চীনের কুনমিং ভ্রমণ: প্রস্তর অরণ্য, পুষ্প আর চির বসন্তের শহরে

“...আরম্ভের পূর্বেও আরম্ভ আছে। সন্ধ্যাবেলায় দীপ জ্বালার আগে সকালবেলায় সলতে পাকানো”র মতো ভ্রমণ কাহিনি শুরুর পূর্বে ভ্রমণের প্রেক্ষাপটটা বলেই শুরু করছি। ২০১৪ সালে সিঙ্গাপুর ভ্রমণের পর ২০১৫ সালে পবিত্র হজব্রত এবং ২০১৮ সালে ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব যাওয়া ছাড়া দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। ২০১৯ সালের শুরুতেই আমার মর্মসহচর প্রস্তাব করলেন রোজার ঈদের ছুটিতে ভ্রমণের পরিকল্পনা করে আগেভাগেই যেন ছুটির ব্যবস্থা করে নিই। সাধারণত ভ্রমণের আগে জায়গা নির্বাচনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দুজনে মিলেই। কিন্তু এবার সে দায়িত্বটা এককভাবে আমার উপর বর্তালো। যাইহোক আমি খুব বেশি ভাবনাচিন্তা না করে চীন ভ্রমণের ইচ্ছার কথা জানিয়ে দিলাম। তিনিও বিনা বাক্যব্যয়ে তা মেনে নিলেন। আমাদের মতো নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ সাধারণত শুধু ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে চীনে যায় না, যে জন্য ঘনিষ্ঠজনদের অনেকেরই প্রশ্ন ছিল এত দেশ থাকতে চীন কেন? সেই ছোটোবেলা থেকেই শুনে এসেছি প্রিয় নবি হজরত মোহাম্মদ (স.) এর একটি বাণী- ‘পড়ালেখার জন্য সুদূর চীন দেশে যাও।’ এত দেশ থাকতে চীন দেশের কথাই নবিজি কেন বলেছিলেন- এ রকম একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় ছিল সেই তখন থেকেই।
২.
তাছাড়া চীন ভ্রমণের মূলে আরো দুটো কারণ ছিল। প্রথম কারণটা হলো আমার প্রয়াত বড়ো ভাইয়ের একটা অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করা, আর দ্বিতীয় কারণ ছিল বেইজিং প্রবাসী ভাগনে রাজিবের আমন্ত্রণ। ২০১৭ সালের ২০শে অক্টোবর অফিসিয়াল ট্যুরে বড়ো ভাইয়ার চায়না যাওয়ার আনুষঙ্গিক যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু ১৯ অক্টোবর অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। ভাইয়ের সহকর্মীদের কাছে শুনেছি চীন ভ্রমণ নিয়ে তার উচ্ছ্বাসের কথা। অফিসের কাজে আগেও তাকে বেশ কয়েকটি দেশে যেতে হয়েছিল, কিন্তু অন্য কোনো দেশে ট্যুরে যাওয়ার আগে এতটা উচ্ছ্বসিত হতে নাকি তাকে কখনোই দেখা যায়নি। যৌবনের শুরুতে শোষণমুক্ত রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন বাবা এবং পরবর্তীতে বড়ো ভাইয়াও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। এক্ষেত্রে দুজনেরই আদর্শিক পুরুষ ছিলেন আধুনিক সমাজতান্ত্রিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী মাও সেতুং। ধারণা করি ভাইয়ার চীনের ট্যুর নিয়ে এতটা আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মাও সেতুং-এর হাতে গড়া নয়াচীনের ঐশ্বর্য আর উন্নয়ন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে সুযোগ তার হলো না! বড়ো ভাইয়ার সে ইচ্ছার কথাটা বিশেষভাবে মনে গেঁথেছিল। ভ্রমণের জন্য আমরা চীনের তিনটি স্থান নির্বাচন করেছিলাম- সাংহাই, বেইজিং এবং কুনমিং। ভ্রমণ তালিকার সর্বশেষ স্থান কুনমিংয়ের গল্পই আজ বলছি।
৩.
ঢাকা থেকে গুয়াংজু হয়ে আমরা প্রথমে গিয়েছিলাম সাংহাই। বুলেট ট্রেনে সাংহাই থেকে বেইজিং এবং বেইজিং থেকে আমরা আবার ফিরে আসি সাংহাইতে। এবার সাংহাই থেকে আকাশপথে আমরা আমাদের ভ্রমণের সর্বশেষ স্থান কুনমিং পৌঁছি। কুনমিং এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছালাম তখন স্থানীয় সময় সকাল ১০টা। ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন বিমানবন্দরটি প্রথম দেখাতেই নজর কেড়ে নিলো। বিশ্বের ১০০টি শ্রেষ্ঠ বিমানবন্দরের একটি এই কুনমিং বিমানবন্দর। মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে চারপাশে দৃষ্টি ঘুরে ফিরছিল। সারা পথের ক্লান্তি নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। বিমানবন্দরের দেওয়ালে দেখতে বেশ বড়ো বড়ো অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে ‘ক্যাপিটাল সিটি অব ফ্লাওয়ারস্’, আবার কোথাও লেখা আছে ‘সিটি অব ইটার্নাল স্প্রিং’। ইতোমধ্যে ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমিরা বাইরে বের হয়ে এলাম। দেশ থেকে যাওয়ার আগেই জাবিয়ান এক ছোটো ভাই- যে কিছুদিন আগেই কুনমিং ঘুরে এসেছিল তার কাছ থেকে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের ফোন নম্বর নিয়ে নেওয়া হয়েছিল এবং উইচ্যাটে তার সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়েছিল। বাইরে এসেই তাকে ফোন দেওয়া হলো, সে আমাদের অপেক্ষায়ই কাছাকাছি অবস্থানে ছিল। যে কারণে ওকে খুঁজে পাওয়া গেল সহজেই।
৪.
চীনের তিনটি প্রদেশ ভ্রমণে লক্ষ করেছি অধিকাংশ চীনাদের ইংরেজি জ্ঞান খুবই সীমাবদ্ধ। যে কারণে চীন ভ্রমণে আমাদেরকে ভাষাগত সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রায়শই। তবে প্রযুক্তিগত দক্ষতার গুণে চীনারা এই দুর্বলতাটা ঠিকই উৎরে যাচ্ছে। আমরা ইংরেজিতে ওদের ফোনে লিখে দিতাম আমাদের প্রয়োজনীয় বার্তাটি, ওরা সেটা চীনা ভাষায় অনুবাদ করে নিত। এখানেও একই পদ্ধতিতে কাজ সেরে নিতে হবে বুঝে নিলাম। আমরা টাক্সিতে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গেই ড্রাইভার তার ফোনটি আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিলো। আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্য ইংরেজিতে ওর ফোনে লিখে দেয়া হলো। নীরবতা এবং অনেকাংশেই নির্জনতা সঙ্গী করে রাস্তার দুই পাশের মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা ছুটে চললাম ঢাকা থেকে বুকিং দিয়ে রাখা কুনমিংয়ের হোটেল হলিডে ইন এর উদ্দেশ্যে। যানজটমুক্ত রাস্তার দুই পাশে সবুজ আর নানা রকম বাহারি ফুলের সৌন্দর্য পসরা সাজিয়ে বসে আছে যেন অতিথিদের স্বাগত জানাতে। এসব দেখে জ্যাম আর ভীড়ের শহর ঢাকার কথা ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলাম আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে। হোটেলের রিসিপশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমাদের জন্য নির্ধারিত ৮ তলার কক্ষটিতে প্রবেশ করলাম। জানালা দিয়ে কুনমিং শহরের একাংশের প্রায় পুরোটাই দেখতে পেলাম। আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা, ফাঁকে ফাঁকে নানা বর্ণের বিচিত্র সব ফুল আর সবুজের সমারোহ, রাস্তায় সারিবদ্ধ গাড়িগুলো কেউ কাউকে টেক্কা দিয়ে আগে যাওয়ার চেষ্টা করছে না- অনেকটা সময় কখন পার হয়ে গেল এসব দেখতে দেখতে টেরই পেলাম না। সূর্যমামা ততক্ষণে পাটে বসেছেন, গোধূলিবেলার আকাশটা রঙিন হয়ে তাকে বিদায়ের আয়োজন করছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় ৮টার কাছাকাছি সময়, আমাদের দেশে তো এই সময়টাতে রীতিমতো রাত। আমরা তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়লাম কুনমিং শহর দেখতে।
৫.
ফুলের এবং চির বসন্তের শহর হিসেবে কুনমিংয়ের রয়েছে আলাদা মর্যাদা। চীনের ৪৩টি প্রদেশের মধ্যে ইউনান হচ্ছে একটি প্রদেশ। চীনা ভাষার শব্দ ইউনানে রয়েছে দুটো শব্দ-উই আর নান। উই মানে হচ্ছে মেঘ আর নান মানে হচ্ছে দক্ষিণ, অর্থাৎ উইনান মানে হচ্ছে দক্ষিণের মেঘ। সত্যি মেঘের কোলেই যেন অবস্থান করছে সমগ্র উইনান প্রদেশটি। না শীত, না গরম- কুনমিংয়ের আবহাওয়া সারা বছর একই রকম। বুঝতে পারলাম চির বসন্তের শহর নামটা যথার্থই। বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের প্রদেশও এটি। বিমানযোগে মাত্র দুই ঘণ্টার যাত্রাপথ। মিয়ানমার সীমান্তের পূর্ব পাশেই এর অবস্থান। কুনমিং ইউনান প্রদেশের রাজধানী, সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। প্রায় ২৪০০ বছরের পুরোনো শহরটি আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর এক অনুপম নিদর্শন। প্রশস্ত, পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট ফুলে ফুলে শোভিত। দেখে মনে হচ্ছিল পুরো শহরটাই যেন ফুলের বাগান। ‘প্রাণের মাঝে তোমারে ঢাকিব, ফুলের পাশে বাঁধিয়ে রাখিব’ চারপাশে এত এত সব ফুল দেখে রবীন্দ্রনাথের লেখা গানের এই কলিটি বারবার মনে পড়ছিল। কুনমিং শহরের ৮০০০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে পথঘাট, সড়কদ্বীপ, ফুটপাথ সর্বত্রই রয়েছে ফুলের সমারোহ। শুধু তাই নয় ফ্লাওয়ার গ্রিন হাউজ, পারফিউম মিউজিয়াম, ফোর ডি সিনেমাতেও ফুলের উপস্থিতি অনিবার্য। কুনমিং শহরেই রয়েছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ ফুলের মার্কেট- যেখান থেকে শুধু চীনের বিভিন্ন প্রদেশেই নয় জাপান, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর এমনকি বাংলাদেশেও প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ ফুল রপ্তানি করা হয়ে থাকে। কুনমিং শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে তৌনান ফ্লাওয়ার মার্কেটটি অবস্থিত। স্থানীয় লোকজনের কাছে মার্কেটটি ‘হার্ট অব ফ্লাওয়ার সাপ্লাই’ নামে পরিচিত। অনেকে আবার এটিকে ‘ফ্লাওয়ার সি’ও বলে থাকেন। এই ফ্লাওয়ার মার্কেটের অধিকাংশ বিক্রেতাই নারী, সন্তান কোলে নিয়েই দিব্যি তারা কেনাবেচার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন। নিজেদের বাগানে চাষ করা লিলি, রোজ, কারনেশন, অন্থরিয়াম, গ্লাডিওলাস, চাইনিজ রোজ, জারবেরা, অর্কিডসহ বিচিত্র ফুলের সমাহারে সমৃদ্ধ এই ফুলের মার্কেট। জানা যায়, কুনমিংয়েই নাকি সবচেয়ে বেশি গোলাপ চাষ করা হয়ে থাকে।
৬.
কুনমিং ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন আমাদের গন্তব্য ছিল পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময় হিসেবে খ্যাত স্টোন ফরেস্ট। কুনমিং শহর থেকে ৮৬ কিলোমিটার দূরে সাইলন জেলায় অবস্থিত স্টোন ফরেস্ট। বাস, ট্রেন বা ট্যাক্সি করে খুব সহজেই ওখানে যাওয়া যায়। হোটেল ম্যানেজারের সহযোগিতায় যাওয়া-আসার চুক্তিতে আমরা একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে নিয়েছিলাম। রাস্তার দুই পাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। স্টোন ফরেস্টে ঢোকার মুখে আমাদের সঙ্গে দেখা হলো এক চায়নিজ পরিবারের সঙ্গে। ত্রিশ/পঁয়ত্রিশ বছরের এক তরুণী মা, তার বছর পাঁচেকের মিষ্টি মেয়েকে নিয়ে বাবা এবং ভাইয়ের সঙ্গে অন্য একটা প্রদেশ থেকে বেড়াতে এসেছে। স্টোন ফরেস্টে ঢোকার পূর্বে টিকেট কাটা, কার এবং গাইড ঠিক করাসহ অন্যসব আনুষঙ্গিক কাজে তরুণীটি আমাদেরকে বেশ সহযোগিতা করলো। 'অচেনা অসীম আঁধারে' মেয়েটি যেন আলোর দিশারি হয়ে আমাদেরকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললো। ইংরেজিতে মোটামুটি দক্ষ তরুণীটির সঙ্গে আমরা কথা বলে ভাবের আদান-প্রদান করতে পারছিলাম বেশ সহজেই, তবে অধিকাংশ চীনাদের মতোই ওর বাবা এবং ভাইয়ের ইংরেজি জ্ঞান ছিল একেবারেই শূন্যের কোঠায়। স্টোন ফরেস্ট ঘুরে বেড়ানোর পুরোটা সময়ই আমরা এই চীনা পরিবারটির সঙ্গেই ছিলাম। ওদের আন্তরিকতা ছিল মুগ্ধ হওয়ার মতোই। মূল ফরেস্টে প্রবেশ করার আগে বিশেষ ধরনের কারে করে কিছুটা রাস্তা যেতে হলো। প্রকৃতির এক বিচিত্র খেয়াল এই স্টোন ফরেস্ট। চীনা ভাষায় স্টোন ফরেস্টকে বলা হয় শিলিন- শি অর্থ পাথর আর লিন অর্থ বন, অর্থাৎ পাথরের বন। মূল এলাকায় প্রবেশের আগেই বুঝে গেলাম আমরা ভিন্ন এক জগতে পৌঁছে গেছি। বিভিন্ন আকৃতির সারি সারি পাথরের মূর্তি আমাদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য যেন দাঁড়িয়ে আছে। বিচিত্র সব পাথরের মূর্তি দেখে মনে পড়ে গেল রামায়ণে বর্ণিত অহল্যার কথা যে গৌতম মুনির অভিশাপে পাথরে পরিণত হয়েছিল, হাজার বছর পর রামচন্দ্রের আগমনে সে পুনরায় মানবী রূপ ফিরে পেয়েছিল। কিন্তু এখানকার পাথরের মূর্তিগুলোর কখনোই প্রাণ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ইউনান প্রদেশের পাথরের বনটি পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্যজনক দর্শনীয় স্থান। জানা যায় স্টোন ফরেস্টের আজকের এই অবস্থানে আসতে সময় লেগেছে ২৭০ মিলিয়ন বছর। সাগরের তলদেশে জমে থাকা চুনাপাথর ভৌগোলিক পরিবর্তনের ফলে ভূ-পৃষ্ঠে ওঠে আসার কারণে এই স্টোন ফরেস্টের সৃষ্টি হয়েছিল বলে ভূ-তাত্ত্বিকদের অভিমত। এটি হিমালয় পর্বতমালারই একটি অংশ। ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে সমুদ্রের তলদেশে জমে থাকা চুনাপাথরের স্তর প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে ক্রমাগত উঁচু হতে হতে শিলাস্তরের অভিঘাতে এক সময় ছোটো ছোটো টিলার আকৃতিতে রূপ নেয়। ভূমি ক্ষয় ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে কোটি কোটি বছরের বিবর্তনে ধীরে ধীরে পাথরগুলো বিভিন্ন আকৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে স্থানটিকে পাথুরে ভাস্কর্যের আর্ট গ্যালারিতে পরিণত করেছে।
৭.
গাইডকে অনুসরণ করে আমরা স্টোন ফরেস্টের ওয়াচ টাওয়ারে ওঠে গেলাম। ওখানে দাঁড়িয়ে স্টোন ফরেস্টের অনেকটা অংশ দেখতে পেলাম। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু দেখতে পাই প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়- সভ্যতার এ এক অন্য রূপ! প্রাকৃতিকভাবে তৈরি পাথরের এক অপরূপ ভাস্কর্য যেন শিল্পীর নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় প্রাণ পেয়েছে। কোথাও যেন আবার পাহাড়ের বুকে এঁকে দেয়া হয়েছে নানা রকম সামুদ্রিক ফসিলের চিহ্ন। চীনাদের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে তারা জাত শিল্পী। প্রকৃতিও যেন সেই সত্যটিকে মেনে নিয়েছে। তাই তো চীনেই তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে এমন একটি সুবিশাল মহৎ শিল্পকর্ম। স্টোন ফরেস্টের কয়েকটি পাথরের আকৃতি বেশ আকর্ষণীয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আশিমা নামের স্তম্ভটি। নির্দিষ্ট একটি কোণ থেকে দেখলে মনে হয় একজন মেয়ে মাথায় রুমাল বেঁধে পিঠে বাঁশের ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয় উপজাতিরা মনে করে আশিমা হচ্ছে 'ই' জাতিগোষ্ঠীর ‘সানি’ গোত্রের মেয়ে। সে ভালোবেসেছিল এক তরুণকে, কিন্তু সমাজ সে ভালোবাসায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তরুণটি হারিয়ে যায় তার জীবন থেকে। সেই শোকে পাথর হয়ে যায় আশিমা। মাথায় স্কার্ফ পরে আর পিঠে ঝুড়ি নিয়ে সে যেন আজও অপেক্ষা করে আছে তার প্রিয় মানুষটির জন্য। আশিমাকে নিয়ে আরো একটি মিথ প্রচলিত রয়েছে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে। অপরূপা সুন্দরী আশিমার রূপে মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় রাজার ছেলে তাকে বিয়ে করতে চায়, রাজি না হওয়ায় স্বেচ্ছাচারী রাজার ছেলে তাকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। আশিমার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বিধাতা অভিশাপ দেন- পুরো রাজ্যে যে যেখানে আছে সবাই যেন পাথর হয়ে যায়। বিধাতার অভিশাপ সত্যি হয় এবং মানুষ, বনের পশুপাখি থেকে নিত্য ব্যবহার্য প্রতিটি বস্তুই পাথরে পরিণত হয়ে যায়। স্টোন ফরেস্ট এলাকায় প্রতি বছর 'ই' সম্প্রদায়ের লোকজন আশিমাকে স্মরণ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। একের পর এক বিস্ময়ের মুখোমুখি হয়ে আমরা পেরিয়ে যাচ্ছিলাম পাথরের বন।
৮.
ডাইনোসর, টাইগার, লায়ন, এলিফ্যান্ট, বিয়ার, ক্যামেল, ইঁদুর লোটাসসহ নানা রকম গার্হস্থ্য সামগ্রী, অস্ত্র আকৃতির পাথরগুলো দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ছিলাম। তোরণ আকৃতির উঁচু একটি পাথর দেখিয়ে গাইড আমাদেরকে জানালো ওটার নিচ দিয়ে যদি কোনো খারাপ মানুষ যায় তাহলে সে আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারে না, পাথর পড়ে তার মৃত্যু নাকি অবধারিত! খুব ইচ্ছে ছিল ঐ পাথরটার নিচে গিয়ে দাঁড়াতে, কিন্তু সুযোগ হলো না! খারাপ না ভালো মানুষ সেটা প্রমাণ করার সুযোগ আর পেলাম না! স্টোন ফরেস্টে ৩৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছোটো-বড়ো নানা বিচিত্র পাথর আকারের পাথর আর এসব পাথরের খাঁজে খাঁজে ছোটো ছোটো গুহা বা চোরাই পথ। দলছুট হয়ে পড়লে এসব চোরাই পথে হারিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কিছুদূর হাঁটার পর গাইড আবার আমাদেরকে একটা পাথরের কাছে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল এটা নাকি পরশ পাথর। এই পাথরটিকে স্পর্শ করে মনের ইচ্ছের কথা বললে সে ইচ্ছে নাকি পূরণ হয়। অন্য পাথরগুলোর তুলনায় এই পাথরটা অনেক বেশি মসৃণ আর শীতল। মনোস্কামনা পূরণের উদ্দেশ্য নয়, আমি পাথরটা ছুঁয়ে দিয়ে যুগ থেকে যুগান্তরের শতসহস্র মানুষের স্পর্শটাকে হৃদয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম। প্রায় ঘণ্টা দুই পাথরের বনে ঘুরে চাইনিজ পরিবারটিকে বিদায় জানিয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম আমরা। চির সুন্দরকে অভিবাদন জানিয়ে মনে বলে উঠলাম, ‘আহা! কী দেখিলাম! জন্ম-জন্মান্তরে ভুলিব না।’ বিস্ময়ের রেশটুকু নিয়েই উপভোগ করলাম ‘ই’ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী নাচ আর গান।
৯.
কুনমিং শহরের আশেপাশে আরো বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান থাকলেও সময়ের অভাবে আমাদের অন্য কোথাও আর যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ওয়েস্টিন হিল, ডাগুয়ান পার্ক, আদিবাসী গ্রাম, ইউনান যাদুঘর, গ্রান্ড ভিউ পার্ক, ড্রাগন গেট এসব স্থানের সৌন্দর্য না দেখতে পারার অতৃপ্তিটা রয়েই গেল। মনে হলো বিশাল ভৌগোলিক আয়তনের অচেনা চীনকে এত কম সময়ে চিনে নেওয়াটা কঠিনই বটে। চীনের তিনটি প্রদেশ ভ্রমণের সুযোগ পেলেও এখানকার গ্রাম বা গ্রামীণ জীবনটা আমাদের অজানাই থেকে গেল। বুলেট ট্রেনযোগে সাংহাই-বেইজিং, বেইজিং-সাংহাই যাওয়া-আসার পথে ট্রেনের জানালা দিয়ে কৃষি জমি আর গ্রামীণ জীবনের সামান্য আভাস দেখে এ সম্পর্কে কোন ধারণাই নিতে পারিনি। মনে পড়ছিল কৈশোরে পড়া পার্ল এস বাকের লেখা ‘গুড আর্থ’ উপন্যাসটির কথা, যে উপন্যাসটির উপজীব্য ছিল চীনের কৃষিনির্ভর জীবন। ‘গুড আর্থ’ উপন্যাসের বিপ্লব-পূর্ববর্তী চীনের সামন্ততান্ত্রিক কৃষিনির্ভর জীবন, কৃষিজীবী মানুষের চিরায়ত জীবন, তাদের আর্তনাদ, জমিদার শ্রেণির অত্যাচার, শোষণ এইসব চিত্রের সঙ্গে হয়তো আজকের চীনের কৃষক বা কৃষির কোনো মিলই নেই। সেই ছোটোবেলায় বাবার কাছ থেকে জেনেছিলাম মাও সেতুং ১৯১৭ সালে গণতান্ত্রিক বিপ্লব, ফেব্রুয়ারি বিপ্লব এবং অক্টোবর বিপ্লবের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পশ্চাদপদ চীনকে নেতৃত্ব দিয়ে জনগণকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করে নতুন চীন বিনির্মাণ করেছিলেন। কালক্রমে অনেক নীতি থেকে বিচ্যুত হলেও মাও সেতুংয়ের দেখানো পথেই যে চীন হেঁটে চলেছে এখনো পর্যন্ত এটা বলা যেতেই পারে। বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটলেও চীন এগিয়ে চলছে তার নিজস্ব গতিতেই।
১০.
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চীন যে অনেক বড়ো শক্তি সারা বিশ্বের কাছেই সে বিষয়টি সুস্পষ্ট। গত কয়েক দশকে বিপুল পরিমাণ দারিদ্র্য বিমোচন করে বিশ্বের মোড়ল আমেরিকাকে টেক্কা দিয়ে যাচ্ছে। এমন কোনো পণ্য নেই যা চীন তৈরি করতে পারে না- এ নিয়ে নানা হাস্যকৌতুক প্রচলিত থাকলেও ছোটোবেলা থেকেই জেনে এসেছি চা, কাগজ, ছাপাখানা, রেশমি বস্ত্র আবিষ্কারসহ খনি থেকে পেট্রোলিয়াম, কয়লা তোলা চীনারাই প্রথম শুরু করেছিল। অতি সাম্প্রতিক সময়ের আবিষ্কার ম্যাগনেটিক ট্রেন, বুলেট ট্রেন চীনের এগিয়ে চলার গতিকে যেন আরো বেশি ত্বরান্বিত করেছে। একুশ শতকের উন্নত এবং সমৃদ্ধশালী চীন দেখে মনে পড়ছিল রবীন্দ্রনাথের একটি ভবিষ্যৎ বাণীর কথা। ১৯১৬ সালে জাহাজযোগে ভারত থেকে জাপান ভ্রমণকালে হংকং-এ যাত্রাবিরতির সময় চীনা শ্রমিকদের কাজের উদ্যম, শৃঙ্খলা এবং একাগ্রতা দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘কাজের শক্তি, কাজের নৈপুণ্য এবং কাজের আনন্দকে এমন পুঞ্জীভূতভাবে দেখতে পেয়ে আমি মনে মনে বুঝতে পারলুম, এই বৃহৎ জাতির মধ্যে কতখানি ক্ষমতা সমস্ত দেশজুড়ে সঞ্চারিত হচ্ছে। চীনের এই শক্তি আছে বলেই আমেরিকা চীনকে ভয় করছে, কাজের উদ্যমে চীনকে সে জিততে পারে না, গায়ের জোরে তাকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়।’ ভাবছিলাম কতটাই না দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বিশ শতকের গোড়ায় বসে তিনি যে ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন কয়েক দশকের ব্যবধানেই তা বাস্তবায়িত হয়েছে। ‘পাবো সামান্যে কী তার দেখা’ আমার দেখা আর লেখায় অসামান্য কুনমিংয়ের বিপুল আর বিশাল সৌন্দর্যের সামান্যটুকুই হয়ত তুলে ধরতে পেরেছি। স্বল্প সময়ের স্বল্প অভিজ্ঞতায় যেটুকু দেখেছি কবিতার ভাষায় সেটুকু বলেই শেষ করছি- ‘যা দেখেছি, যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।’

মন্তব্য করুন