ঢাকা টাইমসকে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিল

যুদ্ধের ক্যাম্পে পরিবারের কারও কথা মনে ছিল না

জাফর আহমেদ, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৮:৪৩| আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৩৭
অ- অ+

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বাঙালির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। যুদ্ধে আমাদের একটাই শপথ ছিল, এ দেশকে যেকোনো মূল্যে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র করতে হবে। যুদ্ধে যাওয়ার পর স্বাধীনতার নেশায় স্ত্রী, সন্তান পরিবারের কারও কথা মনে ছিল না, শুধু একটা শব্দ মনে ছিল স্বাধীনতা।

গতকাল রবিবার একান্ত আলাপচারিতায় ঢাকা টাইমসকে এসব কথা বলেন বিমানবাহিনীর সাবেক সার্জেন্ট, আগরতলা মামলার ২৯ নম্বর আসামি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা (সার্জেন্ট বিমানবাহিনী) আবদুল জলিল।

বর্ষীয়ান এই সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা আলোকপাত করেছেন স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ও আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে। তাঁর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্ব ও বলিষ্ঠ ভূমিকা।

২০ মার্চ, ১৯৩৫ তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতে নারায়ণগঞ্জ মহকুমার অধীনস্থ নরসিংদীর রায়পুরা থানার (বর্তমানে বেলাবো উপজেলা) সল্লাবাদ ইউনিয়নের সররাবাদ (দক্ষিণ পাড়া) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল জলিল।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিল বলেন, দেশ যে উদ্দেশ্যে স্বাধীন হয়েছে, সেটা হচ্ছে না। এখন দেশের সকল ক্ষেত্রে ঘুষ-বাণিজ্য হচ্ছে। আমি একটা কথা বলতে চাই, আমরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলাম সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। এখন যতটা মুক্তিযোদ্ধারা ভালো আছে কিন্তু যারা স্বাধীনতা চাননি তাদের হাতে দেশ গেলে কচুকাটা করবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকবে না। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নয়, তারা মুক্তিযুদ্ধের শত্রু। এদেশে তাদের ভোটারাধিকার বন্ধ করা উচিত। এটা করে গেলে ভালো হতো। স্বাধীন দেশের মানুষকে নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে হবে। আজকে যারা বাসে আগুন দিচ্ছে, জ্বালাও-পোড়াও করছে তাদের কারণে দেশের মানুষ নিরাপত্তাহীনতায়ও আছে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, বিজয়ের মাস আসলে খুব আনন্দ হয়। এ মাস আসলে স্বাধীনতার স্বাদ পাই। দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন যে কি আনন্দ পেয়েছিলাম বলে বুঝাতে পারবো না। ডিসেম্বর মাস আসলেই সেই আনন্দ বিজয়ের উল্লাসের কথা মনে পড়ে। নতুন প্রজন্মের জন্য বইয়ে ঠিকমতো স্বাধীনতার বাণী, চিত্র, ইতিহাস দেওয়া হয় না। তাদের জন্য স্বাধীনতার বাণী পৌঁছানো হয় না।

যুদ্ধের সময়ের শপথের কথা উল্লেখ করে এই মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা যখন যুদ্ধে যাই তখন একটাই শপথ ছিল, এদেশেকে যেকোনো মূল্যে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করা। পাকিস্তানি শোষণ থেকে মুক্ত করে বাঙালিদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। যুদ্ধে যাওয়ার পর স্ত্রী, সন্তান পরিবারের কারও কথা মনে ছিল না। শুধু একটা শব্দ মনে ছিল দেশ স্বাধীন করা।’

আবদুল জলিল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ইশারা পেয়ে আমরা আগে থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ছিলাম কিন্তু তার চূড়ান্ত অনুমতির অপেক্ষায় ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে। আমি ছিলাম কিশোরগঞ্জে, সেখান থেকে নেত্রকোণা দিয়ে কলকাতায় যাই।’

তিনি বলেন, ‘আইয়ুব খানের সঙ্গে ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচন হয়। তখন থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন আমরা (বাঙালিরা) ফাতেমা জিন্নাহর জন্য নির্বাচনে কাজ করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু যখন করাচি যেতেন তখন আক্তার সোলেমানের বাসায় থাকতেন। কিন্তু যখনি শুনতাম বঙ্গবন্ধু আসছেন তখনি তার সঙ্গে দেখা করতাম।’

বঙ্গবন্ধুর কোন স্মৃতিগুলো আপনার বেশি মনে পড়ে এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল জলিল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যখন আমরা স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নেই, তখন অনেকেই বলেছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বেশিদিন টিকবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর একটা কথা ছিল বাঙালিদেরকে পাকিস্তানি শোষণ থেকে মুক্ত করতে হবে। করাচিতে যেসব বাঙালি ছিল তাদের কাছে স্বাধীনতার কথা, যুদ্ধের কথা বললে ভয়ে কাঁপতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এতো সাহসী ছিলেন যে তিনি স্বাধীনতার জন্য তার চেষ্টা অব্যাহত রাখতেন।’

তিনি বলেন, ‘১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধুকে যখন করাচি নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। সুলতান উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে বেগম আক্তার সোলেমানের বাসা থেকে আনার জন্য। যাতে কেউ বুঝতে না পারে সেজন্য একাধিক গাড়ি পাল্টে পাল্টে তাকে নিয়ে আসা হয়। তখন আমরা তার সঙ্গে মিটিং করি। বঙ্গবন্ধু একটা কথা বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সবকিছুর সঙ্গে আছি। যত রকম সাহায্য লাগে আমি করবো। হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে আমার বাসায় প্রশিক্ষণ নেই। আমি একজন বিমানবাহিনীর অফিসার হয়েও দেশ স্বাধীন করার পরিকল্পনা করি, এতথ্য লিক হলে আমার ফাঁসি, এটার জন্য আরও ভয়ে ছিলাম। একটি নির্দিষ্ট রাতে নির্দিষ্ট সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সবকটি ক্যান্টনমেন্টে আচমকা আক্রমণ চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র দখল করে পাকিস্তানিদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের বন্দি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার কথা ছিল। তবে বিশ্বাসঘাতকের মাধ্যমে পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার সূত্রপাত ঘটে।’

আবদুল জলিল বলেন, ‘১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি দুজন বাঙালি সিএসপি কর্মকর্তাসহ ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে এর আগে গ্রপ্তার করা হলেও আমাদের কয়েকদিন পর (১৮ জানুয়ারি) একই অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানকেও গ্রেপ্তার দেখানো হয় ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য। তবে এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবেই বেশি পরিচিত। আমরা যে জেলে ছিলাম বঙ্গবন্ধু সেই জেলেই ছিল কিন্তু জানতাম না বঙ্গবন্ধু আমাদের পাশের রুমেই আছেন। তাই বাথরুমে গেলে নাম লিখে আসতাম আমি অমুক..। এভাবে আমরা জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুসহ অনেকেই এই জেলে আছে।’

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি স্মরণ করে এই মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিল বলেন, ‘জেলে থাকাকালীন আমার শাশুড়ি পিঠা বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন কিন্তু সেখান থেকে আমি একটা পিঠা বঙ্গবন্ধুর জন্য রেখে দেই। যখন আমাদের জেল থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন বঙ্গবন্ধুকে পিঠা দিলাম বঙ্গবন্ধু বলেন সবাইকে দিয়েছো। সবাই না খেলে আমি খেতে পারি না। একটা পিঠার সামান্য কিছু খেয়ে বাকিটা সবাইকে দেন। এটা হলো আমাদের বঙ্গবন্ধু।’

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি এখনো কতজন বেঁচে আছেন? জবাবে আবদুল জলিল বলেন, ‘এখনও তিনজন বেঁচে আছেন--নূর মোহাম্মদ (অভিযুক্ত নম্বর ৫), কর্নেল সামছুল আলম, আবদুল জলিল।

আপনি যখন বিমানবাহিনীতে থেকে ভেতরে ভেতরে স্বাধীনতার জন্য জনমত সৃষ্টি করেছিলেন তখন জিয়াউর রহমানের কোনো ভূমিকা ছিল?

জবাবে আবদুল জলিল বলেন, এই সময় জিয়াউর রহমানের কোনো ভূমিকা ছিল না। তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। জিয়াউর রহমান নামে তখন আমরা কাউকে চিনতাম না।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার এমন কোনো স্মৃতি আছে যা এখনো খুব মনে পড়ে? এ প্রশ্নের জবাবে আবদুল জলিল বলেন, ‘আমার এলাকার একজন একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্বাধীনতার পূর্ব থেকে চেষ্টা করে আসছিল কিন্তু মঞ্জুরি নিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কিছুদিন আগে আমি কলেজের বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে সবাইকে বাইরে বের করে দিয়ে আমার সঙ্গে একা কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন জলিল তুমি এমএ পাস কলেজ করিও না, টেকনিক্যাল কলেজ করো যত টাকা লাগে আমি দেব। এমএ পাস করে এসব ছাত্র জাতির জন্য এবং নিজের জন্য তেমন কিছু করতে পারবে না। কিন্তু টেকনিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে বের হলে নিজেরা কিছু করতে পারবে, জাতির জন্য কিছু করতে পারবে, এমনকি বিদেশে গিয়েও ভালো কিছু করতে পারবে। তখন বাংলাদেশে একটাও টেকনিক্যাল কলেজ হয়নি।’

তখন যদি টেকনিক্যাল কলেজ করতাম তাহলে এটা হতো বাংলাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কলেজ। বঙ্গবন্ধু বলছিলেন, লুলা ল্যাংড়া পাস করিয়ে লাভ নেই, টেকনিক্যাল করো, ইঞ্জিনিয়ার বানাও, দক্ষ জাতি তৈরি করো এই কথাটা খুব বেশি মনে পড়ে।

(ঢাকাটাইমস/০৪ডিসেম্বর)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি আজ সরাসরি সম্প্রচার
১৮ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিরোধ দিবস
‘জুলাই বললে লাল হয়ে যায় স্মৃতি’: প্রেস সচিব শফিকুল আলম শেয়ার করলেন নিউটনের কবিতা দিয়ে
শহীদের রক্ত, বিপ্লব সমুন্নত হোক: আসিফ মাহমুদ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা