ঝিনাইদহে মাছে ভরা বাঁওড় ইজারা, উপার্জন বঞ্চিত ৫ হাজার জেলে

মো. শাহানুর আলম, ঝিনাইদহ
 | প্রকাশিত : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ২১:২৭

‘জাল যার জলা তার’ নীতি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় বলুহরসহ প্রায় সকল বাঁওড়েই প্রবেশাধিকার হারিয়েছেন ঝিনাইদহের ৫টি বাঁওড় ও যশোরের একটি বাঁওড়পাড়ের ৫ হাজার জেলে। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে নিজেদের মতো করে বাঁওড় ভোগদখল করা জেলেরা আজ বেকার। সরকারিভাবে বাঁওড় ইজারা দেওয়ায় উপার্জন বঞ্চিত হয়েছেন তারা। ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ৫ হাজার জেলেসহ তাদের পরিবারের প্রায় ২৫ হাজার সদস্যের জীবন।

ভূমি মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের ২০ মার্চ প্রথম বলুহর বাঁওড়টি মৎস্য বিভাগের কাছে নবায়ন না করে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ইজারা দেয়।

এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে বলুহর বাঁওড় পাড়ের জেলেরা। প্রভাবশালীদের কাছে দেওয়া ইজারা বাতিল করে বাঁওড়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সংগঠিত হন তারা। কিন্তু কেউ শোনেনি তাদের আর্তি। নিশ্চুপ ছিলেন জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজ।

বাধ্য হয়ে ক্ষুধা আর ক্ষোভ নিয়ে বাঁওড় থেকে জেলেরা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে গিয়েছেন রাজধানীতে। গত বছর ২৮ মে ঢাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। জানিয়েছেন তাদের কষ্টের কথা। আকুতি করেছেন বাঁওড়ের ইজারা বাতিল করে তাদের জীবিকা নির্বাহের পথ খোলা রাখার জন্য।

কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। এরই মধ্যে বাকি ৫টি বাঁওড়ও ইজারা দেয়া হয়েছে। ফলে বলুহর বাঁওড়সহ ৬টি বাঁওড় পাড়ের ৬ হাজার জেলে তাদের পেশা হারিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে নিমজ্জিত হন। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে তারা এখন দিশেহারা।

জানা যায়, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বলুহর ও জয়দিয়া, মহেশপুরের কাঠগড়া ও ফতেপুর, কালীগঞ্জের মর্জাদ এবং যশোরের একটিসহ মোট ছয়টি বাঁওড়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মৎস্য অধিদপ্তরের চুক্তির মাধ্যমে ১৯৭৯ সাল থেকে বিল বাঁওড় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে মাছ চাষ শুরু হয়। এসব বাঁওড়ে সুবিধাভোগী ছিলেন বাঁওড় পাড়ের জেলেরা।

১৯৮৬ সাল থেকে বাঁওড়টি রাজস্ব খাতে পরিচালিত হচ্ছে। এর পর আরও কয়েক দফা চুক্তি বৃদ্ধি করে ভূমি মন্ত্রাণালয়। এখানে উৎপাদিত মাছের ৩৫ শতাংশ পেত মৎস্য অধিদপ্তর, ভূমি মন্ত্রাণালয় ২৫ শতাংশ এবং জেলে সম্প্রদায় পেত ৪০ শতাংশ। প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত রানি মাছের শতভাগই পেত বাঁওড় পাড়ের জেলেরা।

সর্বশেষ ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মৎস্য মন্ত্রণালয়ের চুক্তির মেয়াদ ছিল এপ্রিল ২০২৩ সাল পর্যন্ত। কিন্তু ভূমি মন্ত্রাণালয় চুক্তি বৃদ্ধি না করে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এই বাঁওড়গুলোর ইজারা প্রক্রিয়া শুরু করে। প্রক্রিয়া শেষে এপ্রিলে ইজারাদারদের বাঁওড় বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

বাঁওড় পাড়ের জেলেরা কেমন আছে জানতে সরেজমিনে কোটচাঁদপুর জয়দিয়া বাঁওড় পাড়ে গিয়ে দেখা যায় বাঁওড়ের ঘাটে প্রচুর জেলে ও তাদের পরিবারের লোকজন অসহায়ত্ব নিয়ে বাঁওড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সাংবাদিক দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

জয়দিয়া বাঁওড় ও মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি শীতল কুমার হালদার বলেন, সংসার টানতে পারছি না। বাঁওড় ইজারা দেওয়ায় আমরা পথে বসে গেছি। আমার বাবা ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে এই বাঁওড় থেকে মাছ ধরে সংসার চালিয়ে আমাদেরকে বড় করেছেন। বাবা তিন বছর আগে গত হয়েছেন। আমরা বাঁওড় পাড়ের জেলেরা বাঁওড়ের মাছ ধরেই সংসার চালিয়ে আসছিলাম।

এখন ইজারাদাররা আমাদেরকে বাঁওড়ে নামতে দেয় না। কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। আমাদের আত্মহত্যা ছাড়া উপায় দেখছি না।

বলুহর বাঁওড় ও মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি গোপাল হালদার বলেন, আমরা বাঁওড় পাড়ের মৎস্যজীবীরা কর্মহীন হয়ে গেছি। বাবা-দাদারা এ বাঁওড় থেকে মাছ ধরেই সংসারের খরচ যোগাতেন। আমরাও একই পেশাতে ছিলাম। সরকার বাঁওড় ইজারা দেওয়ায় আমরা পথে বসে গেছি। সব বাঁওড় পাড়ের জেলে সম্প্রদায়ের একই অবস্থা বলেও জানান তিনি।

ফতেপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি শান্তি হালদার বলেন, আমরা ধার দেনা করে বাঁওড়টি ইজারা নিয়েছি। মাছ ছেড়েছি, কপালে কি আছে বলতে পারছি না।

জয়দিয়া বাঁওড়ের মৎস্যজীবীদের সাবেক দলপতি নিত্য হালদার বলেন, বাঁওড় পূর্বের ন্যায় ফিরে পেতে ৫ বাঁওড় পাড়ের মৎস্যজীবীদের পক্ষ থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

মামলাটি হাইকোর্টে চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় আছে। তারপরও ইজারাদাররা বাঁওড় পাড়ের জেলেদের মারধর করে জোরপূর্বক মাছ ধরছেন।

যশোর বিল বাঁওড় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. আলফাজ উদ্দীন শেখ বলেন, বাঁওড় গুলি আমাদের আওতায় ৪২ বছর ছিল। সে সময় বাঁওড় পাড়ের জেলেদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করে গেছে এ প্রকল্পটি। পাশাপাশি পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঁওড়ের বড় মাছের চাষ ও দেশীয় ছোট মাছের প্রজনন ঘটিয়ে নানা প্রজাতির মাছের চাহিদা মেটাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সক্ষম হয়েছে প্রকল্পটি। বাঁওড়টি রাখার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। বাঁওড় গুলি ভূমি মন্ত্রণালয় ইজারা দিয়েছে। যে কারণে বাঁওড় পাড়ের জেলেরা বেকার হওয়ার পাশাপাশি বাঁওড় সংশ্লিষ্ট ১৩০ থেকে ১৪০ জন দৈনিক মুজুরি ভিত্তিক কর্মীও বেকার হয়ে গেছে। বর্তমানে বাঁওড় কেন্দ্রিক কিছু করার নেই বলেও জানান তিনি।

বলুহর বাঁওড় ম্যানেজার সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমরা বাঁওড় গুলিতে মাছ চাষ করতাম মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। মাছ ধরার সময়ও নির্ধারণ করা থাকতো।

ফলে বিপন্ন প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি রক্ষা পেত জীব বৈচিত্র্য।

বর্তমানে ইজারাদাররা এ বিষয়ে যত্নশীল না হয়ে অধিক মুনাফার লোভে কৃত্রিম উপায়ে মাছ চাষ করছেন। যখন তখন মাছ ছাড়ছেন এবং ধরছেন। যে কারণে দেশীয় মাছ ও জীববৈচিত্র্য বাঁওড় গুলি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় অনেকে অভিযোগ করে বলেন, কোটচাঁদপুর বলুহর বাঁওড় সংলগ্ন সরকারি মৎস্য হ্যাচারি কমপ্লেক্সসহ অন্যান্য বাঁওড় গুলির আশপাশে আবাদি জমির পানি স্যালো মেশিনের মাধ্যমে বাঁওড় থেকে নেওয়া হতো। বর্তমানে ইজারাদাররা বাঁওড় থেকে পানি নেওয়া বন্ধ করতে বিভিন্ন ফন্দি ফিকির করছেন।

স্থানীয় চাষিরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, বাঁওড় থেকে পানি নেওয়া বন্ধ করে দিলে শত শত একর জমির চাষ বাধা গ্রস্ত হবে। অন্যদিকে সরকারি মৎস্য হ্যাচারি কমপ্লেক্সও পানি সংকটে পড়বে বলে জানান তারা।

বলুহর বাঁওড় ইজারা পাওয়া কোটচাঁদপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি শীতল হালদার বলেন, বাঁওড় থেকে কেউ যেন পানি উত্তোলন করতে না পারে সেজন্য জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করেছি।

কোটচাঁপুর বলুহর বাঁওড় পাড়ের কৃষক রেজাউল ইসলাম জানান, বাওড়ের ধারেই আমার সাড়ে ৪ বিঘা জমি। আমি শুকনা মৌসুমে শ্যালো মেশিন দিয়ে বাওড়ের পানি এনে চাষাবাদ করতাম। বর্তমানে ইজারাদাররা পানি নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

বাঁওড় পাড়ের আরেক কৃষক ফারুক হোসেন জানান, আমার বাপ দাদারা এই বাঁওড়ের পানি দিয়ে চাষাবাদ করেছে। ইজারা দেওয়ার পর ইজারাদারের লোকজন বাঁওড় থেকে পানি নিতে দিচ্ছে না। এখন কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক এসএম রফিকুল ইসলাম বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছিল। সেই সমঝোতা স্মারক বলেই বাঁওড়গুলো পরিচালনা করা হতো। বাংলা ১৪২৯ সালে এই স্মারকের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ভূমি মন্ত্রণালয় মৎস্য প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে ভূমি মন্ত্রণালয় ইজারা দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করে। দরপত্রের মাধ্যমে যারা ইজারা পেয়েছেন আমরা তাদেরকে বাঁওড়গুলো বুঝিয়ে দিয়েছি। ইজারা দেওয়ার পর বাওড়ের সুবিধাভোগীরা তাদের কষ্টের কথা জানিয়ে একটি স্মারক লিপি দিয়েছেন। আমি সেই স্মারক লিপি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দেবে আমরা সেই আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

(ঢাকাটাইমস/১৫জানুয়ারি/প্রতিনিধি/পিএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

সারাদেশ এর সর্বশেষ

হরিরামপুর উপজেলা নির্বাচন: সম্পদে ছাত্রলীগ নেতা, মামলায় এগিয়ে বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা

তরুণীকে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা না দেওয়ায় স্বামী জেলহাজতে

সরাইলে অটোরিকশা চোর চক্রের ৩ সদস্য গ্রেপ্তার

গজারিয়া নিখোঁজের দুই দিন পর নদী থেকে যুবকের লাশ উদ্ধার 

কোম্পানীগঞ্জে ইউপি সদস্য পদে উপনির্বাচন  সম্পন্ন

গজারিয়ায় ডাকাত রাসেল গ্রেপ্তার 

রাষ্ট্রের সকল জনগণের ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে: আমু 

অসুস্থ বাবাকে দেখতে চাওয়ায় স্ত্রীকে খুন করলো স্বামী

সিরাজদিখানে তীব্র গরমে শ্রেণিকক্ষে অসুস্থ ৬ শিক্ষার্থী 

পটুয়াখালীতে খালে ভেসে এলো অচেনা বস্তু, ধারণা ‘টর্পেডো’

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :