মিগজাউমের প্রভাবে বৃষ্টি
বিভিন্ন স্থানে ফসলের ক্ষতি

ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের প্রভাবে সারা দেশেই চলছে বৃষ্টিপাত। বুধবার মধ্যরাত থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে বিরতিহীন বৃষ্টি। এই বৃষ্টির প্রভাবে সরিষা, আলু, ধান ও পেঁয়াজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। তবে কৃষি অফিস বলছে বৃষ্টিতে মাটির রসের জন্য উপকারী হবে। ভারী বৃষ্টি হলে ব্যাপক ক্ষতি হবে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মিগজাউম ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলে আঘাত করেছিল গত মঙ্গলবার। এর প্রভাবে এমন বৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে ঘূর্ণিঝড়ে ফসলের ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হল-
সালথা-নগরকান্দা (ফরিদপুর): ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের প্রভাবে বিরতহীন বৃষ্টিপাতের কারণে ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। তবে কৃষি অফিস বলছে, মাঠে জমে যাওয়া বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে গেলে ফসলের তেমন ক্ষতি হবে না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার বিভিন্ন মাঠের বেশিরভাগ ফসলি জমিতে বৃষ্টির পানি জমে রয়েছে। এতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ ও পেঁয়াজের বীজতলা তলিয়ে গেছে। কিছু এলাকায় ধানের ক্ষেতও তলিয়ে যেতে দেখা গেছে।
ভাওয়াল ইউনিয়নের পুরুরা সাধুপাড়া গ্রামের কৃষক শরৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, গত বুধবার দিনভর শ্রমিক দিয়ে আমি একবিঘা জমিতে হালি পেঁয়াজ রোপণ করেছি। ওইদিন রাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত টানা বৃষ্টিতে আমার পেঁয়াজ ক্ষেত তলিয়ে গেছে। স্যালো মেশিন দিয়ে জমির পানি নামানোর চেষ্টা করছি। এতে পেঁয়াজের গাছ পঁচে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মো. ওমর মোল্যা নামের আরেক কৃষক বলেন, আমার পৌনে একবিঘা জমির পেঁয়াজের বীজতলা তলিয়ে গেছে। দ্রুত ক্ষেতের পানি না শুকালে বীজতলার চারা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে ২৬ শতাংশ জমির পাকা ধান কেটে ক্ষেতে রাখি। টানা বৃষ্টির পানিতে ওই ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় কাটা ধান ঘরে তুলতে পারছি না।
আটঘর ইউনিয়নের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, হালি পেঁয়াজের চারা রোপণের জন্য দুই বিঘা জমি চাষ দিয়ে সাজিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু বৃষ্টির পানি জমে যাওয়ায় ক্ষেতের মাটি সমান হয়ে গেছে। এখন পানি শুকানোর পর নতুন করে জমি চাষ করে পেঁয়াজের চারা রোপণ করতে হবে।
সালথা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সুদর্শন শিকার ঢাকা টাইমসকে বলেন, উপজেলায় এবার ১২০ হেক্টর জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ করা হয়েছে। পেঁয়াজের বীজতলা আবাদ করা হয়েছে ৭৬০ হেক্টর জমিতে। এসব মুড়িকাটা পেঁয়াজ ও পেঁয়াজের বীজতলার বেশিরভাগ ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ক্ষেতের পানি দ্রুত নামিয়ে ফেলতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যদি আর বৃষ্টি না হয়, তাহলে তেমন ক্ষতি হবে না। আর বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে ফসলের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
হরিরামপুর (মানিকগঞ্জ): ঘূর্ণিঝড় মিগজাউম ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলে আঘাত করেছিল গত মঙ্গলবার। এর প্রভাবে সারা দেশেই চলছে বৃষ্টিপাত। মানিকগঞ্জেও বুধবার মধ্যরাত থেকেই চলছে বিরতিহীন বৃষ্টি। এই বৃষ্টির প্রভাবে হরিরামপুর উপজেলায় ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। অসময়ে বৃষ্টিতে ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষক। উপজেলায় সরিষাসহ অন্যান্য রবি শস্যের মারাত্মক ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। টানা বৃষ্টির কারণে দুর্গম চরাঞ্চলসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সদ্য বেড়ে উঠা সরিষা গাছগুলো মাটিতে নুয়ে পড়েছে। অনেক এলাকার কিছু কিছু জমিতে নব্য ফোটা সরিষার ফুলও ঝরে পরেছে। ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছে উপজেলার শতশত কৃষক। তবে কৃষি অফিস বলছে মৃদু বৃষ্টিতে মাটির রসের জন্য উপকারী হবে। ভারী বৃষ্টি হলে ব্যাপক ক্ষতি হবে। কৃষকরা জানান, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি দীর্ঘ সময় চলতে থাকলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হবে। সরিষার গাছগুলো বৃষ্টির কারণে নুয়ে পড়েছে। ফুল ও ফল নষ্ট হতে পারে। এদিকে সরিষা ফুলকে কেন্দ্র করে মধুচাষেও পড়েছে বিপর্যয়। মধুচাষিরাও রয়েছে ক্ষতির আশঙ্কায়। আজিমনগর ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামের চাষি লতিফ পাল বলেন, আমি এবছর ২০০ শতাংশ জমিতে সরিষা আবাদ করেছি। অসময়ে বৃষ্টির ফলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। আজও যদি বৃষ্টি থাকে তাহলে যে জমিতে ফুল এসেছে সেই জমির ফুল গুলো নষ্ট হয়ে যাবে। যদি রোদ উঠে তাহলে ক্ষতি কম হবে। একই এলাকার শহিদ বেপারী বলেন, আমি এবছর ১৫০ শতাংশ জমিতে সরিষা আবাদ করেছি। বৃষ্টি হওয়ায় অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। সরিষা গাছগুলো বৃষ্টির জন্য পরে গেছে। উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের ডেগিরচর গ্রামের শেখ মাসুম বলেন, বৃষ্টিতে সরিষা ক্ষেতের অধিকাংশ সরিষা গাছই মাটিতে শুয়ে পড়েছে এবং ক্ষেতে পানিও জমে গেছে। এর ফলে এবছর সরিষার মারাত্মকভাবে ক্ষতি হবে। গালা ইউনিয়নের আলমদী গ্রামের মোবারক আলী জানান, আমি দুই বিঘা সরিষার চাষ করছি। কিন্তু বৃষ্টির কারণ গাছগুলো শুয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেতে পানি ও জমে গেছে। গাছ উঠে দাঁড়াতে না পারলে গাছ পচে যাবে। এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. তৌহিদুজ্জামান খান বলেন, হরিরামপুর উপজেলায় এ বছর ১১ হাজার ৬৪৫ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে। মাটিতে রসের কিছুটা অভাব ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে চলমান বৃষ্টিতে সরিষা, ভুট্টা, পেয়াজসহ কিছু ফসলের জন্য উপকারী হবে। তবে যদি এই বৃষ্টির প্রভাবে মাঠে পানি জমে যায় তাহলে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, মাঠে আমাদের কর্মীরা ফসলের খোঁজখবর নিচ্ছেন। তারা তথ্য সংগ্রহ করছেন। কোথাও কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা এখনো দেখছি না।
গজারিয়া (মুন্সীগঞ্জ): মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় টানা বৃষ্টিতে আলুর আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোপণকৃত আলুর বীজ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককরা হাজার হাজার টাকা ধার দেনা করে লোকসানের আশঙ্কায় হতাশ হয়ে পড়েছেন। বৃষ্টিতে আলু চাষিদের স্বপ্ন পানিতে ভেসে গেছে বলে দাবি তাদের। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সঙ্গে কথা বললে এমনটাই জানান তারা। সরেজমিনে দেখা যায়, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে চাষিরা তাদের ফসল রক্ষার্থে পানি সরানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আলু চাষি জহিরুল ইসলাম জানান, তিনি ৫ দিন আগে আলুর বীজ রোপণ করেছেন। সবগুলো আলু ক্ষেতেই পানি জমে যায়। এ অবস্থায় রোপণ করা বীজ আলু নষ্ট হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
টেঙারচর গ্রামের কৃষক ইউসুফ মোল্লা জানান- বৃষ্টিতে তার রোপণ করা আলুর জমিতে পানি জমে গেছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে তার জমির সব আলুই পঁচে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
কৃষক আলি হোসেন, ইসহাক আলীসহ অনেকে জানান, ধার দেনা করে জমিতে আলু চাষ করেছেন তারা। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ নিচু জমি। তবে আগামীতে আর কোনদিন আলু ক্ষেত করবেন না তার।
গজারিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ফয়সাল আরাফাত বিন সিদ্দিক জানান, উপজেলায় এবার আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৯৮৬ হেক্টর জমিতে। এরই মধ্যে এ উপজেলায় প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমিতে আলু রোপণ করা হয়ে গেছে। বৃষ্টির কারণে আলু নষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে আলুর জমি পরিদর্শন শেষে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান বলা যাবে বলে জানান তিনি।
(ঢাকাটাইমস/০৯ডিসেম্বর/ইএইচ)

মন্তব্য করুন