দেশের স্বাস্থ্যসেবায় নৈরাজ্য কাম্য নয়

অনলাইন ডেস্ক
| আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ১৩:১৪ | প্রকাশিত : ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ১৩:১০

সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার একটি হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে আয়ান নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এটি দুর্ঘটনা নাকি দায়িত্বে অবহেলা- সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তা হয়তো বেরিয়ে আসবে। কিন্তু শিশু আয়ান আর ফিরে আসবে না। অতীতে আয়ানের মতো আরও অনেকেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। চিকিৎসাধীন কারো মৃত্যুর ক্ষেত্রে চিকিৎসক কিংবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি ছিল কি না- সেটা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায়। ভিকটিম আইনের আশ্রয় নিলে আদালতকেও বিষয়টি আমলে নিতে হয়। আয়ানের পরিবার আইনের আশ্রয় নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বিষয়টি আমলে নিয়েছে। আয়ানের পরিবারকে পাঁচ কোটি টাকা কেনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না- জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে দেশের সব অনুমোদিত ও অননুমোদিত হাসপাতাল-ক্লিনিকের তালিকা এক মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। হাইকোর্টের এ পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন কতটা হবে- এ নিয়ে জনমনে সন্দেহ থেকেই যায়। আর একটি বিষয় হলো ভুক্তভোগী সবাই আদালত পর্যন্ত যেতে পারেন না কিংবা যান না।

দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে সরকার প্রতিবছর বিরাট অঙ্কের টাকা বরাদ্দ দিয়ে থাকে। সাধারণ মানুষ যাতে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবা পেতে পারে তার জন্য সরকারের রয়েছে নানা পদক্ষেপ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের সফলতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত হয়েছে। টিকাদান কর্মসূচির সফলতায় সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে। করোনা মহামারির সময় ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনায় সরকারের সাফল্য অনেক দেশের তুলনায় সন্তোষজনক। এসব সফলতা সত্ত্বেও দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। সব অভিযোগ ভিত্তিহীন- এমন কথা বলারও সুযোগ নেই। দেশের অনেক সরকারি হাসপাতালে, বিশেষ করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে নিয়মিত ডাক্তার বসেন না কিংবা বসলেও পর্যাপ্ত সময় দেন না। সরকারি হাসপাতালে রোগীরা তাদের অনেক প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে পারে না। এক্ষেত্রে বিপুল অঙ্কের টাকায় কেনা যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়ে থাকার অভিযোগ শোনা যায়। প্রয়োজনীয় ঔষধও পাওয়া যায় না। অথচ হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ঔষধ সরবরাহ করা হয়। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতির জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের কিছু অসাধু ব্যক্তি জড়িত থাকে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে, শহরের অলিতে গলিতে গজিয়ে ওঠা নিবন্ধিত কিংবা অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মূল উদ্দেশ্য বাণিজ্য করা। এসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ডাক্তারগণ মালিক পক্ষের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করে চলেন। এর ফলে অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দেন অসহায় রোগীদের কাঁধে। প্রায়ই এমন দেখা যায় যে, কোনো একটি পরীক্ষার সাম্প্রতিক রিপোর্ট রোগীর কাছে থাকা সত্ত্বেও সেই পরীক্ষা আবার নতুন করে করিয়ে নেন এক শ্রেণির ডাক্তার। এরা অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দিয়ে শুধু ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্বার্থ রক্ষা করেন না, অতিরিক্ত ঔষধ লিখে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর স্বার্থও রক্ষা করেন। বিনিময়ে ডাক্তার নিজেও লাভবান হন। কিন্তু রোগীরা হন ক্ষতিগ্রস্ত। ডাক্তারের ভিজিটের টাকা, টেস্টের টাকা, ঔষধ কেনার টাকা- এই তিন দফায় টাকার জোগান দিতে গিয়ে একজন রোগী নিঃস্ব হয়ে পড়েন। এ বাস্তবতা থেকেই মানুষ এখন মানবসেবায় নিয়োজিত ডাক্তারদেরকে ‘কসাই’ বলা শুরু করেছে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশে চিকিৎসার খরচ যে হারে বেড়েছে চিকিৎসা সেবার মান সে হারে বাড়েনি। ফলে মানুষের মধ্যে চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এক সময় দেশের অতি ধনাঢ্য ও বিশিষ্ট লোকেরাই চিকিৎসা নিতে বিদেশে যেতেন। এখন সাধারণ মানুষও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে চিকিৎসা নিয়ে আসা রোগীদের কাছে শোনা যায়, দেশের নামি-দামি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে যে পরিমাণ খরচ হয় ভারতের নামি-দামি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে তার চেয়ে বেশি খরচ হয় না। কিন্তু সেখানে সেবার মান অনেক ভালো। এ ধরনের কথায় রোগীরা দেশের চিকিৎসাসেবার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। একটু কষ্ট করে হলেও বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে। অন্তত কলকাতা, ভেলোর, মুম্বাই, মাদ্রাজ, চেন্নাই তো যায়-ই। এতে একদিকে দেশের চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে আস্থার সংকট তৈরি হয় অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যায়।

চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় একজন রোগীর মৃত্যু হতেই পারে। রোগের ধরন ও পর্যায় অনুযায়ী কেউ সুস্থ হয়ে ওঠেন। আবার কাউকে কোনোভাবেই সুস্থ করে তোলা যায় না। অনিবার্য বিষয়গুলো মেনে নিতেই হয়। কিন্তু ভুল চিকিৎসা কিংবা চিকিৎসকের গাফিলতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। দেশে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা প্রায়ই ঘটে। গণমাধ্যম সূত্রে দেশবাসী জানতে পারে সেসব মৃত্যুর খবর। চিকিৎসক ও তাঁদের সহযোগীদের গাফিলতির চরম রূপ দেখা গেছে অপারেশনে রোগীর পেটে কাঁচি কিংবা গজ কাপড় রেখেই সেলাই করার ঘটনায়। রোগ নির্ণয় করার ক্ষেত্রে ভুল হওয়া কিংবা ভুল ঔষধ প্রয়োগের ফলে রোগীর মৃত্যুর খবর শোনা যায় মাঝে মাঝেই। প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুর খবরও শোনা যায়। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর প্রতিক্রিয়াও কম নয়। অতীতে অনেক সময় এ ধরনের মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখা গেছে। তারপরও সেবাখাতের অসাধু চক্র সাবধান হয়নি। করোনাকালে অনেক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ভুয়া রিপোর্ট বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অপরাধীরা সবাই যে পার পেয়ে যায় এমন নয়, তবে আইনের ফাঁক গলে অনেকেই যে পার পেয়ে যায়- এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

নতুন সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন দেশের একজন নামকরা চিকিৎসক। গুণী এই চিকিৎসক স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় দেশের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন ও স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি পাবে- এমন প্রত্যাশা করছেন অনেকেই। দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই তিনি অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। আয়ানের পরিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ভুল চিকিৎসা হলে অবশ্যই দায়ী ব্যক্তির শাস্তি হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্য যেন অন্যান্য নেতাদের রাজনৈতিক বক্তব্যের মতো ফাঁকা বুলি না হয়। চিকিৎসার মতো একটি সংবেদনশীল বিষয়ে গাফিলতি করাকে অপরাধ হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। প্রমাণ সাপেক্ষে এ ধরনের অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।

একজন ডাক্তার হবেন প্রবলভাবে নৈতিক ও মানবিক গুণের অধিকারী। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরাই ডাক্তার হন এবং মানবসেবার ব্রত নিয়ে তাঁরা চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত হন। তাঁদের কাছে পরিবার, সমাজ ও দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে দেখা গেছে ডাক্তারগণ ছিলেন ‘ফ্রন্ট লাইন ফাইটার’ এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। উল্টোটাও যে দেখা যায়নি এমন নয়। অনেক ডাক্তার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী বিভিন্নভাবে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থও হাসিল করেছে। দুঃখের বিষয় এই যে, মহান পেশায় নিয়োজিত থেকেও এক শ্রেণির ডাক্তার রোগীদের প্রতি মানবিক আচরণ করেন না। ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে রোগীদের ওপর জুলুম করেন। তাহলে কি ডাক্তারদের প্রাইভেট প্রাকটিস তাঁদের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করে দিচ্ছে? বিষয়টি নিয়ে গবেষণার অবকাশ আছে বলে মনে হয়।

বর্তমানে সারা দেশে বেসরকারি পর্যায়ে পাঁচ হাজার হাসপাতাল ও দশ হাজার ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিবন্ধিত আছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। এর বাইরেও অসংখ্য হাসপাতাল-ক্লিনিক আছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠানগুলো কেন এবং কীভাবে এগুলো গড়ে উঠেছে- এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করলে মানতেই হবে যে, প্রয়োজনের তাগিদেই এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোর তুলনায় রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে সবাইকে চিকিৎসাসেবার আওতায় নিয়ে আসা সরকারি হাসপাতালগুলোর পক্ষে সম্ভব হয় না। এ বাস্তবতা থেকেই স্বাস্থ্যসেবায় বেসরকারি খাতের সৃষ্টি হয়েছে। এসব বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান যারা গড়ে তুলেছেন তাদের অনেকেই চিকিৎসা পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। তারা নিরেট ব্যবসায়ী। রোগী নামক কাস্টমার বা সেবাগ্রহীতার আধিক্য আছে বলেই তারা এ খাতে অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এতে ব্যয় বাড়লেও মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে।

এখন জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে সরকারকে দুটি কাজ করা প্রয়োজন। এক. অনুমোদনহীন বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর মান যাচাই করে মানসম্পন্নগুলোর অনুমোদন দেওয়া। দুই. একটি নীতিমালার আওতায় এনে সেগুলোকে নিয়মিত মনিটরিং-এর আওতায় নিয়ে আসা। এ দুটি কাজ অনেক আগেই করা উচিত ছিল। ভুল চিকিৎসায় কিংবা চিকিৎসকের গাফিলতির কারণে রোগীর মৃত্যু হলে এবং সেই মৃত্যু নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলেই কেবল স্বাস্থ্য বিভাগ নড়েচড়ে বসবে- এটা ঠিক নয়। আয়ানের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট রুল জারি করেছে, অনুমোদিত ও অননুমোদিত হাসপাতাল-ক্লিনিকের তালিকা চেয়েছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী অনুমোদনহীন হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন, দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করার কথা বলেছেন- এসবই যযার্থ পদক্ষেপ। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এ পদক্ষেপগুলো আগে নেওয়া হয়নি কেন? অনুমোদনহীন কিংবা মানহীন হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধ করার জন্য, ভুল চিকিৎসার শাস্তি বিধান করার জন্য সব সময় কি আমাদের একটি নির্মম মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে?

আলী রেজা: কলেজ শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :