ মে রংপুরের পাগলাপীরে জাতীয় পার্টির এক সভায় উপর্যুক্ত কথাগুলো বলেছেন।

জিএম কাদের শেখ হাসিনা সরকারের এখন মন্ত্রী নন, কিন্তু যখন মন্ত্রী ছিলেন, তখন সরকারের ভালো-মন্দের ওপর তাঁর দায় ছিল। কাল তিনি মন্ত্রী হলে আজ যে জিএম কাদেরকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেই জিএম কাদেরকে দেখতে পাবো না। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বন্দনায় মক্ত হবেন, সরকারের সাফল্যের ফিরিস্তি তুলে ধরবেন বক্তৃতা- বিবৃতিতে। কারণ আমরা শেখ হাসিনার মন্ত্রী রূপে জিএম কাদেরকেও দেখেছি। তিনি শুধু নন, ওয়ার্কার্স পার্টির প্রধান রাশেদ খান মেনন এমপিরও দ্বৈত রূপ আমরা দেখেছি। তিনি শেখ হাসিনার মন্ত্রী থাকাকালীন সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কিন্তু মন্ত্রীত্ব হারিয়ে নির্বাচন নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন, যেনো বিএনপির চেয়েও তার দল কঠোর অবস্থানে। গত নির্বাচনকে রাতের ভোট ডাকাতির নির্বাচন বলেছেন। অথচ সেই নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েছেন বলে বিব্রতবোধও করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে রাশেদ খান মেনন এ নির্বাচনকে ধিক্কার জানিয়ে বিএনপি দলীয় সদস্যদের ন্যায় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেননি। রাশেদ খান মেনন একটিবার বিবেকের কাঠগড়ায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখুন, যে নির্বাচনকে অবৈধ বলে আওয়ামী লীগকে তুলোধুনো করে বাহবা কুড়াচ্ছেন সেই আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে আপনাকে বৈতরণী পার পেতে হয়। নিজ দল ওয়ার্কার্স পার্টির কাস্তে প্রতীক নিয়ে জামানত বাজেয়াপ্তির কারণেই যখন নৌকায় ওঠেন তখন একটু চোখ লজ্জা তো থাকা উচিত। রাশেদ খান মেনন আজ শেখ হাসিনার নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক তুলেছেন অথচ, তার পরিবারের ভুমিকাটি কি জাতি মনে রেখেছে? তার এক ভাই এনায়েত উল্লাহ খান জিয়ার সামরিক সরকারের মন্ত্রী (উপদেষ্টা) ছিলেন। আরেক ভাই ওবায়দুল্লাহ খান এরশাদের সামরিক সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। তার বোন বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রী ছিলেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানও বটে। পিতা আব্দুল জব্বার খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার ছিলেন। গণহত্যাকে স্বাগত জানিয়ে তিনি গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে গভর্নর হাউজে (বঙ্গভবন) রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছিলেন। অবশ্য তিনিই শুধু স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন।

আর জিএম কাদের, আপনার রাজনৈতিক উত্থান কিভাবে হয়েছে, কেন হয়েছে - চোখ বন্ধ করে ভাবুন। দেখতে পাবেন আপনি নিজগুণে আজকের অবস্থানে অবতীর্ণ হননি। আর যাঁর গুণে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছেন, সেই এরশাদ জমানার কথা ভাবুন। অনেক জ্ঞানীগুণি তাত্ত্বিক বলে থাকেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে দেশটা চীনের পথে আলোকিত হতো। ধরে নিলাম সময়ের কাজ সময়ে হয়নি বলে বাকশাল ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য বাকশাল ব্যর্থ হয়েছে এটাও বলা যাবে না। কেননা বাকশাল ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে দেয়া হয় অঙ্কুরেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। জিএম কাদের দেশে শাসনব্যবস্থায় বাকশালীয় রূপ দেখতে পাচ্ছেন - এমনটি বলে প্রকারান্তরে শেখ হাসিনা সরকারের বিষোদগার করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তার ভাই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাতের আধারে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে কতটা জালেম শাহী হয়ে উঠেছিলেন - তা কী ভুলে গেছেন? এরশাদ সামরিক শাসনের যাঁতাকলে জাতিকে কিভাবে পিষ্ট করেছিলেন? কত মায়ের বুক খালি করেছিলেন সেলিম-দেলোয়ার, দিপালী সাহা রাউফুন বসনিয়াদের হত্যা করে। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনের কথা কি ভুলে গেলেন? আপনার ভ্রাতা এরশাদ রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন কিভাবে? একটু চিন্তা করুন। বঙ্গবন্ধুর খুনী কর্নেল ফারুককে শুধু রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থীই করেননি তাকে দিয়ে ফ্রীডম পার্টি গঠন করিয়ে দেশে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ১৯৮৮ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে হামলা পরিচালনায় ফ্রীডম পার্টিকে পৃষ্ষোপোষকতা দিয়েছে। জিএম কাদের একটু অতীতের দিকে তাকিয়ে দেখুন- ১৯৮১ সালের ৩০ মে জেনারেল জিয়া নিহত হলে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার হয়েছিলেন ভারপ্রাপ্ত বা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি।

ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজের নেতৃত্বে দক্ষিণপন্থী মেরুকরণের মুখে পড়েছিল বিএনপি। উপপ্রধান মন্ত্রী ডাঃ একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের নেতৃত্বাধীন ভাসানী ন্যাপের নেতারা এবং মডারেট গ্রুপ বলে পরিচিতরা বেগম জিয়ার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বেগম জিয়া বনাম বিচারপতি সাত্তার দ্বন্দ্ব প্রকট হলে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি সাত্তারের পক্ষে অবস্থান নেন। সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতি সাত্তার অযোগ্য বিবেচিত হলে ১ জুলাই ১৯৮১ সালে সংবিধানে ষষ্ঠ সংশোধনী আনা হয়। এসবই করেছিলেন আপনার ভ্রাতা সেনাপ্রধান এরশাদ।

যাহোক আব্দুস সাত্তার ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডঃ কামাল হোসেনকে হারিয়ে। কিন্তু ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ পদচ্যুত হন জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসনের মুখে। রাষ্ট্রপতি সাত্তার১৯৮৫ সালের ৫ অক্টোবর ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিচারপতি সাত্তার সরকারকে হটিয়ে দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। ২৭ মার্চ রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে দিলেন দূরসম্পর্কের আত্মীয় বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে। ১৯১৫ সালে ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণকারী রাষ্ট্রপতি চৌধুরীকে চরম অসৌজন্যমূলকভাবে বিদায় করেন জেনারেল এরশাদ। তিনি পদত্যাগ করার আগে অনুরোধ করে বলেছিলেন যে বিজয় দিবসের সম্মানটুকু নিয়ে তিনি পদত্যাগ করতে চান। কিন্তু সে সুযোগ দেয়া হয়নি। ১১ ডিসেম্বরই রাষ্ট্রপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে পদত্যাগ করে বঙ্গভবন ছাড়তে হয়।

১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারী জন্মনেয়া এরশাদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দিয়েও বিজয়ী হন। যে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর খুনী কর্নেল ফারুক তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।

জেনারেল এরশাদ বঙ্গভবন ব্যবহার করলেও পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন ক্যান্টনমেন্টেই। ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তা়ঁকে পদত্যাগ করতে হয় তিনজোটের রূপকথার আলোকে।

উপরাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতি এরশাদ তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন। তারপর এরশাদ পদত্যাগ করলে উপরাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে তাঁর নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এখন প্রকটতর। বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং জিএম কাদেরের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে মিলের অপেক্ষা অমিলই বেশি।

যে অমিলের জের মাঝেমধ্যেই জাতীয় পার্টিতে ভাঙ্গনের পদধ্বনি শোনায়। জিএম কাদেরের অতি বিশ্বস্ত একটি সূত্র মতে বিরোধী উপনেতা জিএম কাদের একান্তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি সাক্ষাৎ প্রত্যাশা করছিলেন, কিন্তু বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদকে ছাড়া এরকম সাক্ষাৎ দিতে চান না প্রধানমন্ত্রী। জিএম কাদের কী এ কারণেই সরকারের ওপর নাখোশ?

যাহোক জিএম কাদের সাহেব, আপনার অপেক্ষা আর কেইবা বেশি জানেন যে, আপনার ভাই দ্বারা কতটা নিগৃহীত ছিলেন রওশন এরশাদ। কত জ্বালাযন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে আপনার ভাবিকে। অন্তত আপনি সুযোগ্য দেবর হয়ে ওঠুন। কলহের ইতি ঘটিয়ে জাতীয় পার্টির গতি সঞ্চার করুন। দেশকে ভালোবাসুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুরে বলুন, বাংলাদেশ বীরের জাতি, পৃথিবীর কোন শক্তি নেই যে, বাঙালি জাতিকে পদানত করতে পারে। আর এই মন্ত্র তো আমাদের অস্থি মজ্জাতে মিশ্রিত করে দিয়ে গেছেন তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমান -আমাদের জাতির পিতা।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :