মন্ত্রিত্ব ছেড়ে নিভৃতে, তবুও ছিলেন তিনি দেশের পাশে, দশের সঙ্গে
সৈয়দ আবুল হোসেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দায়িত্ব পান যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের। পদ্মা সেতু প্রকল্পের শুরুর কাজটি তার হাত দিয়েই হয়। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ঋণদাতা গোষ্ঠী বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে ২০১২ সালে মন্ত্রিত্ব থেকে সরে দাঁড়ান সৈয়দ আবুল হোসেন। তবে বরাবরই তার দাবি ছিল— তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার।
সৈয়দ আবুল হোসেনের দাবি ভুল ছিল না। একটা সময় কানাডার আদালতেও প্রমাণ হয় সৈয়দ আবুল হোসেনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছিল সেগুলো সত্য নয়। বাংলাদেশেও দুদকের তদন্তে একই ফল আসে।
অনেক টানাপড়েনের পর বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক সরে গেলেও থেমে থাকেনি সেতু নির্মাণ প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় সিদ্ধান্তের ফলে পদ্মা সেতু নির্মিত হয় নিজস্ব অর্থায়নে। তবে সৈয়দ আবুল হোসেনের আর রাজনীতিতে ফেরা হয়নি।
স্বপ্নের সেতুটি সক্ষম বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি হিসেবে এখন বাস্তব। তবে গত ১১ বছর ধরে সৈয়দ আবুল হোসেন অনেকটাই দৃশ্যপটের বাইরে ছিলেন। দলের কোনো পদেও ছিলেন না এক সময়ের দাপুটে এই মন্ত্রী।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঠিক পাশে ছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। এর আগে পরে নিভৃতের এই কর্মযোগীকে তেমন একটা দেখা যায়নি।
কোথায়, কেমন আছেন সাবেক মন্ত্রী— নানা সময়ে ঢাকা টাইমস খোঁজখবর নিয়েছিল। দেশে-বিদেশে নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ব্যবসায়িক কাজে প্রায় থাকতেন দেশের বাইরে। মাঝেমধ্যে এসে ঘুরে যেতেন দেশে।
সবশেষ মঙ্গলবার দেশে ফিরেছিলেন মাদারীপুর-৩ আসনের সাবেক এ সংসদ সদস্য। তবে বিকালে হঠাৎ করেই অসুস্থ বোধ করেন। তাকে নেওয়া হয় ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখানেই রাত ২টার দিকে মারা যান দেশের অন্যতম এ বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী।
২০১২ সালে অভিযোগ তোলার পর এক বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, পদ্মা সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা না করায় তারা ঋণ স্থগিতের পদক্ষেপ নিয়েছে।
বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের তখনকার একজন কমিশনার। সেসময় তিনি ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের টিম দুদকে এসে কোনো তথ্য প্রমাণ না দিয়েই তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমানসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করতে চাপ দিতে থাকে।
তিনি আরও বলেন, ‘সেসময় বিশ্বব্যাংকের টিমটি দুই বার দুদকে আসে। তারা আমাদের বলে, আবুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তারা আরও দাবি করে, সেতু প্রকল্পের পরিচালকসহ অন্যদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিতে হবে এবং ফোর্সফুল ইন্টারোগেশন করতে হবে।’
‘আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে যেটা পেলাম সে অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক টিমকে জানানো হলো। দুদকের সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমাদের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু আমরা কোনো দুর্নীতির চিত্র পেলাম না।’
২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি দুদক এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি। অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য ও রেকর্ডপত্রের আলোকে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় অভিযোগটি পরিসমাপ্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এছাড়া কানাডার একটি আদালতও পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলায় কোনো সত্যতা না পাওয়ায় সবাইকে নির্দোষ ঘোষণা দেয়।
ব্যবসায়ী সৈয়দ আবুল হোসেন ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে পরপর চারটি সাধারণ নির্বাচনে মাদারীপুর-৩ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকারে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০২ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের ১৮তম জাতীয় সম্মেলনে আবারও তাকে দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের মুখে ২০১২ সালের ২৩ জুলাই মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। ২০১৩ সাল পর্যন্ত সংসদ সদস্য থাকলেও দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েন সাবেক এই মন্ত্রী।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন ও শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি দুর্যোগ-দুর্বিপাকেও সবসময় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। দেশে শিক্ষা বিস্তারে যারা কাজ করেছেন সৈয়দ আবুল হোসেন তাদের মধ্যে অন্যতম।
নিজস্ব অর্থায়নে তিনি নিজ এলাকা মাদারীপুরে ছয়টি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর মধ্যে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। এছাড়াও প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ ১৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরে সরকারিকরণ করা হয় এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
মাদ্রাসা ও মসজিদ নির্মাণেও করেছেন আর্থিক সহায়তা। নগদ টাকা, জমিসহ নানা সাহায্য-সহযোগিতা করায় দানবীর হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে তার। সরকারি অনুদানের বাইরেও নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করেছেন অসংখ্য রাস্তাঘাট-ব্রিজ। ব্যবসায়ের ব্যস্ততার মাঝেও তিনি করতেন লেখালেখি। নানা বিষয়ে লিখেছেন বেশ কিছু বই।
সমাজসেবা, উন্নয়ন ও শিক্ষায় অসামান্য অবদানে সৈয়দ আবুল হোসেন শেরে-বাংলা পদক, অতীশ দীপঙ্কর পদক এবং মোতাহার হোসেন পদকসহ এ পর্যন্ত ২৩টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
আরও পড়ুন>দেড় শতাধিক বিদ্যালয় ও ছয়টি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন সৈয়দ আবুল হোসেন
(ঢাকাটাইমস/২৫অক্টোবর/ডিএম)