সোনালী ঐতিহ্যের রাজধানী সোনারগাঁওয়ে চার ঘণ্টা

ঈশা খাঁ ও তার বংশধরদের শাসনামলে সোনারগাঁও ছিল প্রাচীন বাংলার রাজধানী। দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে সুবে বাংলার রাজধানী হয় ঢাকা। তারপর থেকে জৌলুস কমতে থাকে সোনালী ঐতিহ্যের রাজধানী সোনারগাঁওয়ের। এর আরেকটি নাম ছিল পানাম নগরী।
এর সবই এতদিন বইয়ে পড়া ছিল। বাস্তবে কেমন ছিল সেই প্রাচীন জনপদ? জানার ছিল কৌতূহল, ছিল স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছা। ছুটির দিনের মওকা পেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সোনারগাঁও দেখতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে এই ভ্রমণে আমার সঙ্গী বান্ধবী রিয়া ঢালী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ওই অর্থে রাজধানীও আমার খুব একটা চেনা নয়। তায় আবার অদূরে সোনারগাঁও ভ্রমণে যাওয়া! তবুও সাহস সঙ্গী! ঢাকা থেকে মাত্র ২৬ কিলোমিটারের পথ। গুলিস্তান থেকে বাসে চেপে বসলাম দুই বান্ধবী। সকাল-সকাল সোনারগাঁও পৌঁছেও গেলাম অল্প সময়ে।
নেমেই অবাক! নামের সঙ্গে গাঁও থাকলেও মোটেও গ্রাম ছিল না। এর প্রাচীনত্ব যে শহুরে ধাঁচেরই ছিল সেটি বুঝতে পারলাম। প্রথমেই আমরা যাই পানাম নগরে কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি টিকেট কাউন্টার খোলার আগেই আমরা হাজির। তার আগের সময়টুকু কি-করি কি-করি ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলাম।
ঠিক তখন চোখে লাগলো একরাশ শুভ্রতা। সবুজ মাঠ ছেয়ে আছে সাদা কাশবনে। আকাশে সাদাতুলো মেঘ আর কাশফুল দেখে স্মরণে এলো এখন তো শরতকাল। কাশফুলের সঙ্গে তোলা হলো ছবি। এক-দেড় ঘন্টা যে কীভাবে কেটে গেলো টেরই পেলাম না।
বেলা ১০টার দিকে পানাম নগরীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম আমরা। লালচে ইটের তৈরি একতলা-দোতলা ভবনগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একসময় এখানে ধনী ব্যবসায়ীদের বাসস্থান ছিল। তখনকার সময়ের সেই আড়ম্বরপূর্ণ নগর আজ কেবল কালের সাক্ষী।
বেশ কয়েকটি ভবনের গায়ে লেখা ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন উপরে ওঠা নিষেধ’। নগরীর পাশ দিয়েই বয়ে গেছে এক সরু খাল। নাম তার ‘পঙ্খীরাজ’। নামের মধ্যেই একটা রাজকীয় ভাবসাব সেই সময়ের আভিজাত্য জানান দিচ্ছে।
কাঠফাটা রোদে ওখানকার ঘোরাঘুরির পালা চুকিয়ে এলাম লোকশিল্প জাদুঘরে। এখানে টিকেটের আবার প্রকারভেদ আছে। ৫০ টাকার টিকেট নিলে শুধু জাদুঘর দেখতে পারবেন আর দেড়শ টাকার টিকেট নিলে বড় সর্দার বাড়ির ভবন দেখার সুযোগ। আমরা দেড়শ টাকার টিকেট কাটলাম।
বড় সর্দার বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম। দেখি ওমা! এই ভবনের দৃশ্যই তো এতদিন তাহলে পাঠ্যবইয়ে দেখে এসেছি৷ আজ স্বচক্ষে দেখলাম। ভেতরে চোখ ধাঁধানো কারুকাজ খচিত দেওয়াল। প্রাসাদের সামনে অস্ত্রহাতে পাহারা দিচ্ছে দুই অশ্বারোহী। যদিও তারা জীবন্ত ছিল না।
বড় সর্দার বাড়ি ঘুরে যাই লোকশিল্প জাদুঘরে। ভেতরটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত থাকায় একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। কারণ ততক্ষণে আমরা বাইরের রোদে পুড়ে, ঘেমে একাকার।
লোকশিল্প জাদুঘরে কাচের দেওয়ালে আবৃত নানা রকমের প্রাচীন নিদর্শন। বেশিরভাগই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত। জাদুঘরের সীমান্ত ঘেঁষে পেছন দিকটায় বিচরণের সুযোগ রয়েছে। যেখানে গিয়ে আপনার ছায়াঘেরা সবুজ গ্রামের কথা মনে আসবে।
মোটামুটি চারঘন্টার মধ্যেই বেশ ভালোভাবে পানাম নগর, বড় সর্দার বাড়ি ও লোকশিল্প জাদুঘর দেখার পালা চুকোলাম। এবার ফেরার পালা। ফের বাসে করে গুলিস্তান হয়ে ক্যাম্পাসে ফিরি। রাস্তাঘাট তেমন চেনা না থাকলেও পথ দেখিয়েছিল গুগল ম্যাপ!
ঢাকা থেকে কিভাবে যাবেন? ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা হয়ে উত্তরদিকে সোনারগাঁওয়ের অবস্থান। গুলিস্তানের হকি স্টেডিয়ামের পাশে বাস কাউন্টার। বিভিন্ন পরিবহনের বাস রয়েছে। যেকোনো একটিতে চড়ে বসতে পারেন। এছাড়া প্রাইভেটকারেও আপনি আসতে পারেন।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী

মন্তব্য করুন