মাসে ১২ কোটির লেনদেন, শেরপুরের ফার্নিচার যাচ্ছে ২৫ জেলায়
একদিকে যেমন ভালো মানের কাঠ পাওয়া যাচ্ছে, তেমনই শ্রমিকের মজুরিও কম, তাই শেরপুরের ফার্নিচার শিল্পে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের তৈরি বাহারি কারুকাজ খচিত ফার্নিচার সারা দেশের ২৫টি জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতি মাসে লেনদেন হচ্ছে কমপক্ষে ১২ কোটি টাকা। আর এ শিল্পকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ১৬ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের পথ। অন্যদিকে এই ব্যবসাকে আরো গতিশীল করতে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা দেয়া হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা।
সরেজমিনে জেলা শহরের পশ্চিম শেরী অষ্টমীতলা রোডে গেলে কথা হয় সোয়াইব ফার্নিচার মার্টের মালিক জাহিদুল ইসলামের (৩৬) সঙ্গে। তিনি জানান, দরিদ্রতার কারণে এক সময় সাইকেল ও রিকশার গ্যারেজে শ্রমিকের কাজ করতেন। ওই সময় তিনি রিকশার কাঠের তৈরি বডির কাজ শেখেন। সেই শিক্ষাকে পুঁজি করে ২০০২ সালে পরিচিত কয়েকজনের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু করেন ফার্নিচার ব্যবসা। প্রথম দিকে সারা দিনে একাই একটি খাট তৈরি করতেন। তা বিক্রি শেষে আয় করতে পারতেন ৫শ-৭শ’ টাকা। এক পর্যায়ে খাটের চাহিদা বেড়ে গেলে দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে পাঁচজন শ্রমিক নেন। ওই সময় তিনি দৈনিক পাঁচটি খাট তৈরি করে বিক্রি করতেন। এভাবে টানা ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্যবসা করে লাভের টাকায় ট্রলি এবং কাভার্ড ভ্যান কেনেন। ফার্নিচার ব্যবসা বাদ দিয়ে শুরু করেন গাড়ির ব্যবসা। ওই ব্যবসায় অধিক পরিশ্রমের কারণে সব গাড়ি বিক্রি করে ২০১৪ সালে আবারও ফিরে আসেন ফার্নিচারের ব্যবসায়। পরে ১০ লাখ টাকা সিকিউরিটি মানি এবং মাসিক ২৪ হাজার টাকা ভাড়ায় দুটি দোকান নেন। তার এখানে বর্তমানে ১৬ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছে।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, এখন তিনি খাট ছাড়াও কাঠের তৈরি নানা ধরনের আসবাবপত্র তৈরি করছেন। মান ভেদে একটি খাট ৮০০০-৩০০০০, ওয়ারড্রপ ৮০০০-৫০০০০, সোফাসেট ১০০০০-৬০০০০, ডাইনিং টেবিল ১২০০০-৫০০০০, কেবিনেট ১৫০০০-৮০০০০ এবং ড্রেসিং টেবিল ৬০০০-৪০০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেন। ওইসব ফার্নিচার তৈরিতে ব্যবহার করেন একাশিয়া, কাঁঠাল, সেগুন, মেহগনী ও কড়ই গাছের কাঠ। দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় একশিয়া কাঠের প্রতি গ্রাহকের সবচেয়ে আগ্রহ বেশি। এছাড়া এই কাঠ জেলার সীমান্তবর্তী শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ীর গারো পাহাড় থেকে সংগ্রহ করা হয়। সরকার প্রতি বছর নিলামের মাধ্যমে ওইসব কাঠ বিক্রি করে থাকে। পাশাপাশি টাঙ্গাইলের মধুপুর এবং ঘাটাইল থেকেও ফার্নিচার তৈরির কাঠ সংগ্রহ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, লাভজনক হওয়ায় তার আরও দুই ভাই ফার্নিচার ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়েছেন।
আরেক ব্যবসায়ী আবু বক্কর বলেন, ভালো মানের কাঠ এবং শ্রমিকের মজুরি কম হওয়ায় শেরপুরের ফার্নিচার শিল্পে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। বর্তমানে ৭-৮ আইটেমের বাহারি কারুকাজ খচিত ফার্নিচার পাইকারি দরে ঢাকা, জামালপুর, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, নরসিংদী, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, খুলনা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কুমিল্লা, গাজীপুর, বরিশালসহ অন্তত ২৫টি জেলায় বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ী আবু জাফর বলেন, জেলার সদরসহ নকলা, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নকলার সর্বত্রই ফার্নিচারের দোকান আছে। এর মধ্যে সদরেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দোকান রয়েছে। বিশেষ করে পূর্বশেরী, পশ্চিমশেরী, বয়রা, কনাসাখলা এলাকায় সবচেয়ে বেশি পাইকারি মালের কাজ করা হয়। দিন দিন ফার্নিচারের চাহিদা বাড়তে থাকায় জেলাজুড়ে কমপক্ষে ১৮-১৯ শ’টি ফার্নিচার কারখানা তৈরি হয়েছে। আর ওইসব কারখানায় ১৬ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
আরও পড়ুন: শেরপুরে সরবরাহ করা হচ্ছে রপ্তানিযোগ্য মাছের আঁশ
আবু জাফর আরো বলেন, ফার্নিচার ব্যবসার প্রসার ঘটায় স’মিলের সংখ্যাও বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় দুই শতাধিক মিলে কাঠ কেটে প্রসেস করা হচ্ছে। সেখানেও বহু মানুষের কাজের সংস্থান হয়েছে।
ব্যবসায়ী রতন মিয়া বলেন, প্রায় ৩০ বছর আগে জেলায় ফার্নিচার ব্যবসা শুরু হয়। ওই সময় খুব সাধারণ মানের খাটের প্রচলন ছিল। পরে ধীরে ধীরে হরেক রকমের খাট ও অন্যান্য নানা আইটেমের কাঠের আসবাবপত্র বাজারে চলে আসে। বর্তমানে পাইকাররা পাতা, এলইডি, তাজমহল, কলসি, ফুলবক্স, ফোমকাটিং, রিং মডেল ও চিরপাতা মডেলের খাটের অর্ডার বেশি দেয়।
তিনি আরো বলেন, করোনার পর থেকে ফার্নিচার ব্যবসা অনেক বেশি জমজমাট হয়েছে। অনেকে পাইকারদের অর্ডারমাফিক পণ্য সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছে। অপু-শ্রাবণ ফার্নিচার মার্টের ম্যানেজার স্বপন মিয়া বলেন, রেডি মেইড ফার্নিচার বিক্রির জন্য তাদের তিনটা শোরুম রয়েছে। নিজ জেলা ছাড়াও তারা পাশের জামালপুর পুলিশ লাইন্সে মালামাল সরবরাহ করেন।
ভৈরব থেকে আসা পাইকার ফারুক মিয়া বলেন, দাম কম এবং নানা ডিজাইনের ফার্নিচার এখানে পাওয়া যায়। আর ভৈরবের বাজারে এ সব পণ্যের চাহিদাও ব্যাপক। এ কারণে প্রতি সপ্তাহেই শেরপুর থেকে খাট, আলমিরা এবং ড্রেসিং টেবিল নিয়ে যাই।
ফার্নিচার কারখানার শ্রমিক বাবুল মিয়া বলেন, বাবা ট্রাকের হেলপারির কাজ করে। আর আমরা তিন ভাই ফার্নিচার তৈরির কারখানায় কাজ করি। সবাই প্রতিদিন ৭০০-১০০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পাই।
ফার্নিচার কারখানা মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল হান্নান হীরা বলেন, সারা বছরই পাইকারদের কাছ থেকে অর্ডার পাওয়া যায়। তবে বছরের ডিসেম্বর থেকে মে মাস হচ্ছে ফার্নিচার তৈরি এবং বিক্রির ভরা মৌসুম। এছাড়া দুই ঈদেও ব্যাপক পরিমাণ চাহিদা থাকে। ওই সময় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ফার্নিচার কেনাবেচা হয়। পাশাপাশি সদরের গাজীর মাজার, টিপু শাহ মাজার, নেত্রকোনার দুর্গাপুরের রিজভিয়া দরবার শরীফ, সমিরের মাজার, মোহনগঞ্জের কালিপূজা, ফুলপুর আলিয়া মাদ্রাসা, জামালপুরের শাহ কামালের মাজার, স্বাধীনতা দিবস, চৈত্র মাসের জামাই ও অষ্টমী মেলায় আমরা নিজেরাই দোকান খুলে ব্যবসা করি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ফার্নিচার কারখানার মালিকরা গড়ে প্রতিদিন ৩৫-৪০ লাখ টাকার পাইকারি অর্ডার পাচ্ছেন। সে হিসাবে প্রতি মাসে কমপক্ষে ১২ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে এই শিল্পে।
আব্দুল হান্নান হীরা জানান, প্লাইউড, তারকাটা, বার্নিশসহ ফার্নিচার তৈরির নানা ধরনের সরঞ্জামের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে পাল্লা দিয়ে ফার্নিচারের চাহিদা কয়েকগুণ বাড়লেও তাদের আয়ের পরিমাণ সেভাবে বাড়েনি।
অন্যদিকে এই ব্যবসাকে আরো গতিশীল করতে প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের জেলা ব্যবস্থাপক বিজয় কুমার দত্ত।
(ঢাকাটাইমস/৭সেপ্টেম্বর/এআর)