ঢালি কনস্ট্রাকশনকে ৪০৮ কোটি টাকা ঋণ দিতে কোনো নিয়মই মানেনি শাহজালাল ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
 | প্রকাশিত : ১১ জুন ২০২৩, ১৯:৩২

পর্যাপ্ত জামানত ও গ্রাহকের আর্থিক অবস্থা যাচাই করে ঋণ দেয়ার নিয়ম থাকলেও ঢালি কনস্ট্রাকশনের বেলায় এসবের কিছুই মানেনি শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। নানা অনিয়ম করে ঢাকার এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৪০৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি।

এমনকি ঢালি কনস্ট্রাকশন ট্রাস্ট ব্যাংক নেওয়া ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সেই টাকাও অধিগ্রহণ করে ব্যাংকটি। প্রতিষ্ঠানটির ঋণ পরিশোধ ব্যর্থতা জানার পরও ঝুঁকি আড়াল করে দেওয়া হয় নতুন ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে ঢালি কনস্ট্রাকশনকে ঋণ বিতরণে ব্যাংকটির এসব অনিয়ম, অসামঞ্জস্যতা ও যোগসাজশের চিত্র উঠে এসছে। ঋণ প্রদানে যুক্ত ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ এই দায় এড়াতে পারে না বলেও পরিদর্শন প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।

একই সঙ্গে, নতুন ঋণের জন্য কোনো জামানত গ্রহণ না করায় ব্যাংকের এ বিনিয়োগকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ঢালি কনস্ট্রাকশনকে ঋণ বিতরণে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশনা লঙ্ঘন হয়েছে। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ঢালি কনস্ট্রাকশনের আর্থিক অবস্থা যাচাইবাছাই না করেই ঋণ দেওয়া হয়।

এমনকি বিনিয়োগের কার্যাদেশ ও সম্পদের কোনো তথ্যও যাচাই করা হয়নি। পুরনো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়া ঢালি কনস্ট্রাকশনকে পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই নতুন করে ঋণ দেয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. শামসুদ্দোহা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ঋণ বিতরণ ও আদায় ব্যাংকের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ ঋণ আদায়ও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’

ঢালি কনস্ট্রাকশন ঋণ পরিশোধ করতে পারবে বলেও মনে করেন শাহজালালের ব্যাংকের এই কর্মকর্তা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ বলছে, ‘এ ঋণ আাদায় করা অনেক বেশি কঠিন।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে ঋণ বিতরণে অনিয়মের তথ্য উঠে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংক কর্মকর্তা শামসুদ্দোহা বলেন, ‘তারা (ব্যাংলাদেশ ব্যাংক) তদন্ত করে কি পেয়েছে বা প্রতিবেদনে কি আছে তা আমার জানা নেই।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ট্রাস্ট ব্যাংকের রাজধানীর দিলকুশা শাখা থেকে ২০১৩ সালে ১২৯ কোটি টাকা ঋণ নেয় ঢালি কনস্ট্রাকশন। কিন্তু এই ঋণ পরিশোধ না করায় ঢালি কনস্ট্রাকশনকে চাপ দিতে থাকে ট্রাস্ট ব্যাংক। এভাবে ২০১৫ সাল শেষে ঢালি কনস্ট্রাকশনের কাছে সুদে-আসলে ট্রাষ্ট ব্যাংকের পাওনা দাঁড়ায় ১৫৬ কোটি টাকায়।

ঋণ পরিশোধ করতে ট্রাস্ট ব্যাংকের অব্যাহত চাপের মুখে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন কয়েকজন কর্মকর্তা ও পরিচালনা পর্ষদের একাধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে ম্যানেজ করে ঢালি কনস্ট্রাকশন।

২০১৫ সালের নভেম্বরে মাসে ট্রাস্ট ব্যাংকের ঋণটি অধিগ্রহণ করার জন্য শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে আবেদন করে ঢালি কনস্ট্রাকশন। ওই বছরের ডিসেম্বরে ট্রাস্ট ব্যাংকে ঢালি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ১১৮ কোটি টাকার ঋণ অধিগ্রহণ করে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখা।

পরের মাস ডিসেম্বরে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ঢালি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে অতিরিক্ত ১৮৮ কোটি টাকা ফান্ডেড এবং ৭০ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড ঋণ দেয়।

২০১৭ সালের আগস্টে আরও ১১৫ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। এর মধ্যে ৮৫ কোটি টাকা ফান্ডেড এবং ৩০ কোটি টাকা নন-ফান্ডেড।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, কোন কার্যাদেশের বিপরীতে কত টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের কাছে। কিন্তু এ বিষয়ক কোনো তথ্য শাহজালাল ব্যাংক কৃর্তপক্ষ জানাতে পারেনি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিভিন্ন কোম্পানির দায় পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে ঢালি কনস্ট্রাকশনকে জোর করে ঋণ দিয়েছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। ফলে চলতি বছরের এপ্রিল শেষে ঢালি কনস্ট্রাকশনের কাছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৫০ কোটি টাকা ফান্ডেড এবং ৫৮ কোটি নন-ফান্ডেড ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।

আর ঋণের টাকা বারবার তাগাদা দিয়েও আদায় করতে পারছে না শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে ঢালি কনস্ট্রাকশন ৭২১ কাঠা জমি এবং ৩৭ হাজার বর্গফুটের একটি ভবন বন্ধক দিয়েছে। যা এ ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত নয় বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

তবে ঢালি কনস্ট্রাকশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটি দেশে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ভবনসহ বড় বড় সড়ক ও নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। কোভিড পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক সংকট রয়েছে। নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে এবং ঋণ পরিশোধ করা হবে। তাদের যে সম্পদ রয়েছে তা বিক্রি করে ব্যাংক পাওনা আদায় করতে পারবে।

কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ঢালি কনস্ট্রাকশন যা জামানত বা বন্ধক রেখেছে, তার মূল্য এই ঋণের পরিমানের চেয়ে কম।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢালি কনস্ট্রাকশনকে ঋণ বিতরণের সময় বিনিয়োগের সমান জামানত প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল পর্ষদ থেকে। কিন্তু শতভাগ জামানত রাখার প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও, ১৮৮ কোটি টাকা ফান্ডেড ঋণের বিপরীতে মাত্র ৯০ কোটি টাকার জামানত (জমি ও ভবন) গ্রহণ করা হয়েছিল। কম জামানত নিয়ে বিনিয়োগের বিষয়ে পর্ষদে জানানো হয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট কার্যাদেশের বিপরীতে বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ এবং সেই কাজের আদেশের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত বিলের সংখ্যা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দলকে কোনো তথ্য দিতে পারেনি শাহজালাল ব্যাংক।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৮৮ কোটি টাকার ফান্ডেড এবং ৭০ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড ঋণ অনুমোদন এবং ৭২১ কাঠা জমি বন্ধক নেওয়ার আগে একটি আইনি মতামত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনি মতামতকে আমলে নেয়নি ব্যাংকটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালনা পর্ষদ এই অনিয়মের দায় এড়াতে পারে না।

(ঢাকাটাইমস/১১জুন/আরআর/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :